দেখতে দেখতে আমাদের দেশ স্বাধীনতার ৭৫ বছরে পড়ল। কত অজস্র প্রাণের বলিদানের মাধ্যমে আমরা পেয়েছি আমাদের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। সেই স্বাধীনতা সংগ্রামে যাঁরা লড়েছিলেন, শহিদ হয়েছিলেন, তাঁদের পুণ্য জীবন নিয়ে বাংলায় বহু ছবি নির্মিত হয়েছে। এমনকী স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেক্ষাপট নিয়েও ছবি তৈরি হয়েছিল। সেখানে অভিনয়ে পুরুষ চরিত্রের প্রাধান্য থাকলেও, বেশ কিছু নারী চরিত্র পেয়েছি, যাঁরা সরাসরি সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত থেকে অথবা পুরুষ চরিত্রের প্রেরণা হিসেবে সংগ্রামকে শক্তিশালী করতে,গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। সেই মহীয়সী নারী চরিত্রগুলোকে নিয়েই এই শ্রদ্ধাঞ্জলি।
আরও পড়ুন-গান নয়, অরিজিৎ সিং এবার ইংরেজি মাস্টার
মঞ্জু দে
বিয়াল্লিশের ভারতছাড়ো আন্দোলন এখন ইতিহাস হয়ে গেছে। ইতিহাস হয়েছেন মেদিনীপুরের মাতঙ্গিনী হাজরা-সহ শত শত সাধারণ ছেলে-মেয়েরা। এঁদের দমন করতে কী দুঃসহ অত্যাচার চালিয়েছিল ইংরেজ কর্তৃপক্ষ মিলিটারির সাহায্যে। সেই ভয়াবহ কাহিনি নিয়ে নির্মিত হয়েছিল ‘৪২’ ছবিটি। ধর্ষণ করে, ঘর জ্বালিয়ে বেপরোয়া গুলি চালিয়ে শিশু-বৃদ্ধা খুন করেও ইংরেজ সরকার স্বাধীনতাকামীদের রুখতে পারেননি। মেজর জেনারেল ত্রিবেদী মানুষের পায়ের তলায় চেপে মারা গিয়েছিলেন। সেই কাহিনি নিয়ে ছবি হয়েছিল ‘৪২’। ছবিটির পরিচালক হেমেন গুপ্ত, তিনি বাংলায় ভুলি নাই, অভিযাত্রী প্রভৃতি হিন্দিতে আনন্দমঠ, কাবুলিওয়ালা, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস প্রভৃতি ছবি করেছিলেন। ৪২-এর চরিত্রলিপিতে ছিলেন নায়ক অজিতের চরিত্রে প্রদীপকুমার, কামারের চরিত্রে শম্ভু মিত্র, মেজর ত্রিবেদীর চরিত্রে বিকাশ রায়। পরিচালক ঠিক করে উঠতে পারছিলেন না মহিলা চরিত্রগুলোতে কাদের নেবেন। বিশেষ করে নায়িকার কথা। যাঁরা তখন ছিলেন তাঁদের কাউকেই হেমেন গুপ্তের পছন্দ হচ্ছিল না। গ্রাম্য মেয়ে অথচ তেজি। এমন চরিত্রেই নির্বাচিত হলেন মঞ্জু দে। নায়ক-এর স্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করলেন তিনি। প্রথম ছবিতে অভিনয় করতে গিয়ে দ্বিতীয়বারের জন্য টেক করতে হয়নি তাঁর কোনও শট। ৪২ ছবিটি যাঁরা দেখেছেন তাঁরা সকলেই অনুধাবন করতে পারবেন যে কী কঠিন চরিত্রে রূপদান করতে হয়েছিল। ওই রকম রূপদান করা সাধারণ শিল্পীর কাজ নয়, সে কথাও সকলেই স্বীকার করবেন। বিশেষ করে সেই দৃশ্যে যেখানে দুজন নেপালি দারোয়ান মঞ্জু দে’কে হাত-পা ধরে দোলাতে দোলাতে উঁচু বাঁধের ধারে ছুঁড়ে ফেলেন।
আরও পড়ুন-বিশ্বাসঘাতকের শাস্তি মৃত্যু তাতেও লেগে থাকা স্বদেশি মমত্ব
মঞ্জু দে গড়াতে গড়াতে নিচে গিয়ে পড়লেন। কী ভয়ঙ্কর দৃশ্য ও মঞ্জু দে’র কী অসাধারণ অভিনয়। এর পাশাপাশি আরেক অভিনেত্রী নজর কেড়েছিলেন ছবিতে। তিনি সুরুচি সেনগুপ্ত। সাংবাদিক সরোজ সেনগুপ্তের মা। তাঁকে এক রকম জোর করে হেমেন গুপ্ত রাজি করিয়েছিলেন। গ্রামের ব্যক্তিত্বপূর্ণ তেজস্বিনী বর্ষীয়সীর চরিত্রে। তিনি নায়কের ঠাকুমার চরিত্রে। অফারটা পাওয়ার পর বলেছিলেন ‘মেয়েদের স্কুলের হেডমাস্টারনির কাজ করেছি। ছেলেমেয়েদের জন্য কিছু লেখালেখি করি। কাগজে সাহিত্য বলে ছাপায়। কিন্তু বুড় বয়সে অ্যাক্টিং করতে কি পারব? ভুলে যাব যে!’ নায়কের ঠাকুমার চরিত্রের শিল্পী কিন্তু পরে তিনি সকলেরই ঠাকুরমা হয়ে গিয়েছিলেন। ছবিতে ওঁর মৃত্যুদৃশ্যের অভিনয় দেখে দর্শকদের কারও চোখ শুকনো ছিল না। আবার ফিরে আসি মঞ্জু দে’র কথায়। মৃণাল সেন পরিচালিত মহাদেবী বর্মার কাহিনি অবলম্বনে নির্মিত ‘নীল আকাশের নিচে’ ছবিতে বাসন্তী চরিত্রে তিনি শিল্পী। ১৯৩০ সালের পটভূমিকায় তৈরি হয়েছিল ছবিটি। স্বাধীনতা সংগ্রামে নিবেদিতপ্রাণ বাসন্তী। অ্যাডভোকেট স্বামীর (বিকাশ রায়) অজান্তে বাসন্তী দেশমাতৃকার সেবা করেন। এ-ব্যাপারে তাঁকে সাহায্য করেন এক চিনাম্যান হকার ওয়াং লু (কালী বন্দ্যোপাধ্যায়)। ভাই-বোনের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল ওয়াং লু এবং বাসন্তীর মধ্যে। এখানেও স্বাধীনতাকামী নারী চরিত্রে মঞ্জু দে দুর্দান্ত অভিনয় করলেন।
আরও পড়ুন-রবীন্দ্রনাথের অগ্নিকন্যা
দীপ্তি রায় ও স্মৃতিরেখা বিশ্বাস
পরিচালক নির্মল চৌধুরির পরিচালনায় নির্মিত হল স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমিকায় ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন’। বিপ্লবী সূর্য সেনের (মাস্টারদা নামে পরিচিত) অননুকরণীয় সাহসের গল্প আছে ছবিতে। মাস্টারদার নেতৃত্বে ৬৫ জন অসম সাহসীযুবক ও কতিপয় যুবতী চট্টগ্রামের দুটি অস্ত্রাগার লুণ্ঠন এবং ডাক ও তার অফিসে আক্রমণ করে দখল করেন। এ-ব্যাপারে তাঁকে প্রেরণা জোগান তাঁর স্ত্রী পুষ্প। সূর্য সেনের আন্দোলনে জড়িয়ে গিয়েছিলেন কল্পনা দত্ত। ইতিহাসে হয়তো তাঁদের কথা তেমন ভাবে আলোচিত হয়নি, তবু এঁদের অবদান অস্বীকার করার নয়। পুষ্প সেনের চরিত্রে দীপ্তি রায়। ‘স্বয়ংসিদ্ধা’ ছবিতে নির্ভীক নায়িকা চণ্ডীর চরিত্রে তিনি অবতীর্ণ হয়ে দর্শকদের মুগ্ধ করেছিলেন। এখানেও তিনি স্বামীকে উৎসাহ যুগিয়েছেন এই আন্দোলনে। সাবলীল অভিনয়ে চমকে দিয়েছিলেন। কল্পনা দত্তের চরিত্রের শিল্পী স্মৃতিরেখা বিশ্বাস। স্বাধীনতা সংগ্রামের এক রমণীর চরিত্রে চমৎকার অভিনয়।
আরও পড়ুন-ডুরান্ডের উদ্বোধনে আমন্ত্রণ মুখ্যমন্ত্রীকে, বাড়ছে প্রাইজ মানি
ছায়াদেবীর চরিত্রায়ণ
নায়িকার চরিত্র ছেড়ে ছায়াদেবী যখন চরিত্রাভিনয়ে এসেছেন তখন বেশ কয়েকটি ছবিতে তিনি সংগ্রামীদের জননীর ভূমিকায় অবতীর্ণা। তখন তিনি সত্যিই যেন রত্নগর্ভা। সে তালিকায় প্রথম নাম অবশ্যই ‘বিপ্লবী ক্ষুদিরাম’ ছবির। পরিচালক হিরণ্ময় সেন। কলকাতার অত্যাচারী প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে হত্যার জন্য তৈরি হয়েছিলেন ক্ষুদিরাম। কিংসফোর্ডের গাড়ি মনে করে বোমা নিক্ষেপ করেন ক্ষুদিরাম। কাজটিতে তিনি সফল হননি। তিনি গ্রেফতার হন। মাত্র ১৯ বছর বয়সে তাঁর ফাঁসি হয়। সেই বীর সন্তানের জননীর ভূমিকায় ছায়াদেবী নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন। হিরণ্ময় সেনের আরেকটি দেশাত্মবোধক ছবি ‘বাঘাযতীন’। মূল নাম যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। ১৯০৭ সালে কুষ্টিয়ায় একবার ছোরা হাতে তিনি একটি বাঘ মেরে ফেলেন বলে তিনি বাঘাযতীন নামে পরিচিত হন। ইংরেজদের সঙ্গে বাঙালির প্রথম মুখোমুখি যুদ্ধে তিনি ছিলেন প্রধান কান্ডারি। সেখানেও যতীনের মায়ের ভূমিকায় ছায়া দেবীর অভিনয় দর্শকের মনে সম্ভ্রম জাগিয়ে তোলে। একই কথা বলা চলে নির্মল চৌধুরি পরিচালিত ‘চারণ কবি মুকুন্দদাস’ ছবির সম্পর্কেও। মুকুন্দদাসের মায়ের ভূমিকায় ছায়াদেবীর অভিনয় সম্বন্ধেও। নাম ভূমিকায় সবিতাব্রত দত্ত। ছেলেকে মা সর্বদা প্রেরণা যুগিয়েছেন। ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ক্ষেত্রে তিনটি চরিত্রে তিনি যুগপৎ বাৎসল্য ও দাপট দেখিয়েছেন অসাধারণভাবে। সুধীর মুখোপাধ্যায়ের ‘দাদাঠাকুর’ ছবিতে নির্ভীক দাদাঠাকুর (ছবি বিশ্বাস) আরেক স্বদেশ প্রেমিক। যোগ্য সহধর্মিণী (ছায়া দেবী) তিনি পেয়েছিলেন। তাঁর অভিনয়কে কুর্নিশ জানাতেই হয়।
আরও পড়ুন-নিউইয়র্কে হামলা, ছুরিকাহত রুশদি
সুব্রতা চট্টোপাধ্যায়, লিলি চক্রবর্তী, মাধবী মুখোপাধ্যায়
‘মহাবিপ্লবী অরবিন্দ’ ছবিতে অরবিন্দের স্ত্রীর চরিত্রে সুব্রতা চট্টোপাধ্যায়। আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি অপূর্ব অভিনয় করে। একই কথা বলা যায় ‘দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন’ ছবিতে দেশবন্ধুর স্ত্রী বাসন্তী দেবীর চরিত্রে লিলি চক্রবর্তী সম্বন্ধেও। ব্যক্তিত্বপূর্ণ সে অভিনয়। ‘অগ্নিযুগের কাহিনি’ ছবিতে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সঙ্গী হিসেবে মাধবী মুখোপাধ্যায় চমৎকার অভিনয় করেছিলেন। শিল্পীরা চরিত্রগুলির প্রাণপ্রতিষ্ঠা করতে এতটুকু কার্পণ্য করেননি। আজকের দিনে এই শিল্পীদের অভিনয়ের কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতেই হয়।