যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় ফের কুঠারাঘাত। মোদি সরকারের স্বৈরাচারী শাসনের প্রমাণ আবার। লিখছেন প্রাক্তন সাংসদ ও রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্য সচিব মণীশ গুপ্ত
ভারতে রাজ্য সরকারগুলির ভূমিকাকে তাৎপর্যহীন করার জন্য গত কয়েক বছর ধরে কেন্দ্রীয় সরকারের নিরলস প্রচেষ্টা কেবল কেন্দ্র এবং রাজ্যগুলির মধ্যে নির্ধারিত বোঝাপড়ার সম্পর্কের অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্বকেই বাড়িয়ে তুলেছে না বরং সাংবিধানিক অনৈতিকতার প্রতি প্রশ্রয় অব্যাহত রেখেছে। ‘‘সাংবিধানিক যুক্তরাষ্ট্রীয় ধ্যান-ধারণা” চিরতরে বিসর্জন দেওয়ার জন্য একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টা চলছে। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক বিষয় এই যে রাজ্যগুলি তাদের নিজ নিজ রাজ্যের জনগণের উন্নতির জন্য গত ৭৫ বছরে তাদের সেরাটা উৎসর্গ করে দিয়েছে, অথচ এই অবিসংবাদিত সত্যকে কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত কোনও দায়িত্বজ্ঞানহীন এবং দুর্বিনীত সরকার অবহেলা করতে পারে, সংবিধানের স্রষ্টারা সে কথা কখনও কল্পনাও করেননি। কেন্দ্র-রাজ্য পারস্পরিক সহযোগিতা ভারতের অগ্রগতির অন্যতম ভিত্তি হওয়া উচিত। এটাই তাঁদের ভাবনায় ছিল।
আরও পড়ুন-লাক্ষাচাষে আয়ের উৎসসন্ধান
ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি রাজ্যের মধ্যে এখন ব্যাপক আতঙ্ক বিরাজ করছে, যারা উপলব্ধি করেছে যে আইএএস ক্যাডার আইন, ১৯৫৪-এর ৬ নম্বর বিধিতে প্রস্তাবিত সংশোধনীগুলি বাস্তবায়িত হলে রাজ্যগুলির প্রশাসনিক ব্যবস্থায় একটি গঠনতান্ত্রিক পরিবর্তনের সূচনা হবে যা বহু পরীক্ষিত ও সমন্বয়পূর্ণ বিদ্যমান ব্যবস্থাকে ব্যাহত করবে। দেশের ছয়টি রাজ্য এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করেছে, যার মধ্যে বিজেপি এবং তার সহযোগীদল দ্বারা শাসিত রাজ্যগুলিও রয়েছে। প্রস্তাবিত সংশোধনীগুলি কার্যোপযোগী শাসন ব্যবস্থার পথে অন্তরায় সৃষ্টি করবে এবং নির্বাচিত রাজ্য সরকারগুলির বিরুদ্ধে কখনো-কখনো আমলাতন্ত্রকে বিদ্রোহী করে তোলার পাশাপাশি আইনি ও প্রশাসনিক বিরোধ তৈরিতে সাহায্য করতে পারে।
আরও পড়ুন-মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মদিবসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্রদ্ধার্ঘ্য
বর্তমান ব্যবস্থায় রাজ্যগুলিতে নিযুক্ত অল ইন্ডিয়া সার্ভিস অফিসারদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলেই সন্তোষজনক সম্পর্কের ভিত্তিতে কাজ করছে। রাজ্যগুলির সঙ্গে পরামর্শক্রমে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শাসন-সংক্রান্ত নিয়মে যেসব সংশোধন করা হয়েছে সেগুলি কিন্তু কোনও বিভ্রান্তি তৈরি করেনি। যেমন IAS (Discipline & Appeal) Rules, 1969। প্রস্তাবিত সংশোধনীসমূহ Indian Administrative Service (Cadre) আইন, ১৯৫৪-এর বিধি ৬ (ক্যাডার অফিসারদের ডেপুটেশন) সম্পর্কিত। এগুলি অল ইন্ডিয়া সার্ভিস অফিসারদের যেমন IPS, IFS (Indian Forest Service) ইত্যাদি ক্ষেত্রে সরাসরি মিউটেটিস মিউট্যান্ডিস প্রয়োগ করার কথা বলছে।
আরও পড়ুন-নেতাজি অন্তর্ধান রহস্যের বিস্ফোরক অধ্যায়, তদন্তে ‘মিশন নেতাজি’র গবেষক চন্দ্রচূড় ঘোষ, অনুজ ধর এবং টিম
এখানে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় যে রাজ্যগুলির সঙ্গে সুস্থ আলোচনা, পরামর্শ, অনুমোদন ও প্রবর্তিত অনুশীলন ব্যতিরেকে কেন্দ্রীয় সরকার একতরফাভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করার প্রয়াস চালাচ্ছে। রাজ্যগুলি থেকে কেন্দ্রে আইএএস, আইপিএস অফিসারদের বদলি করার স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতায় নিজেদের সজ্জিত করার পরিকল্পনা করছে। প্রস্তাবিত সংশোধনীগুলি বলছে, কেন্দ্রীয় সরকারের চাওয়া মাত্রই আইএএস এবং আইপিএস অফিসারদের খেয়াল-খুশিমতো একতরফাভাবে রাজ্যের বাইরে পোস্টিংয়ের জন্য রাজ্যগুলিকে ছেড়ে দিতে বাধ্য করবে। রাজ্যগুলি যে সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে তার কোনও ভাবনাচিন্তা নেই। যেখানে গুরুত্ব দেওয়ার কথা সেখানে কোনও আমল দেওয়া হচ্ছে না।
সরকারি কর্মচারীর সার্বিক ঘাটতি রয়েছে। প্রস্তাবিত সংশোধনীগুলির দরুন সর্বভারতীয় অফিসাররা অবনমিত ও হতাশ হয়ে পড়বে এবং তাদের কর্মজীবন ও ভবিষ্যত অগ্রগতি নিয়ে একটি ভীতিকর অনিশ্চয়তা নেমে আসবে। আধিকারিকদের মনোবল ভেঙে যাবে কারণ কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্য সরকারের সাথে পরামর্শ ছাড়াই কেন্দ্রে ডেপুটেশনের জন্য যখনতখন যাকে খুশি বেছে নিতে পারবে। সেই ক্ষেত্রে তখন যোগ্যতাকে প্রাধান্য না দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের ইচ্ছার দ্বারা সেই নির্বাচন প্রভাবিত অর্থাৎ “cherry picked” হতে পারে।
পোস্টিং/স্থানান্তর নিয়ে যোগ্য আধিকারিকদের কর্মজীবনে চরম অনিশ্চয়তার আতঙ্ক সবসময় গ্রাস করবে কারণ কেন্দ্রে ডেপুটেশন যে কোনও সময় ঘটতে পারে। আধিকারিক এবং তাদের পরিবারকে প্রতি মুহূর্ত অজানা আশঙ্কা নিয়ে সংকটময় জীবন কাটাতে হবে। এটি তাদের আত্মবিশ্বাস, নিরপেক্ষতা এবং সেবার উপযোগী কর্মশক্তি ও মানসিক চেতনাকে বিধ্বস্ত করবে। রাজ্য সরকারগুলি কীভাবে সময়ে সময়ে আধিকারিকদের তালিকা তৈরি করবে, যাদের কেন্দ্রে পাঠানোর জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে তা এই সময়ে কল্পনা করাও কঠিন।
কেন্দ্রে উচ্চতার স্তরে যোগ্যতার ভিত্তিতে পোস্টিং পাওয়ার জন্য প্রতি বছর কেন্দ্র সরকার একটি তালিকা তৈরি করে যা কোথাও সরাসরি প্রকাশ করা হয় না। কেন্দ্রে পোস্টিংয়ের জন্য ভারত সরকার কর্তৃক তৈরি তালিকায় তাদের বিবেচনা বা অনুমোদনের আগে অফিসাররা তাদের সম্মতি লিখিতভাবে প্রকাশ করার সুযোগ পায় । এই প্রক্রিয়া সবসময়ই প্রথাগত ছিল । এখন কি এই তালিকা অন্তর্ভুক্ত করার প্রথা চিরতরে বিলুপ্ত করা হবে? কর্মক্ষমতার ওপর নির্ভর করে উচ্চ পদে নির্বাচনের কোনও প্রক্রিয়া হবে না?
আরও পড়ুন-প্রথম দফায় ১৫৯ প্রার্থীর নাম ঘোষণা সমাজবাদী পার্টির
কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশ অনুসারে এবং কয়েক দশক ধরে বর্তমান বিদ্যমান ব্যবস্থা অনুসরণ করা হয়। এখন কী কারণে সংশোধনী প্রস্তাবের দ্বারা এই প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনা হচ্ছে? এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকার কি এককভাবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে? এতদিন রাজ্যের কোনও আধিকারিককে কেন্দ্রীয় ডেপুটেশনে যেতে হলে রাজ্যের সম্মতি বাধ্যতামূলক ছিল কিন্তু বর্তমান সংশোধনীর দরুন সেটা কি আর নিষ্প্রয়োজন? সংশোধনের প্রস্তাবনা এক কথায় সংবিধানের বুনিয়াদি কাঠামোর চরম পরিপন্থী। এটি কো-অপারেটিভ ফেডারেলিজমের চেতনাকে যথেষ্ট উপেক্ষা করে সংবিধানের উপরেই স্পষ্ট আঘাত স্বরূপ এবং কেন্দ্র রাজ্য সম্পর্কের চিরস্থায়ী ক্ষতির সমূহ সম্ভাবনাপূর্ণ।
যে বিষয়টি খুব হালকা ভাবে নেওয়া হয়েছে সেটা হল অল ইন্ডিয়া সার্ভিস অফিসাররা সমস্ত রাজ্য সিভিল সার্ভিস এবং অত্যাবশ্যক বিভাগের অন্তর্গত অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ক্যাডারগুলির সঙ্গে রাষ্ট্রযন্ত্রের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ যেখানে এই সংশোধন প্রক্রিয়ার ফলে রাজ্যগুলির প্রশাসনিক কেন্দ্র প্রতিকূলভাবে প্রভাবিত হবে। একটিকে অন্যটি থেকে আলাদা করার ফলে কার্যত জনগণের সেবা করার জন্য রাজ্যগুলির উদ্যোগে সঙ্কটজনকভাবে বিচ্ছিন্নতা ঘটবে। সমগ্র প্রশাসনিক যন্ত্রের সততা ও সমন্বয় বজায় রাখা অত্যন্ত প্রয়োজন।