ইউরিক অ্যাসিড বাড়লে

দৈনন্দিন জীবনে ইউরিক অ্যাসিডজনিত বাতের সমস্যার শিকার অনেকেই। গেঁটে বাতের জন্য হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার কোনও বিকল্প নেই।

Must read

দৈনন্দিন জীবনে ইউরিক অ্যাসিডজনিত বাতের সমস্যার শিকার অনেকেই। গেঁটে বাতের জন্য হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার কোনও বিকল্প নেই। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন এই চিকিৎসা গেঁটে বাতের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে পারে সহজে। জানালেন সিনিয়র সুপার স্পেশ্যালিস্ট হোমিওপ্যাথ এবং ওয়ার্ল্ড ফেডেরেশন অফ হোমিওপ্যাথির আন্তর্জাতিক সভাপতি ডাঃ প্রকাশ মল্লিক। লিখছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

আরও পড়ুন-স্বামী বিবেকানন্দ স্কলারশিপ সম্বন্ধে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য

দৈনন্দিন জীবনে ইউরিক অ্যাসিড বেড়ে যাওয়া শব্দটার সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত। অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, নিয়মানুবর্তিতার অভাব, ভুল খাদ্যাভ্যাস, অতিরিক্ত ওজন— এইসবের কারণে দিনে দিনে বেড়ে চলেছে ইউরিক অ্যাসিডের সমস্যা। ইউরিক অ্যাসিডের বাড়াবাড়ির ফলে গেঁটে বাতের কারণে বহু মানুষ শয্যাশায়ী পর্যন্ত হয়ে যান। গবেষণা অনুযায়ী বিশেষজ্ঞের পরিসংখ্যান বলছে প্রায় সাড়ে চার কোটি মানুষ গোটা বিশ্বে ইউরিক অ্যাসিডজনিত রোগে আক্রান্ত। ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বাড়লে তাকে বলে হাইপারইউরিসেমিয়া। আমাদের দেহে পটাশিয়াম, সোডিয়াম, বাইকার্বনেট বা অ্যালকালাইনের ভারসাম্য রক্ষায় ইউরিক অ্যাসিডের ভূমিকা রয়েছে। ইউরিক অ্যাসিডের কারণে মূলত যেটা হয় তা হল বাতের ব্যথা। বিশেষত গেঁটে বাত যাকে বলে গাউট।

আরও পড়ুন-বিজেপির বিরুদ্ধে একসঙ্গে লড়াই

কেন হয়
আমাদের শরীরে যেসব বিপাকীয় ক্রিয়া বা মেটাবলিজম চলে তার ফলে উৎপন্ন হয় বিভিন্ন বর্জ্য যেমন কার্বন ডাই অক্সাইড, নাইট্রোজেন জাতীয় পদার্থ। অপরদিকে লবণ ও প্রোটিনের বিপাকক্রিয়ার ফলে নাইট্রোজেন জাতীয় বর্জ্য পদার্থ যেমন অ্যামোনিয়া, ইউরিয়া, ইউরিক অ্যাসিড ইত্যাদি উৎপন্ন হয়। এই ইউরিক অ্যাসিড জমা হয়ে সৃষ্টি হয় একধরনের আথ্রাইটিস বা গ্রন্থির ব্যথা। গাঁটে-গাঁটে ব্যথা হয় বলে একে গেঁটে বাতও বলে। এই ইউরিক অ্যাসিড যেমন বিপাক ক্রিয়ার গোলযোগের ফলেও হতে পারে ঠিক তেমনই পিউরিন থেকেও হতে পারে। কিছু কিছু খাবারে পিউরিন নামক একটি পদার্থ রয়েছে।

আরও পড়ুন-ফের হার ইস্টবেঙ্গলের, বাগানের ডার্বি উৎসর্গ চুনীকে

প্রোটিন বিক্রিয়ার ফলে পিউরিন এবং তার নিউক্লিক অ্যাসিড ভেঙে আমাদের শরীরে ইউরিক অ্যাসিড তৈরি হয়। এই অ্যাসিড রক্তে দ্রবীভূত হয়ে মল-মূত্রের মাধ্যমে বর্জ্য পদার্থ হয়ে বেরিয়ে যাবারই কথা। কিন্তু বেশি জমলে তখন এই অ্যাসিড রক্তে দ্রবীভূত হতে পারে না এবং তা শরীরে গাঁটে-গাঁটে জমে যায়। বিভিন্ন পেশিতে, সন্ধিবন্ধনীতে, কার্টিলেজে ক্ষুদ্র দানাদার নুন বা স্ফটিক আকারে জমতে থাকে এবং বাতের ব্যথার সৃষ্টি হয়। ইউরিক অ্যাসিডের বাড়াবাড়িতে হাড় ক্ষয় হয়, কিডনিতে পাথরও জমে যেতে পারে।

আরও পড়ুন-ধেয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড়, হবে ভারী বৃষ্টি

ইউরিয়া, ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। যাঁরা প্রাণীজ প্রোটিন বেশি খান যেমন, রেড মিট, গরুর মাংস তাঁদের ইউরিক অ্যাসিড বেশি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। মেটে চিংড়ি, কাঁকড়া, মাছের ডিম বেশি খেলেও ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বাড়ে। যাঁরা অতিরিক্ত মদ্যপান করেন বা বিয়ার খান তাঁদের ইউরিক অ্যাসিড হওয়ার সম্ভাবনা থাকে খুব বেশি। টম্যাটো, মুসুর ডাল, পালংশাক, পুঁইশাক, রেড মিট— এই সব খাবারেই পিউরিন থাকে। ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা ৩.৪ এমজি থেকে ৬ অথবা ৭ এমজি–র উপরে হলেই তা জমতে শুরু করে এবং প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। এর পাশাপাশি বিভিন্ন অসুখ থেকেও ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। যেমন, শুগার, হাই ব্লাডপ্রেশার, উচ্চমাত্রায় কোলেস্টেরল ট্রাইগ্লিসারাইড ইত্যাদি থাকলে ইউরিক অ্যাসিড বাড়ার সম্ভাবনা থাকে।

আরও পড়ুন-ওয়ার্ডের বাসিন্দাই এজেন্ট

লক্ষণ কী
ইউরিকের অ্যাসিডের মূল লক্ষণ হল গাঁটে-গাঁটে ব্যথা। অনেক সময় বুড়ো আঙুলের গোড়া লাল হয়ে ফুলে যায়। হাঁটু, গোড়ালি, পায়ের অস্থিসন্ধি, হাত, কনুই থেকে শুরু করে কবজি, আঙুলের গাঁটে-গাঁটে ব্যথা হয়।
অনেকের অজান্তে ইউরিক অ্যাসিড বেড়ে গেলে কিডনিতে স্টোন ফরমেশন হয়। ইউরিনে অবস্ট্রাকশন আসে। তখন ডায়গনোসিস করলে অনেক সময় ইউরিক অ্যাসিড ধরা পড়ে। তবে সবসময় গাঁটে-গাঁটে ব্যথা ইউরিক অ্যাসিডের কারণে হয় না। অন্য ধরনের বাতের কারণেও হয়। ডায়গনোসিস করলে ধরা পড়ে কী কারণে ব্যথা হচ্ছে। তাই গাঁটে-গাঁটে ব্যথা হলে অবশ্যই পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া দরকার।

আরও পড়ুন-তৃণমূলের নামে টাকা তোলার অভিযোগ

কী খাবেন
ইউরিক অ্যাসিড বাড়লে সুস্থ থাকার যে দিকটায় বিশেষ নজর দেওয়া দরকার তা হল খাদ্য। কিশমিশ, আঙুরের মধ্যে ইউরিক অ্যাসিড কমানোর সামর্থ্য রয়েছে। শুধু ইউরিক অ্যাসিডই নয় আথ্রাইটিস, গাউট বা যে কোনও ধরনের বাতজনিত সমস্যায় ভুগছেন যাঁরা তাঁদের ক্ষেত্রে আঙুর এবং কিশমিশ খুব উপকারী। সাধারণ আঙুরের তুলনায় শুষ্ক আঙুর অর্থাৎ কিশমিশ আরও বেশি ভাল। কারণ কিশমিশের মধ্যে বেশি ক্ষারীয় ধর্ম বর্তমান এবং শরীরের জন্য এতে প্রয়োজনীয় মিনারেলসও রয়েছে। আর আছে কপার, ম্যাঙ্গানিজ, পটাশিয়াম, সোডিয়াম ও অ্যালবুমিন। তবে সোডিয়াম আর অ্যালবুমিনের পরিমাণ একটু কম থাকে।

আরও পড়ুন-কুয়াশা যখন… বিপজ্জনক

এক গ্লাস ঠান্ডা জলে তিন চারটে কিশমিশ ধুয়ে ভিজিয়ে রাখুন। পরের দিন সকালে ওই কিশমিশ ভেজানো জল আর কিশমিশ সমেত খেয়ে নিন। এর ফলে শরীরের সব বর্জ্য পদার্থ-সহ অপ্রয়োজনীয় বিষাক্ত বস্তু বেরিয়ে যাবে। ইউরিক অ্যাসিড কমাতে এই পথ্য খুব কার্যকরী। শুধু তাই নয়, কিডনি এবং লিভারের কার্যকারিতাকে সক্রিয় রাখতে, রক্তাল্পতায় কিশমিশের অবদান অপরিসীম।

যে কোনও বাত, সন্ধিবাত, গাউটের জন্য মধু খুব উপকারী। ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা হ্রাস করতে মধুর ব্যবহার খুব প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। সন্ধ্যাবেলা দু চামচ লেবর রসে মধু মিশিয়ে খেলে ইউরিক অ্যাসিডের সমস্যা কম হবে। তবে যাঁদের শুগার রয়েছে তাঁরা মধু খাবেন না।
হালকা গরম জলে আধচামচ হলুদগুঁড়ো মিশিয়ে দিনে দু’বার খেলে ইউরিক অ্যাসিডে খুব উপকার মিলবে।

এক কী দু’কোয়া রসুন ঘি বা মাখনে ভেজে ওই রসুন থেঁতো করে বা পেস্ট করে রোজ খেলে খুব ভাল ফল পাওয়া যাবে।
বেগুন পুড়িয়ে ভাত দিয়ে সপ্তাহে তিন-চারদিন খেলে ইউরিক অ্যাসিডে খুব উপকার পাবেন।
ইউরিক অ্যাসিডজনিত ব্যথা দেহের যে-যে সন্ধিস্থলে হয়, সেইসব জায়গায় বা জয়েন্টে গুঁড়োহলুদ মাখিয়ে রাখলে ব্যথার উপশম হবে।
ম্যাগনেশিয়াম সালফেট হালকা গরম জলে মিশিয়ে নিয়মিত স্নান করলে ইউরিক অ্যাসিডের সমস্যা অনেকটা কমবে।
কাঁচা আলুর রসে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা ঠিক রাখতে সাহায্য করে। সবরকমের বাতে আলুর রস খুব কার্যকরী। তবে কারও যদি আলুর রসে অ্যালার্জি থাকে তাঁর আলুর রস খাওয়া যাবে না।

আরও পড়ুন-কটাক্ষ ডেরেকের

প্রতিদিন তিনশো মিলিলিটার গাজরের রস খেলে ইউরিক অ্যাসিডের সমস্যা কমবে। ব্যথা প্রশমিত হবে।
আপেল ইউরিক অ্যাসিডের জন্য খুব উপকারী। আপেলের মধ্যে রয়েছে সাইলিসিক অ্যাসিড যা ইউরিক অ্যাসিডজনিত ব্যথা কমায়।
সকালে একগ্লাস জলে অর্ধেক লেবুর রস মিশিয়ে নিয়মিত খেলে গাঁটে-গাঁটে জমে থাকা ইউরিক অ্যাসিড থেকে খুব উপকার মিলবে। কমলালেবুর রসও ইউরিক অ্যাসিডের জন্য খুব উপকারী।

আরও পড়ুন-দিল্লি দূষণ: আবার সুপ্রিম তোপে কেন্দ্র

ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা যখন বেড়ে যায় তখন গাঁটের ব্যথাও বেড়ে যায়৷ এই অবস্থায় পেয়ারা খেলে গাঁটের ব্যথা প্রশমিত হয়। ইউরিক অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম পেয়ারা।
ইউরিক অ্যাসিডে রুইমাছ খাওয়া নিরাপদ কারণ, রুই মাছই একমাত্র যা অ্যাসিডিক নয়। অন্য সব মাছে অ্যাসিডিক ব্যাপার থাকে। সাধারণভাবে বলতে গেলে ইউরিক অ্যাসিডে প্রোটিন কম খাওয়া আবশ্যক। এর পাশাপাশি মুসুর ডাল খাওয়া একেবারেই নিরাপদ নয় এমনকী মুসুর ডালের জল খাওয়াও উচিত নয়।
ফলের মধ্যে আনারস, সবজির মধ্যে কুমড়ো, পেঁপে ইত্যাদি খেলে ইউরিক অ্যাসিডের রোগী খুব ভাল থাকবে। এর সঙ্গে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা নিলে ভাল হবে।

পার্শপ্রতিক্রিয়াহীন ভাবে এই রোগ প্রতিরোধ করতে সক্ষম হবে হোমিওপ্যাথি ওষুধ। যাঁদের পরিবারে ইউরিক অ্যাসিডের ইতিহাস রয়েছে তাঁরা আগে ভাগে সতর্ক হলে এই রোগ নিয়ে ভুগতে হবে না।
পর্যাপ্ত পরিমাণে জল ইউরিক অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। দিনে ১০ থেকে ১২ গ্লাস জল খান।

চিকিৎসা
ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা কমাতে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা খুব ফলপ্রসূ। ইউরিক অ্যাসিডের যেসব ওষুধ আধুনিক বিজ্ঞানে আছে, সেগুলোর কিছু কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে বলে শোনা যায়। কিন্তু যদি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা নেওয়া যায় তা হলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন ভাবে রোগ সারিয়ে ফেলা সম্ভব। হোমিওপ্যাথিতে কোনও নির্দিষ্ট রোগের নির্দিষ্ট চিকিৎসা হয় না। কারণ, লক্ষণ এবং মায়াজম (এক ধরনের হোমিওপ্যাথিক থিওরি, যেটা অনুযায়ী চিকিৎসা হয়) এর উপর ভিত্তি করে চিকিৎসকেরা চিকিৎসা করেন। হোমিওপ্যাথির যেসব ওষুধে ইউরিক অ্যাসিডে কার্যকরী ফল পাওয়া যায় সেগুলো হল রাসটাক্স, ক্যালকেরিয়া কার্ব, ন্যাফেলিয়াম, লিথিয়াম কার্ব, অস্টিওআর্থ্রাইটিস নোসড, ম্যাগফস, জ্যাকেরেন্ডা ইত্যাদি। তবে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কখনই এইসব ওষুধ খাবেন না।

আরও পড়ুন-শরদ-আদিত্যর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তরুণ শিল্পোদ্যোগীদের আহ্বান জানাবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়

ব্যায়াম
ঘুম থেকে উঠেই সরাসরি বিছানা থেকে নেমে পড়বেন না। দেহকে ওয়ার্মআপ করে নিয়ে তারপর পা সোজা টান টান করে নিন। এবার মাটিতে পা রাখুন।
স্ট্রেচিংয়ের কিছু এক্সারসাইজ করুন। পা সোজা করে পায়ের পাতা সামনে টান করুন এবং ভিতর দিকে টানুন। এইভাবে দু’পায়ে করুন। হাঁটু স্ট্রেচ করুন।

রোজ মর্নিংওয়াক করুন বা বাড়ির ছাদেই হাঁটুন ঘড়ি ধরে। জগিং করুন। ফ্রি-হ্যান্ড এক্সারসাইজ করুন। সাইকেলিং বা নাচ খুব ভাল ব্যায়াম ইউরিক অ্যাসিডের জন্য। সাঁতার কাটতে পারেন সপ্তাহে দু’দিন।
মেঝেতে না বসাই ভাল। উঁচু জায়গায় বসুন। একটানা দাঁড়িয়ে বা বসে কোনও কাজ করবেন না। হাঁটাচলার মধ্যে থাকুন।
হিল রাইস করুন। দরজা চৌকাঠের উপর দাঁড়িয়ে দরজার মাথা ধরে গোড়ালি উপর দিকে তুলুন।
সোজা হয়ে সামনের দিকে পা-জোড় করে বসুন, হাত দিয়ে পায়ের পাতা ধরার চেষ্টা করুন। তিরিশ সেকেন্ড ধরে ছেড়ে দিন।

Latest article