রাজ্যের কর্তৃত্ব খর্বের পরিকল্পিত চক্রান্ত

এই ধারণার মধ্যে একটি অন্তর্নিহিত দুর্বলতা রয়েছে কারণ আইনি এবং প্রশাসনিক জটগুলি দৈনন্দিন কাজকর্মে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে।

Must read

আই এ এস ক্যাডার বিধির সংশোধন যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোতে আঘাত। ইচ্ছাকৃতভাবে এটা করা হচ্ছে। লিখছেন প্রাক্তন সাংসদ ও রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যসচিব মণীশ গুপ্ত

সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে গিয়ে আরও ভাল পরিষেবা প্রদানের উদ্দেশ্যে এবং সমাজের সার্বিক উন্নয়নের খাতিরে পরিকল্পিত পরিকাঠামো তথা ভবিষ্যতের প্রয়োজনগুলির মূল্যায়ন এবং পরিকল্পনা করার জন্য রাজ্য সরকারগুলিকে গুরুদায়িত্ব সংবিধানে দেওয়া আছে। সামাজিক পরিবর্তন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন হল অগ্রাধিকারের ক্ষেত্র যার জন্য প্রশাসনিক আধিকারিকদের সমন্বয়ে ক্রমাগতভাবে প্রগতিশীল কর্মসূচি অনুযায়ী নিত্য-নতুন ভাবে সাজিয়ে সক্রিয় থেকে পরিকল্পনা রূপায়ণ করতে হয়। এই সংশোধনের প্রস্তাবনা বস্তুত সংবিধান দ্বারা গ্যারান্টিযুক্ত রাজ্যের কর্তৃত্বকে বিনষ্ট করার জন্য একটি পরিকল্পিত চক্রান্ত বলেই মনে হচ্ছে।
মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট এসআর বোমাই বনাম কেন্দ্রীয় সরকার, ১৯৯৪-এ বিচার মামলায় রায় দিয়েছেন যে, “রাজ্যগুলির একটি স্বাধীন সাংবিধানিক অস্তিত্ব রয়েছে এবং জনগণের রাজনৈতিক, সামাজিক, শিক্ষাগত এবং সাংস্কৃতিক জীবনে তাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। রাজ্যগুলি কেন্দ্রের উপগ্রহ বা এজেন্ট নয়। আদালত রায় দিয়েছেন যে ফেডারেল নীতি হল সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর একটি অংশ যা এমনকি কোনো সাংবিধানিক সংশোধনী থেকেও দায়মুক্ত।

আরও পড়ুন-আমরা বুড়ো হই কেন

পশ্চিমবঙ্গের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অত্যন্ত জোরালোভাবে বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরেছেন এবং প্রস্তাবিত সংশোধনীর বিরুদ্ধে তার ‘‘দৃঢ় অননুমোদন” সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করেছেন কারণ সংশোধন প্রস্তাবনা পুরোপুরি যুক্তরাষ্ট্রীয় চেতনার বিরুদ্ধে। তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে এক সপ্তাহের মধ্যে দুবার চিঠি লিখেছেন, শেষটি ২০ জানুয়ারী, ২০২২ তারিখ। মুখ্যমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীকে প্রস্তাবটি বাতিল করার জন্য অনুরোধ করেছেন কারণ এই সংশোধনগুলি রাজ্যের প্রশাসনকে বিরূপভাবে ক্ষতি করবে। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন যে এই প্রস্তাবিত সংশোধনীর একটি সংশোধিত খসড়া ইঙ্গিত দেয় যে, এটি প্রাথমিক প্রস্তাবগুলির চেয়ে অনেক বেশি হটকারী। আমাদের শক্তিশালী যুক্তরাষ্ট্রীয় রাজনীতির ভিত্তি এবং ভারতের সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর উপর গুরুতরভাবে আঘাত করবে। তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন যে এই ক্ষমতাগুলি আসলে কেন্দ্রীয় সরকার কোনও আইএএস আধিকারিককে তাঁর সম্মতি না নিয়ে বা রাজ্য সরকারের সম্মতি ও অনুমোদন ছাড়াই রাজ্যের বাইরে সরানোর স্বাধীনতা অযৌক্তিকভাবে ব্যবহার করবে। গুরুত্বপূর্ণভাবে, সংশোধনীটি একতরফাভাবে রাজ্য সরকারকে বাধ্যতামূলক করে যে সেন্ট্রাল ডেপুটেশন রিজার্ভের অধীনে নির্ধারিত সংখ্যক কর্মকর্তাকে ডেপুটেশনের জন্য উপলব্ধ করতে। এটা সম্পূর্ণভাবে অগ্রহণযোগ্য।

আরও পড়ুন-নিরাপত্তার মোড়কে উত্তরবঙ্গ

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে পরামর্শ আদান-প্রদানের পারস্পরিক বিষয়টি বিবেচনা করার জন্য অনুরোধ করে বলেছেন, বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থা একতরফা বা একপক্ষ দ্বারা প্রতিস্থাপিত হওয়া উচিত নয়। রাজ্যগুলি হল স্থানীয় প্রয়োজনের সেরা বিচারক। সেহেতু কার্যকরীভাবে স্থানীয় সমস্যাগুলি মোকাবিলা করার জন্য সিদ্ধান্ত নিতে সামঞ্জস্যপূর্ণ বাস্তবধর্মী প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা তৈরির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধির পাশাপাশি উপযুক্ত প্রতিভাকে কাজে লাগানো হল রাজ্যগুলির অন্যতম কাজ।

পাঞ্জাব রাজ্য এবং অন্যান্য বনাম ইন্দর সিং মামলায় ১৯৯৭ সালে মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছেন যে, ‘‘নিযুক্ত ব্যক্তির সম্মতি ছাড়া কোনও ডেপুটেশন হতে পারে না…”। বিজ্ঞাপিত রাজ্য ক্যাডার থেকে একজন কর্মকর্তাকে নির্বাচনী ভিত্তিতে ধার করার জন্য বাধ্য করা যাবে না। প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী অফিসাররা রাজ্যে কাজ করার সময়কালে সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারই হল ক্যাডার কন্ট্রোলিং অথরিটি।
এই ধরনের সংশোধনী পদক্ষেপগুলি সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলিকে চূড়ান্ত যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো বহির্ভূত পদ্ধতিতে নিয়ে যাওয়ার জন্য অফিসারদের মনোবল নষ্ট করবে এবং রাজ্য সরকারগুলির নিয়ন্ত্রণ খর্ব করবে। মুখ্যমন্ত্রী তার চিঠিতে বলেছেন যে এটি অল ইন্ডিয়া সার্ভিসগুলোর মৌলিক নীতিকে ধ্বংস করবে। আরও উল্লেখ্য, অল ইন্ডিয়া সার্ভিস অফিসারদের দায়বদ্ধতা শুধুমাত্র সেই রাজ্য সরকারের কাছেই যেখানে তারা কর্মরত।

আরও পড়ুনপাঠ্যসূচিতে দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নেতাজির হারানো ইতিহাস তুলে ধরার দাবি শিক্ষামন্ত্রীর

মুখ্যমন্ত্রী, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাঁর চিঠিতে সঠিকভাবেই বলেছেন, কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকা পার্টির অপব্যবহার ছাড়াও এই বিধানগুলি প্রশাসন এবং উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় অস্থিতিশীলতা এবং অনিশ্চয়তার কারণ হবে। আমলাতন্ত্রের নির্ভীক কার্যপ্রণালী এবং আমাদের দেশে গণতন্ত্রকে মূল্য দেওয়ার প্রক্রিয়া পুরোপুরি উল্টে যাবে।
স্বরাজ অভিযান বনাম কেন্দ্রীয় সরকার ২০১৮, মামলায় মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট সমবায় ফেডারেলিজমকে ‘‘অভীষ্ট সাংবিধানিক লক্ষ্য” হিসাবে বর্ণনা করেছেন। রাজ্যগুলির প্রশাসনিক ব্যবস্থায় প্রতিষ্ঠিত এবং এই বিশ্বস্ত ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করা ভবিষ্যতের জন্য প্রশাসনিক পরিকল্পনা গ্রহণের জন্য রাজ্যগুলির ক্ষমতাকে অপূরণীয়ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। আধিকারিকদের মনোবল হ্রাস পাবে কারণ তাদের কেন্দ্রের দ্বারা শাস্তিমূলক ডেপুটেশনের আদেশ দেওয়া হতে পারে।

আরও পড়ুন-৭ই ফেব্রুয়ারী থেকে শুরু ‘পাড়ায় শিক্ষালয়’ প্রকল্প

এই ধারণার মধ্যে একটি অন্তর্নিহিত দুর্বলতা রয়েছে কারণ আইনি এবং প্রশাসনিক জটগুলি দৈনন্দিন কাজকর্মে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে। রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ হয়ে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের যারা মেরুদন্ড তাদের কাছে কী বার্তা যাবে? এটি প্রশাসনিক পরিষেবার স্বাধীন কার্যপ্রণালী এবং নিরপেক্ষ দায়িত্বকে ক্ষতিকরভাবে প্রভাবিত করবে।
একতরফা ডেপুটেশন আদেশের বিষয়টি রাজ্য এবং কেন্দ্রের মধ্যে পক্ষ বেছে নিতে বাধ্য করতে পারে। যে দেশে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা সাংবিধানিক পরিকল্পনায় নিহিত রয়েছে সেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের যেকোনও রকম একতরফা সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। যখন ইতিহাসের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং সময়ের ভেতর দিয়ে আমরা যাচ্ছি তখন আমাদের গণতন্ত্রের জন্য এই ধরণের সংশোধনগুলি খুবই উদ্বেগজনক লক্ষণ বহন করে।

আরও পড়ুন-করোনা আক্রান্ত প্রাক্তন ফুটবলার সুরজিৎ সেনগুপ্ত, ভর্তি হাসপাতালে 

প্ল্যানিং কমিশনের পরিকল্পিতভাবে বিলোপ ঘটানোর পরে, রাজ্যগুলি একটি সময়-পরীক্ষিত মঞ্চ হারিয়েছে যেখানে উদীয়মান গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি নিয়ে কেন্দ্রের সঙ্গে আলোচনা করা যেতে পারত। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বারবার সংবিধানের অধীনে একটি বিধিবদ্ধ সংস্থা ‘‘জাতীয় উন্নয়ন পরিষদের” পুনরুজ্জীবনের জন্য চাপ দিয়েছেন। তুলনামূলকভাবে বর্তমানের নীতি আয়োগ সংস্থার কোনও সাংবিধানিক স্বীকৃতি নেই, আর্থিক ক্ষমতাও নেই। এই সময় প্ল্যানিং কমিশন না থাকার অভাব নিদারুনভাবে অনুভূত হচ্ছে। আইএএস ক্যাডার বিধিতে প্রস্তাবিত সংশোধনীগুলির বিষয়ে পার্থক্যগুলি সমস্ত রাজ্যের দ্বারা সেখানে অনায়াসে আলোচনা করা যেতে পারত। তা না করে কেন্দ্র একতরফা সিদ্ধান্ত নেওয়ার পথে হাঁটছে।
এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় সরকারের উচিত সুবুদ্ধির সঙ্গে প্রগতিশীল চিন্তা ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রস্তাবিত সংশোধনীগুলি নিয়ে অগ্রসর না হয়ে কেন্দ্র-রাজ্য পারস্পরিক সুস্থ সম্পর্ক মেনে রাজ্যগুলির সঙ্গে সংঘর্ষের পথ পরিহার করা। কিন্তু সে শুভ বিদ্ধির উদয় আদৌ হবে কি না সেটাই এখন অর্বুদ টাকার প্রশ্ন

Latest article