‘‘আমি ত্বক ফর্সা করতে চেয়েছিলাম কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা পুড়ে গেল।’’
শিরোমার যখন তাঁর বিয়ের কেনাকাটা এবং অনুষ্ঠানে কারা কারা অতিথি হয়ে আসবেন সেদিকে নজর দেওয়ার কথা ছিল তখন তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তাঁর ত্বকের চিকিৎসায়। এর পেছনে অনেক অর্থও খরচ হল তাঁর।
আরও পড়ুন-ছকভাঙা আধুনিক এক নারী কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায়
বিয়ের দিন আমাকে দেখতে সত্যিই খুব খারাপ লাগছিল। এত খারাপ আর কখনও লাগেনি, আবেগময় কণ্ঠে একথা বললেন শিরোমা পেরেইরা। এটি তাঁর আসল নাম নয়। সামাজিক কারণে এই প্রতিবেদনে তাঁর নাম বদলে দেওয়া হয়েছে।
শ্রীলঙ্কাযর রাজধানী কলম্বোর কাছেই থাকেন ৩১ বছর বয়সি শিরোমা। গত বছর বিয়ের আগে তিনি তাঁর ত্বকের রঙ ফর্সা করতে চেয়েছিলেন। তাঁর মতো দক্ষিণ এশিয়ায় আরও অনেক নারীই তাঁদের গায়ের রঙ উজ্জ্বল করতে আগ্রহী।
‘‘বিয়ের দু মাস আগে আমি একটি সেলুনে গিয়েছিলাম। রঙ ফর্সা করার জন্যে তারা তখন আমাকে একটি ক্রিম দিয়েছিল। দু সপ্তাহ ব্যবহার করার পর দেখলাম আমার মুখ জ্বলে গেছে’ বলেন তিনি।
আরও পড়ুন-বড় পর্দায় প্রথম মর্জিনা সাধনা বসু
সেলুন থেকে তাঁকে রং-ফর্সাকারী যে ক্রিম দেওয়া হয়েছিল সেটি কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত কোনও প্রসাধনী সামগ্রী ছিল না। এই ক্রিম অবৈধভাবে আমদানি করে কালো বাজারে বিক্রি করা হচ্ছিল।
এক বছর ধরে চিকিৎসার পর পেরেইরার গলায় এখনো সেই কালো দাগ রয়ে গেছে। এরকম আরও কিছু অভিযোগ পাওয়ার পর শ্রীলঙ্কার কর্তৃপক্ষ এখন অনুমোদন নেই এরকম রং-ফর্সাকারী ক্রিম বিক্রির বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে। কিন্তু এই সমস্যা শুধু শ্রীলঙ্কারই সমস্যা নয়। এশিয়া এবং আফ্রিকাতে লাখ লাখ মানুষ, যাঁদের বেশিরভাগই নারী, গায়ের রং ফর্সা করার জন্যে এমন কিছু ব্যবহার করেন যা শেষ পর্যন্ত তাঁদের জন্যে ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়।
বাজার
সারা বিশ্বে গায়ের রং ফর্সা করার এই বাজারের আকার ২০১৭ সালে ছিল প্রায় ৪৮০ কোটি ডলার। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৭ সালের মধ্যে এই বাজার দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়াবে ৮৯০ কোটি ডলারে।
এর চাহিদা মূলত এশিয়া ও আফ্রিকার মধ্যবিত্ত পরিবারে।
আরও পড়ুন-কবির সহধর্মিণী
রং-ফর্সাকারী এসব পণ্যের মধ্যে রয়েছে সাবান, ক্রিম, ব্রাশ, ট্যাবলেট। এমনকী ইঞ্জেকশনও রয়েছে। মানবদেহে মেলানিন পিগমেন্টের উৎপাদন কমিয়ে দেয় এই ইঞ্জেকশন এবং এগুলো অনেক জনপ্রিয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক হিসেবে দেখা গেছে, আফ্রিকাতে প্রতি ১০ জন নারীর চারজন রং-ফর্সাকারী পণ্য ব্যবহার করে থাকেন। সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় নাইজেরিয়াতে। সেখানে ৭৭% নারী ত্বকের রং উজ্জ্বল করার জন্যে নানা ধরনের প্রসাধনী ব্যবহার করে থাকেন। তার পরেই রয়েছে টোগো, ৫৯% এবং দক্ষিণ আফ্রিকা ৩৫%।
এশিয়ায় ৬১% ভারতীয় নারী এবং চিনে ৪০% নারী এসব ব্যবহার করেন।
গবেষণায় দেখা গেছে, এসব জিনিসের প্রতি ভোক্তাদের চাহিদাও বাড়ছে। একই সঙ্গে এসব মোকাবিলা করাও কঠিন হয়ে পড়েছে।
গত বছর ঘানাতে কর্তৃপক্ষ গর্ভবতী নারীদেরকে সতর্ক করে দিয়েছিল রং ফর্সাকারী ট্যাবলেট না খাওয়ার জন্যে। কারণ এসব ট্যাবলেটে পাওয়া গেছে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট গ্লুটাথিওন।
আরও পড়ুন-রূপকথার ভুবনজয়ী লক্ষ্যভেদী নারীরা
গর্ভবতী নারীরা মনে করেন তাঁরা যদি এই ট্যাবলেট খান তাহলে তাঁদের গর্ভে থাকা সন্তানের গায়ের রং ফর্সা হবে।
এ-ধরনের পণ্য মোকাবিলার জন্যে দক্ষিণ আফ্রিকাতে আছে কঠোর কঠোর আইন। গাম্বিয়া, আইভরি কোস্ট এবং রোয়ান্ডাতে রং-ফর্সাকারী যেসব পণ্যে হাইড্রোকুইনোন আছে সেগুলো নিষিদ্ধ করেছে।
শরীরে মেলানিনের (বাদামী কিংবা কালো পিগমেন্ট, যার কারণে ত্বকের রঙ নির্ধারিত হয়) উৎপাদন কমিয়ে দেয় হাইড্রোকুইনোন। একই সঙ্গে এটি স্থায়ীভাবে ত্বকের ক্ষতিও করতে পারে।
চিকিৎসা
ব্রিটিশ স্কিন ফাউন্ডেশন বলছে, ‘চর্ম চিকিৎসকদের সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধানে হাইড্রোকুইনোন আছে এরকম পণ্য নিরাপদে ব্যবহার করা যেতে পারে। ত্বকের যেসব স্থানে কালো দাগ পড়ে গেছে সেগুলো এর মাধ্যমে চিকিৎসা করা যায় এবং তাতে ভাল ফল পাওয়াও সম্ভব।’
কার্যকারিতা
আরও পড়ুন-লালুকে হেনস্তা
তবে ব্রিটিশ স্কিন ফাউন্ডেশন বলছে, ‘পুরো ত্বক ফর্সা করার নিরাপদ কোনও উপায় নেই।’
‘দোকানে যেসব ক্রিম বিক্রি হয় সেগুলো যে আসলেই গায়ের রং ফর্সা করে এমন প্রমাণ নেই। এর উল্টো ফলও হতে পারে। এই ক্রিম আপনার ত্বককে অস্বাভাবিক রকমের সাদা অথবা আরও কালোও করে দিতে পারে। এর ফলে নষ্ট হয়ে যেতে পারে ত্বকের স্বাভাবিক গুণাবলিও’ সতর্ক করে দিয়েছেন আলেকজানড্রফ।
তবে ম্যালাসমার মতো কিছু কিছু সমস্যার চিকিৎসার জন্যে চিকিৎসকরা রং ফর্সাকারী পণ্য প্রেসক্রাইব করে থাকেন।
বয়স হলে শরীরে এরকম সমস্যা দেখা দেওয়া খুবই সাধারণ বিষয়। এতে ত্বকে বাদামী কিংবা ধূসর রঙের দাগ তৈরি হয়। বিশেষ করে মুখে। নারীদের দেহে এরকম হওয়ার হার বেশি। বিশেষ করে গর্ভধারণের সময়। একজন চর্মরোগ চিকিৎসকের মাধ্যমে ত্বকের রং ফিরিয়ে আনা সম্ভব। তবে সেজন্যে অনুমোদিত কিছু ক্রিম আছে যা ডাক্তারদের পরামর্শে ব্যবহার করা যেতে পারে বলে বলেন চিকিৎসকরা।
আরও পড়ুন-‘শহিদ মিনারের মাথা লাল রং করা ঠিক হয়নি’
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে নারীরা চিকিৎসকদের পরামর্শ ও নজরদারি ছাড়াই এসব রং-ফর্সাকারী কসমেটিক ব্যবহার করতে শুরু করে দেন। কিন্তু এসব প্রসাধনীর গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকতে পারে। যেমন: ত্বকে চুলকানি, প্রদাহ, জ্বালাপোড়া, ফুলে যাওয়া, ফুসকুড়ি পড়া৷
মার্কারি
কিছু কিছু পণ্য যেগুলো দ্রুত রং ফর্সা করার দাবি করে সেগুলোতে নানা রকমের ক্ষতিকর উপাদানও থাকতে পারে।
‘যেসব পণ্যে মার্কারি আছে সেগুলো স্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকর’— বলছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। কিন্তু তারপরেও মার্কারি আছে এরকম পণ্য চিন, লেবানন, মেক্সিকো, পাকিস্তান, ফিলিপিন, থাইল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদিত হচ্ছে।
শরীরে মেলানিন গঠনের প্রক্রিয়াকে শ্লথ করে দেয় এই হাইড্রোকুইনোন।
যেসব পণ্যে মার্কারি আছে সেগুলোর বিক্রি ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং আফ্রিকার বহু দেশে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ফিলিপিন এবং আরও কয়েকটি দেশ অল্প পরিমাণে মার্কারি আছে যেসব পণ্যে সেগুলো বিক্রির অনুমোদন দিয়ে থাকে।
স্বাস্থ্য
‘মার্কারি হচ্ছে বিষ’— বলেন হু’র বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আলেকজানড্রফ। তিনি বলেন, এর ফলে নানা রকমের স্বাস্থ্য-সমস্যা তৈরি হতে পারে।
মার্কারি আছে যেসব সাবান ও ক্রিমে সেগুলো ব্যবহার করলে যেসব ক্ষতি হতে পারে: কিডনির ক্ষতি, ত্বকে ফুসকুড়ি হওয়া, রং বদলে যাওয়া, কালশিটে দাগ পড়া, ব্যাকটেরিয়া ও ফাংগাল সংক্রমণ প্রতিরোধের ক্ষমতা কমে যাওয়া, উদ্বেগ উৎকণ্ঠা, বিষণ্ণতা, মানসিক অস্থিরতা থেকে বৈকল্য, স্নায়ু-জনিত সমস্যা৷ (উৎস: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা)
আরও পড়ুন-কোনও অন্যায় কাজে থাকবেন না: অনুব্রত
ধারণা
‘লোকেরা মনে করেন যে ত্বকের ক্রিম সাধারণত নিরাপদ। এর ফলে স্বাস্থ্যের কী ক্ষতি হতে পারে এটা নিয়ে তারা চিন্তাও করেন না। এই মানসিকতা পরিবর্তনের প্রয়োজন’ বলেন আমেরিকান ত্বক বিজ্ঞানী শুয়াই জু।
গায়ের রং ফর্সা হতে হবে— এই মানসিকতার পরিবর্তনের জন্যে বিভিন্ন নানা ধরনের আন্দোলন চলছে।
ভারতে এরকম এক আন্দোলনের নাম: ‘কালোই সুন্দর’। পাকিস্তানে এরকম এক আন্দোলনের স্লোগান: ‘সুন্দর হতে হলে আপনার ত্বকের রং ফর্সা হতে হবে না’।