অতই যদি ন্যায়পরায়ণ তবে কোন ন্যায়ের বলে আনন্দ বোস এখনও রাজভবনে?

রাজ্যপাল মোদি জমানায় পদ্মপাল হবেনই। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোতে কুড়ুল তিনি মারবেনই। এসব জানা ছিল। কিন্তু এই রাজ্যপালের যেসব কীর্তি-কেলেঙ্কারি সামনে আসছে, আর সেসবের পরেও কেন্দ্রের নেতা-মন্ত্রীর দল যেরকম মুখে কুলুপ এঁটেছেন, তাতে স্পষ্ট, এই বিজেপি নারীর সম্মান নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে পছন্দ করে। এই বিজেপিকে একটি ভোটও দেবেন না। আহ্বান জানাচ্ছেন দেবলীনা মুখোপাধ্যায়

Must read

লোকটার নাম সি ভি আনন্দ বোস। নাম শুনে প্রথমে ভ্রম হয়েছিল, উনি বুঝি বাঙালি। প্রবাসী বাঙালি। অচিরেই জানা গেল, এ ‘বোস’ সে ‘বোস’ নয়। দক্ষিণ ভারতে নেতাজি ভক্ত পরিবারের মধ্যে সুভাষচন্দ্রের (বোস) নামে নাম রাখার প্রচলন আছে। ওই কারণেই তাঁর পদবি বোস। জেনে আমরা খুশি হয়েছিলাম।
প্রোফাইলটিও মন্দ নয়। তিনি প্রাক্তন আইএএস; প্রশাসনিক কাজে তাঁর দীর্ঘ অভিজ্ঞতা; পিএম মোদির ‘ম্যান অফ আইডিয়া’ হিসেবেই সুপরিচিত। তাঁর কিছু ভাবনা কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্পে ব্যবহৃত হয়েছে। বিশেষ করে দেশে সকলের জন্য পাকাবাড়ির ভাবনাটি তাঁর দেওয়া। কেরলের মুখ্যমন্ত্রীর সচিব এবং রাজ্যের বিভিন্ন দপ্তরের প্রধান সচিবেরও দায়িত্ব সামলেছেন তিনি। বোসের ঝুলিতে উজ্জ্বল শতাধিক পুরস্কার। সুবক্তা হিসেবেও তাঁর নামডাক রয়েছে। সুলেখক বোস কয়েকটি বেস্টসেলার গ্রন্থেরও রচয়িতা। জেনে আমরা আনন্দিত হয়েছিলাম।

আরও পড়ুন-রাজস্থান ম্যাচের আগে কামাখ্যা মন্দিরে বরুণ-রিঙ্কুরা

আসলে সময়টা ছিল বেয়াড়া রকমের। নভেম্বর, ২০২২-এর মাঝামাঝি সময়ে রাষ্ট্রপতি ভবন খবর দিল যে, রাজভবন থেকে সরছেন বিতর্কিত জগদীপ ধনকড়। ইনি হলেন সেই রাজ্যপাল যিনি নির্বাচিত রাজ্য সরকারকে শান্তিতে কাজ করতে দিচ্ছিলেন না। প্রধান বিরোধী দল বিজেপির ধ্বংসাত্মক রাজনীতি রাজভবনের লাগাতার মদত পাচ্ছিল। রাজভবনটাই বকলমে হয়ে উঠেছিল বঙ্গ বিজেপির প্রধান কার্যালয়! তাতে বরবাদ হয়ে যেতে বসেছিল যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা এবং বাংলায় উন্নয়ন প্রক্রিয়া। ধনকড়ের একপেশে ‘রাজনৈতিক’ কর্মকাণ্ড নিয়ে তখন নিন্দার ঝড় প্রবল আকার নিয়েছে। এইরকম একটা আবহে বোসের নিয়োগ এসেছিল বাংলায়। তাই-ই এক চিলতে খুশি, দুই চুমুক আনন্দ।
বোস রাজ্যপাল পদে এসে নবান্ন এবং রাজভবনের মধ্যে সংবিধানসম্মত সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ রচনার সদিচ্ছা ব্যক্ত করেন একাধিকবার। অতঃপর, বাংলার ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতিও তাঁর অনুরাগের প্রকাশ ঘটে। এমনকী তিনি দাবি করেন, গড়গড়িয়ে বাংলা বলা শিখতে চান। মুখ্যমন্ত্রীও সেই ডাকে সাড়া দিতে বিলম্ব করেননি। ২৬ জানুয়ারি আমাদের সাধারণতন্ত্র দিবস। ২০২৩-এ আবার সেদিনই পড়েছিল সরস্বতী পুজো। এই জোড়া শুভদিনে রাজভবনের প্রশস্ত লনে বেশ ঘটা করেই হাতেখড়ি হয় রাজভবনের নতুন কর্তার। সরস্বতী পুজো বাংলার বিদ্যানুরাগী সমাজের কাছে একটি পরম আদরণীয় সংস্কৃতি। বোসের নাম-পরিচয়ের ভিতরেও সুপ্ত বঙ্গসংস্কৃতির প্রতি বিশেষ প্রীতি। অতএব, রাজ্যপালের হাতেখড়ি সেদিন বেশ মানানসই মনে হয়েছিল সকলের। কিন্তু অল্পদিনেই খোলসা হয়ে গেল যে, বোস এবং ধনকড়ে তফাত সামান্যই। বরং বোস রাজভবনকে সামনে রেখে এমন ধারার ‘রাজনীতি’ চালু করলেন যাতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দ্রুত বলতে বাধ্য হলেন যে, ‘এই রাজ্যপাল ধনকরের চেয়েও সাংঘাতিক!’

আরও পড়ুন-দুইয়েই চোখ সানরাইজার্সের, ঘরের মাঠে পাঞ্জাব কিংস ম্যাচ

বাস্তবে রাজভবন যে দিনের শেষে ‘কেন্দ্রের এজেন্টের’ ভূমিকাতেই অবতীর্ণ হয়, সেটি একটি সর্বজ্ঞাত বিষয়। যেসব রাজ্যে কেন্দ্রীয় শাসকের বিরোধী কোনও দলের সরকার বহাল, সেখানে এই সংস্কৃতির অনুশীলনে কোনও ফাঁকফোকর রাখা হয় না, এটাও মোদি জমানায় সবাই জেনে গেছে। এ তো গেল কেন্দ্র-রাজ্য রাজনৈতিক সংঘাতের দিক। এদিক থেকে আনন্দ বোসের কাজকর্ম আপত্তিকর হলেও সেই অর্থে চমকপ্রদ ছিল না।
কাহিনীতে ট্যুইস্ট আসল আনন্দের অন্যসব অপকীর্তির সুবাদে। কলকাতার রাজভবন আমাদের সকলকে অবাক এবং আহত করল অন্য একাধিক মারাত্মক অভিযোগকে কেন্দ্র করে। যৌন হয়রানির অভিযোগ।
কোনও একজন বিশিষ্ট নৃত্যশিল্পী, একজন অত্যন্ত গুণী মহিলা, তিনি গুরুতর অভিযোগ করেছিলেন। সেই রিপোর্টটি প্রশাসনিকভাবে পাঠানো হয়েছিল। বিবাহ বিচ্ছেদ সংক্রান্ত মামলায় সহায়তার আশ্বাস দিয়ে নৃত্যশিল্পীকে ধর্ষণের অভিযোগ। নয়াদিল্লির একটি হোটেলে তাঁকে ধর্ষণ করা হয় বলে অভিযোগ। নয়াদিল্লিতে পাঁচতারা হোটেলের রুমও বুক করে দিয়েছিলেন রাজ্যপালের এক আত্মীয়। সেবার বঙ্গভবনে উঠেছিলেন রাজ্যপাল। তারপর সেখান থেকে রক্ষী ছাড়়াই তিনি চলে যান ওই হোটেলে। সেখানেই ওই নৃত্যশিল্পীকে ধর্ষণ করেন বলে অভিযোগ। নবান্নে রাজ্যপালের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়েছিলেন ওই শিল্পী। এরপর সেই অভিযোগ পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল লালবাজারে।

আরও পড়ুন-মুক্ত অপরাধীকে মূলস্রোতে ফেরাচ্ছে প্রশাসন

এর পর ক’দিন আগে রাজভবনের মধ্যে এক মহিলা কর্মীকে শ্লীলতাহানি করার অভিযোগ উঠেছিল রাজ্যপালের বিরুদ্ধে। এনিয়ে সিসি ক্যামেরার ফুটেজও সামনে এনে সত্যের মুখোমুখি হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন রাজ্যপাল। কিন্তু সেই ফুটেজ আদৌ কতটা সত্যকে সামনে এনেছে সেই প্রশ্নটা থেকেই গিয়েছে। বারবার একই ধরনের অভিযোগ আসছে রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধানের বিরুদ্ধে, এটা উদ্বেগের। এভাবে একের পর এক অভিযোগের জেরে রাজভবনের গরিমা কতটা রক্ষিত হচ্ছে সেই প্রশ্ন তো থেকেই যাচ্ছে। আচার্য তথা রাজ্যপাল বিধিবহির্ভূতভাবে রাজ্যের উচ্চশিক্ষাকে ধ্বংস করছেন। পড়ুয়াদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। তার মধ্যে এইসব অসভ্যতা।
এই রাজ্যপালের নিজের পদে থাকার অধিকার নেই আর।
রাজভবন থেকে আনন্দ বোস বিদায় হও।

Latest article