বিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে থাকা ভাইরাস ও মানুষের সহাবস্থান কখনও ভাল কখনও খারাপ। এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা যা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে গোটা পৃথিবী, আজ তারা সব প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে জায়গা করে নিয়েছে মানব জিনেই। লিখছেন প্রিয়াঙ্কা চক্রবর্তী
না জীব না জড়, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা যা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে গোটা পৃথিবী, সেই সৃষ্টির আদিকাল থেকে, প্রাচীনের চেয়েও প্রাচীন আদিমতম এই কণা হল ভাইরাস। কোষ, জিন ও জীব এই তিনটির সাথেই জড়িয়ে রয়েছে এই ভাইরাস বেশ ওতপ্রোতভাবেই, তাই তার প্রভাব যে গোটা জীবকুলেই পড়েছে তা বলা বাহুল্য আর তারই সাথে এই আদিকণা জায়গা করে নিয়েছে মানবহৃদয়ে না হলেও মানব জিনে। মানুষের রোগের বহুকালের ইতিহাস ঘাঁটলেই দেখা যায় যে বিভিন্নকালে, বিভিন্নভাবে মানুষ এই ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে, আর শুধু মানুষই কেন মনুষ্যেতর প্রাণী বা অ্যালগিরাও এর কবল থেকে মুক্তি পায়নি। তাই সমস্ত প্রতিবন্ধকতাকে নস্যাৎ করে আজ তারা মানব জিনে নিজেদের জায়গা করে নিয়েছে।
আরও পড়ুন-বাগডোগরা বিমানবন্দর উপেক্ষিতই রয়ে গেল!
ভাইরাস আসলে একটি প্রোভাইরাস আকারে তাদের হোস্ট জীবের মধ্যে তাদের জিনোমের অনুপ্রবেশ ঘটায়। বর্তমানে প্রায় ৩০টি বিভিন্ন ধরনের এরকম এন্ডোজেনাস রেট্রোভাইরাস রয়েছে, যার পরিমাণ করলে দেখা যায় তা মানব জিনোমে ৬০০০০-এর বেশি প্রোভাইরাস-এর সমান। তারা বিবর্তনের সময়কাল থেকেই মানবজাতির বহু মহামারীর দীর্ঘ ইতিহাস বহন করে চলেছে। আর এই তথ্যগুলিই প্রমাণ করে কীভাবে তিলে তিলে ভাইরাস মানব জিনে জায়গা বানিয়েছে। বিজ্ঞানীরা এটি মনে করেন যে এই ভাইরাসগুলিই আসলে জনসংখ্যাকে ব্যাপকভাবে সংক্রামিত করেছিল, যার ফলস্বরূপ আজ তারা মানব জিনকে জবরদখল করতে পেরেছে, যদিও শুধু মানব জিনেই তারা সীমাবদ্ধ নেই তারা জায়গা করে নিয়েছে শিম্পাঞ্জি, গরিলা এবং অন্যান্য প্রাইমেট জিনোমেও।
আরও পড়ুন-মোদিরাজ্যে দিনে ছ’জন ধ.র্ষিতা হন! আতঙ্কের সরকারি রিপোর্ট
এইই ভাল এইই খারাপ
এবার প্রশ্ন হল, মানব জিনে ভাইরাসের জিনের অন্তর্ভুক্তি কি কেবলই খারাপ নাকি তার কিছু ভাল দিকও আছে? বিবর্তনের পথ ধরে এগোতে এগোতে মানুষ বহুবার বিভিন্ন রোগের শিকার হয়েছে, হয়েছে অতিমারি ও মহামারী এসব যেমন ঠিক তেমনই এসবের মধ্যেও মানব জিনে ভাইরাসের অন্তুর্ভুক্তি মানুষকে দিয়েছে এমন এক জিনিস যা গোটা মানবজাতির অস্তিত্ব বজায় রাখতে সহায়তা করে। যদিও শুধু ভাইরাস বলাটা হয়তো এক্ষত্রে ঠিক হবে না বলতে হবে রেট্রোভাইরাস (এমন একটি ভাইরাস যার জেনেটিক বস্তুটি আসলে আরএনএ হলেও মানব কোষে বা যে-কোনও হোস্ট কোষে প্রবেশ মাত্র তা ডিএনএ-তে পরিবর্তিত হয়ে যায় ও হোস্ট ডিএনএ-র অঙ্গীভূত হওয়ার দ্বারা তাদের নিজস্ব প্রতিলিপি গঠন করতে থাকে ফলত সেই হোস্ট রোগের শিকার হয়)। এই রেট্রোভাইরাসেরই একটি শাখা ডোমেস্টিকেটেড অর্থাৎ একপ্রকার পোষ্যরূপেই মানব জিনে এসেছে আর শুধু তাই নয় তারা সিনসাইটোট্রফোব্লাস্ট তৈরি করতে সাহায্য করেছে যা কিনা মাতার গর্ভে মানবভ্রূণকে যথাযথ উপায়ে লালিত করতে ও বেড়ে উঠতে সাহায্য করে। সহজ করে বললে বলা যায় এটি মানুষকে দিয়েছে সন্তানধারণের জন্য প্লাসেন্টা। এই সিনসাইটোট্রফোব্লাস্ট স্তরটি এমনই একটা স্তর যেটি ভ্রূণের অংশ হলেও মাতার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে সাহায্য করে, এরা মায়ের দেহকলার সাথে এমনভাবেই বিন্যস্ত থাকে যাতে ভ্রূণ মায়ের দেহ থেকে সমস্ত পুষ্টিরস পায় কিন্তু মায়ের অনাক্রম্য কোষগুলি ভ্রূণের কিছুতেই নাগাল না পেতে পারে। তাই ভ্রূণও স্বাচ্ছন্দ্যে বেড়ে উঠতে পারে।
আরও পড়ুন-বাংলার বিরুদ্ধে ‘চক্রান্তে’ না, পদত্যাগে বাধ্য করা হল নির্বাচন কমিশনারকে!
কিন্তু যদি এই প্লাসেন্টা না থাকত তবে কী হত এই মানবজাতির? মানব গর্ভে বেড়ে ওঠা ভ্রূণ মাতার কোষ দ্বারাই আক্রান্ত হত, আর তাদের অস্তিত্ব থাকত একটা বড় প্রশ্নচিহ্নের মুখে। ভাইরাসের জিনোমের মানুষের জিনে অন্তর্ভুক্তির পেছনেও রয়েছে একটি সুদীর্ঘ ইতিহাস। আসলে সেই সৃষ্টির আদিকাল থেকেই এরা পরনির্ভরশীল, কোনও হোস্ট দেহ ছাড়া এরা সজীব জীবন যাপন করতে পারে না তাই এই নির্ভরশীলতা চলতে চলতে ক্রমে ছোট প্রাণী অতিক্রম করে শেষে মানুষে এসে পৌঁছয়। আর তার ছাপ থেকে যায় মানব জিনে। আমাদের জিনোমের প্রায় আট শতাংশ হল ভাইরাল জিন, বলা যায় একপ্রকার ভাইরাল এই জিন ফসিল আকারে আমাদের জিনে রয়ে গেছে। তবে আমাদের জিন ভাইরাসের জিনের এই যোগদান যে একেবারেই অপকারী তা বলা যায় না, কারণ চোখের সামনে বারংবার ভেসে ওঠে সেই প্লাসেন্টার কথা। তবে এই যে প্লাসেন্টার প্রাপ্তি এবং সেটি যে বংশ পরম্পরায় কাল সীমানার গণ্ডি পেরিয়ে আজও একইভাবে বহাল রয়েছে এর পিছনে কী বৈজ্ঞানিক যুক্তি আছে? আসলে ভাইরাস যখন আক্রমণ করে তখন কোন ধরনের কোষ কোথায় আক্রমণ করছে তার কোনও বাছবিচার করে না, আর এইভাবেই আক্রমণ করতে গিয়ে যদি তারা আমাদের জার্ম কোষ বা জনন কোষে আক্রমণ করে বসে তখন সেই কোষের মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্মেও সেই ভাইরাসে জিনের অংশবিশেষ পরিবাহিত হয়। এভাবেই কিন্তু ভাইরাস আমাদের জিনের অংশ হয়ে ওঠে। এবার আসি কীভাবে ভাইরাস জিন আমাদের গুরুত্বপূর্ণ এই প্লাসেন্টা দান করল তার কথায়। মূলত রেট্রো ভাইরাসদের বাইরে একপ্রকারের প্রোটিন খোলক থাকে যাকে ‘এনভেলপ গ্লাইকোপ্রোটিন’ বলা হয়। এই প্রোটিন সাধারণত যে কোষকে আক্রমণ করে সেই কোষের বাইরের পর্দার গ্রাহকের সাথে সংযোগ সাধনের দ্বারা সেই কোষপর্দার সাথে যুক্ত হয়ে নিজের জিন দ্বারা তাদের আক্রমণ করে। এই প্রোটিনের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হল এটি খুব কাছাকাছি থাকা পর্দার সাথে সংযুক্ত হয়ে যেতে পারে, আর তাই এই গুণ আমাদের মধ্যেও অধিগৃহীত হওয়ার ফলে আমাদের প্লাসেন্টার কোষগুলিও একত্রিত হয়ে একটি লম্বা চাদরের মতো আস্তরণ তৈরি করে যা ভ্রূণকে প্রতিরক্ষা প্রদানের পাশাপাশি মায়ের আক্রমণকারী কোষ থেকেও তাকে বাঁচায়।
আরও পড়ুন-জনতার বজ্রনির্ঘোষে জবাব আজ বিজেপিকে
ভাইরাসের এই দান কিন্তু এমনিতে বা একদিনে মানবজাতি পায়নি, যুগের পর যুগ এর মূল্য চোকাতে হয়েছে মানুষকে। যুগের পর যুগ ধরে অতিমারি, মহামারী পেরিয়ে প্রায় লক্ষ কোটি মানুষের প্রাণের বদলে পাওয়া গেছে এই দান। তবে ভাইরাস কিন্তু যত না উপকার করেছে তার চেয়ে ক্ষতি করেছে অনেক অনেক বেশি। বরং ভাইরাস যে উপকার করতেও পারে সেটিই বরং আমাদের অনেকের কাছে আজও অজানা।
রেট্রোভাইরাসের পরিচিতি ও কর্মকাণ্ড
আজ থেকে প্রায় পনেরো বছর বা তারও অনেক আগে এই ভাইরাসকে জানার ও চেনার জন্য খোঁজ শুরু হয়েছিল মূলত ক্যানসারের উৎস সন্ধানের চেষ্টায় আর এই চেষ্টার ফলস্বরূপ আমরা খোঁজ পেয়েছি এইচআইভি-র মতো ভাইরাসের। যা কিনা এক অত্যন্ত আক্রমণাত্মক রেট্রোভাইরাস। আসলে রেট্রোভাইরাস হল রেট্রোভিরিডি বা রেট্রোভাইরয়ডি গোষ্ঠীভুক্ত একপ্রকারের ভাইরাস যার মূল জেনেটিক উপাদান হল এরএনএ। এরা প্রয়োজন অনুসারে একটি বিশেষ ধরনের উৎসেচক যার নাম রিভার্স ট্রান্সক্রিপ্টেজ তার মাধ্যমে অতি সহজেই আরএনএ থেকে ডিএনএ-তে পরিবর্তিত হতে পারে আর এত তৎপরতার জন্যই এদের আক্রমণ করার ক্ষমতা বাকি সমস্ত ভাইরাসের তুলনায় খুব স্বাভাবিকভাবেই বেশি। তবে এইচআইভি ছাড়াও রয়েছে হিউম্যান এন্ডোজেনাস রেট্রোভাইরাস বা এইচইআরভি। এগুলিকে আসলে মানুষ ও ভাইরাসের অপত্য বলা যেতে পারে। খুব সহজ ভাষায় বললে বলা যায় রেট্রোভাইরাসগুলি মানব শরীরকে আক্রমণ করে জিনের যে অংশবিশেষ মানব জিনে দান করেছে তার থেকেই জন্ম নিয়েছে রেট্রোভাইরাসের এক নতুন প্রজন্ম এই হিউম্যান এন্ডোজেনাস রেট্রোভাইরাস। যার কাজকর্ম পুরোদস্তুর রেট্রোভাইরাসগুলির মতো হলেও এটি মনে করা হয় যে এরা জিনের বিবর্তনে— বলা ভাল বিশেষ করে মানুষের জিনের বিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যদিও এই এইচইআরভি-র জিনগুলি চোয়ালবিশিষ্ট মেরুদণ্ডী প্রাণীদের জিনে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ দেখা যায় তবুও মানব জিনে এর পরিমাণ নেহাতই কম নয়, প্রায় পাঁচ থেকে আট শতাংশ। এত কিছুর পরও মনে রাখতে হবে এরা ভাইরাস, রোগ তো ছড়াবেই। আর তাই মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস, স্কিৎজোফ্রেনিয়া ইত্যাদি মস্তিষ্কের রোগ-সহ অনাক্রম্যতা জনিত সমস্ত রোগের মূল কারক কিন্তু ইনিই।
আরও পড়ুন-মোদিরাজ্যে দিনে ছ’জন ধ.র্ষিতা হন! আতঙ্কের সরকারি রিপোর্ট
সাম্প্রতিক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার
সাম্প্রতিককালে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ফলে এটি দেখা গিয়েছে যে লং ইন্টারস্পার্সড এলিমেন্ট-1 (লাইন-১) রেট্রোট্রান্সপোসন হল একটি ‘প্রাচীন জেনেটিক প্যারাসাইট’ যা ‘কপি-এবং-পেস্ট’ পদ্ধতির মাধ্যমে মানব জিনোমের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ অংশ রচনা করেছে এবং যার সাথে ভাইরাসের জিনের বেশ মিল রয়েছে। শুধু তাই-ই নয়, এটি জেনেটিক বৈচিত্র্যের সক্রিয় উৎস তথা মানুষের সমস্ত রোগের কারকও বটে। এই লাইন-১ রেট্রোট্রান্সপোসন হল মানুষের ডিএনএ-তে থাকা সবচেয়ে সাধারণ উপাদানগুলির মধ্যে একটি, যা ‘ডার্ক জিনোমের বা অন্ধকার জিনোমের’ একটি প্রধান অংশ, বলা বাহুল্য এই অংশটি সম্বন্ধে খুব কমই জানা গিয়েছে, মূলত এই কারণেই এর এমন নামকরণ হয়েছে। আসলে এটি এমন একপ্রকারের জেনেটিক উপাদান যা মানবদেহের ব্যবহার্য কোনও প্রোটিন তৈরি করে না বা এর জন্য কোনও ব্লুপ্রিন্টও সরবরাহ করে না।
সাধারণত সুস্থ কোষে এটি সুপ্ত অবস্থায় অবস্থান করে ঠিকই কিন্তু রোগগ্রস্ত অবস্থায় এই লাইন-১ মুক্ত হয়ে প্রোটিন তৈরি করতে পারে, যার মধ্যে LINE-1 ORF2 প্রোটিন (LINE-1 ORF2p) নামক একটি প্রোটিন রয়েছে যা লাইন-1-এর নতুন মিউটেশন-সৃষ্টিকারী কপিগুলিকে আবার আমাদের কোষের ডিএনএ-তে যুক্ত করার চেষ্টা করে। এই লাইন-1 উপাদানগুলির সক্রিয়তা সাধারণত ক্যানসার এবং অন্যান্য রোগের পাশাপাশি স্ব-অনাক্রম্যতা ক্ষমতার একটি সাধারণ চালক বলে মনে হয়। লাইন-1-এর বিস্তারিত জ্ঞান, লাইন-1 আরএনএ এবং লাইন-1 ORF2p-সহ এমন ওষুধ আবিষ্কার বা তৈরি করতে সক্ষম হতে পারে যা এক বা একাধিক অণুর সাথে আবদ্ধ হয়ে শরীরের ক্ষতি করা বন্ধ করে। যদিও এই প্রসঙ্গে আলবার্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ম্যাথিয়াস গোটে বলেছেন—‘‘রেট্রোট্রান্সপোসনগুলিকে প্রায়শই ‘জাম্পিং জিন’ হিসেবে উল্লেখ করা হয় যা আমাদের ক্রোমোজোমে সাধারণত কপি-অ্যান্ড-পেস্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিজেদের জিনকে ঢোকায়।” বিজ্ঞানীদের ধারণা অনুযায়ী এই লাইন-1-এর বিস্তারিত জ্ঞান এটির ক্রিয়াকৌশল সম্বন্ধে জানতে সাহায্য করে, এমনকী বাজারচলতি বিদ্যমান ওষুধগুলি কেন কাজ করে না তার ওপরেও আলোকপাত করে। এমনকী তারা এই উপাদানগুলির বিবর্তন এবং এটি কীভাবে ভাইরাসগুলির সাথে সম্পর্কিত হতে পারে সে-সম্পর্কে বোঝার ক্ষেত্রেও বেশ অগ্রগতি লাভ করেছে।
আরও পড়ুন-বাগডোগরা বিমানবন্দর উপেক্ষিতই রয়ে গেল!
তাহলে এত আলোচনা পর্যালোচনা থেকে যেটি উঠে আসে সেটি হল বিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে থাকা ভাইরাস ও মানুষের সহাবস্থান মানুষকে যেমন দিয়েছে রোগ, মহামারী তেমনই দিয়েছে ভ্রূণকে লালিত করার উপায়। তাই ভাইরাস অপকারী হলেও বিবর্তনে তাদের ভূমিকাকে বোধ হয় আমরা ছোট করতে পারি না তা সে যতই ক্ষুদ্র হোক না কেন।