আজ বিশ্ব বাঁশ দিবস, আন্তর্জাতিক ভাবে বলতে গেলে ‘ওয়ার্ল্ড ব্যাম্বু ডে’। ২০০৯ সালে ব্যাঙ্ককে অনুষ্ঠিত অষ্টম বিশ্ব বাঁশ কংগ্রেসে, বিশ্ব বাঁশ সংস্থার প্রাক্তন সভাপতি মাননীয় কামেশ সালাম মহাশয় বাঁশ শিল্পের সংরক্ষণ, প্রচার ও প্রসার এবং বাঁশ সম্পর্কে জনমানসে সচেতনতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ১৮ সেপ্টেম্বর দিনটিকে বিশ্ব বাঁশ দিবস হিসাবে ঘোষণা করেন।
আরও পড়ুন-সাহিত্য-আলোকে উদ্ভাসিত শারদোৎসব
মানবজীবনে ঘাস পরিবারের সর্ববৃহৎ এই সদস্যের গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহারের ঝুড়ি, কুলো থেকে শুরু করে আসবাবপত্র, ঘর সাজানোর নানান বাহারি উপকরণ এমনকী খাদ্যবস্তু হিসেবেও বাঁশ আমাদের জীবনে অত্যাবশ্যকীয় একটি উপাদান। এমন একটি উপাদেয় সামগ্রী, তবুও অবলীলায় বাঁশকে বদনাম দিয়ে বাঁশ খাওয়াতে আমরা একফোঁটাও পিছপা হই না। তার মূল কারণ যদিও বাঁশের প্রকারভেদ। আমাদের দেশে মোটামুটি প্রায় ১৪০ প্রজাতির বাঁশ পাওয়া গেলেও মানুষ দুই প্রকার বাঁশের সঙ্গেই অধিক পরিচিত, এক দৃশ্যমান বাঁশ আর দুই অদৃশ্য বাঁশ। প্রথমটি আমাদের জীবনে বহুল উপকারে ব্যবহৃত হলেও বাঁশের যত বদনাম ওই অদৃশ্য প্রজাতির বাঁশের জন্য, উপকার করেও উপকারী বাঁশের কপালে শুধুই বদনাম। আমার সুপুরের মামাবাড়িতে বাড়ি-বাড়ি কাঁধে করে, বাঁশের বাঁকে বনস্পতির জ্যারিক্যান বেঁধে জল দিয়ে যেত মুচিরাম নামের এক ব্যক্তি, এ হেন মুচিরামের এক মাত্র ঘরের খড়ের চাল এক কালবৈশাখীতে হঠাৎ করেই উড়ে গেল। মুচিরামের এমন বিপদের দিনে পুনরায় ঘরের ছাউনি মজবুত করে বাঁধার জন্য তার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ভালকি বাঁশের সাপ্লাই দিলেন মুচিরামের শ্বশুর। খবর অজয় মামার কানে আসতেই মুচিরামকে শুনিয়ে কেমন যেন একটু অন্যরকম সুর করে বললেন, ‘এই জ্যৈষ্ঠতে লোকের শ্বশুর আম-কাঁঠাল পাঠায়, আর মুচির শ্বশুর মুচিকে বাঁশ দিয়েছে!’
আরও পড়ুন-রেকর্ড পতন পাউন্ডে
প্রতিদিন আমাদের হাজার উপকার করলেও বাঁশ নামেই কেমন যেন একটা অস্বস্তি তার ওই অদৃশ্য ভার্সনটির জন্যই, যা নাকি দৃশ্যমান হয়ে ঝাড়ে হাওয়া খেলেও ডাকাডাকি করলে অদৃশ্য খোঁচায় রক্তপাত ঘটা একপ্রকার অবশ্যম্ভাবী। অথচ বাঁশ আমাদের কী কাজে লাগে না! ছোটবেলার প্রিয় বরফের গোলার চুষিকাঠি থেকে শুরু করে শেষযাত্রার বাঁশের দোলা— সবেতেই আমাদের জীবন বাঁশময়। প্রাচীরের এ-পার থেকে লোকের বাড়ির আম বা পেয়ারা, এক হ্যাঁচকায় হাতের মুঠোয় আনতে বাঁশের কঞ্চির আঁকশির জুড়ি মেলা ভার। শুধু তাই কেন মিছিলের ঝান্ডা থেকে প্রতিরোধের ডান্ডা— সবেতেই বাঁশের ভূমিকা ভোলার নয়। হাজার লোকের সমাগম, এর-ওর গায়ে পড়ে গুঁতোগুতি করে নাক ফাটাবার হাত থেকে বাঁচাতে সেই বাঁশেরই ব্যারিকেট ভরসা, প্রবল চাপে সেই বাঁশেরই পাঁজর ভাঙার মটমট শব্দ শুনে তবেই আমরা সতর্ক হই। আজকের দিনে এমন দধীচিমার্কা আত্মত্যাগের কাহিনি আর প্রায় নেই বললেই চলে।
আরও পড়ুন-মোদির জন্মদিনেই বিক্ষোভ গুজরাতে
সভা-সমিতি-সমাবেশ থেকে শুরু করে কলকাতার যাত্রার বিজ্ঞাপনে উদ্যোক্তাদের সগর্ব প্রচার, ‘মহিলাদের বসিবার ও সাইকেল বারিখবার সুবন্দোবস্ত আছে’, সেই কথা রাখতে আর কেউ না, বাঁশই সেই প্রধান ভরসা। শ্রীভূমির চোখ টাটানো ‘বুর্জ খলিফা’ কিংবা বড়জোড়া বাজারের মায়াপুর ইস্কন মন্দিরের জেরক্স কপি বানাতে ভরসা সেই এক ও অদ্বিতীয়ম বাঁশ, ওই সব প্যান্ডেল দেখতে যাওয়ার লাখো মানুষের ভিড় নিয়ন্ত্রণের পথটি তো সেই বাঁশ দিয়েই তৈরি, কই এমন উদাহরণ কি একটিও আছে যে, ওই লাখো মানুষের ভিড়ে বাঁশবাঁধা রাস্তা থেকে একটি বাঁশ হঠাৎ করেই কারও পশ্চাৎদেশের উদ্দেশ্যে ধাবিত হয়েছে? অথচ সেই বাঁশ ধরে টাল সামলে ভিড় বাসে উঠে মানিব্যাগ খুইয়ে শেষ পর্যন্ত সেই বাঁশকেই দোষারোপ, পরিচিত মহলে আলোচনা, ‘প্যান্ডেল দেখতে গিয়ে ব্যাম্বু খেলাম’ ভাবখানা এমনই যেন পুজো দেখতে গিয়ে গোলবাড়ির কষামাংস খেয়ে বাড়ি ফিরেছেন!
আরও পড়ুন-রেকর্ড পতন পাউন্ডে
হাজার বদনাম থাকলেও উত্তরণের পথে বাঁশের ভূমিকা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এই তো সেবছর, আমাদের খামারের এক কোনায় সবার অলক্ষ্যে একটি লাউগাছ অবহেলিত পদদলিত হতে হতে আমার ঠাকুমার চোখে পড়তেই, ঠাকুমা খামারে ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা বাঁশের বাতা থেকে অপেক্ষাকৃত শক্ত একটি বেছে সেই অবহেলিত লাউগাছের কান ঘেঁষে খামারের দেওয়াল বরাবর দাঁড় করিয়ে দিলেন, অল্প কিছুদিনের মধ্যে লাউগাছটি সেই বাঁশরূপ উত্তরণের পথে দেওয়ালে চড়ে নানান সাইজের এমন লাউ ফলাল, পাড়াশুদ্ধ লোক খেয়েও যেন শেষ করতে পারে না।
মুড়ি ভাজার কুঁচিকাঠি কিংবা ঠাকুরদাদার লাঠি, ঝাড়তে ঘরের ঝুল আবার পুলিশের হাতের রুল, পড়ার টেবিলের সুদৃশ্য কলমদানি বা মাছ ধরার ঘুনি— জীবন জুড়ে সর্বত্র ছড়িয়ে শুধু বাঁশ আর বাঁশ এমনকী সেই সব-ভোলানো শ্যামের বাঁশির সুর, বাঁশের গর্ভেই তো তার সৃষ্টি।
দৃশ্যমান বাঁশের হাজার গুণ থাকলেও আমাদের যত চর্চা কিন্তু সেই অদৃশ্য বাঁশ নিয়েই। নিন্দুকেরা বলেন, বিবাহই নাকি মানবজীবনের প্রথম বাঁশ-বৃক্ষরোপণ উৎসব।
আরও পড়ুন-শারদ-মূর্ছনায় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের স্মরণ
তার পরেই নাকি, আবদার-বাঁশ, লোকাচার-বাঁশ, এ-বাঁশ ও-বাঁশে দিন দিন গহিন হতে-হতে জীবন পরিণত হয় বাঁশবাগানে। ঘটা করে বুক ফুলিয়ে অফিসের বড়কর্তার হাতে বিয়ের কার্ডটি ধরিয়ে দেবার পর তিনি একটি বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, ‘তুমিও উঠোনে বাঁশ পুঁতলে হে!’ ব্যাপারটা মাথায় না ঢোকায় তাঁর বিশ্লেষণ, সংসার হল গিয়ে একটি তেলমাখানো বাঁশ, যতই ধরে ওঠার চেষ্টা করো একহাত উঠে তিনহাত নেমে আসবে। কার্ডটি দেবার আগে কী ভেবেছিলাম আর কী হল! উদ্যমের বেলুন চুপসে সেদিন ওই অঙ্ক বইয়ের ওই বহুল পরিচিত বাঁদরটির মতো মুখ করে বেরিয়ে এলাম স্যারের কেবিন থেকে। যদিও পরে অনুভব করেছি, কথাটা যে পুরোপুরি মিথ্যে এমনটাও না, জীবন জুড়ে সর্বক্ষণ যেন অদৃশ্য বাঁশের দাপাদাপি। শুধু জীবন কেন সমাজ, সংসার সর্বত্রই সবাই যেন বগলদাবা করে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ওই অদৃশ্য বাঁশ। উচিত বলো ব্যাম্বু খাবে, উপকার করে ব্যাম্বু খাবে, হক নিতে যাও ব্যাম্বু খাবে। সংসার চালাতে গিয়েও রোজ-রোজ ওই অদৃশ্য বাঁশের সঙ্গেই সহবাস, গ্যাসে বাঁশ, তেলে বাঁশ, আলুতে বাঁশ। সেদিন আলুর দোকানের মালিক বললেন, ‘দাদা খুচরো নেওয়ার চেয়ে বস্তা নিন কম করে দিয়ে দেব।’ বস্তার দামটা মনঃপুত হতেই নেব-নেব ভাবছি এমন সময় পাশ থেকে অচেনা এক ব্যক্তি ফোড়ন কাটলেন, ‘এই বাজারে যদি গোটা একবস্তা আলু কেনেন, বাড়ি ফিরে দেখবেন ইডি সিবিআই বসে আছে!’
আরও পড়ুন-স্বাধীনতার ৭৫তম বর্ষপূর্তিতে আক্ষেপের অষ্টম বর্ষ পালন
পথ চলতে নিজের ভুলে হাজার বাঁশ তো আছেই, এ-ছাড়াও সমাজের প্রায় সকল স্তরে যারা অপেক্ষাকৃত সবল তারা দুর্বলদের বাঁশ দেওয়ার জন্য সর্বক্ষণ বগলদাবা করে ঘুরে বেড়াচ্ছে বাঁশের ওই অদৃশ্য ভার্সন, সে পাশের বাড়ি হোক বা দিল্লি, সবাই প্রায় একই ভাবে বাঁশ দিচ্ছে। বড্ড বেড়েছ বাপু, আমার মুখের ওপর কথা, প্রতিবাদ, দাঁড়াও দিচ্ছি বাঁশ খাইয়ে। এ খাইয়ে যেন পরম সুখ।
তবুও আজ এই বিশ্ব বাঁশ দিবসে অদৃশ্য বাঁশের সব গুণ বদগুণ পাশে সরিয়ে রেখে আসুন আজ সাধুবাদ জানাই বিশ্ব বাঁশ সংস্থার উদ্যোগকে। বাঁশ শিল্পের হোক উন্নতিসাধন, বাঁশ চাষ ও শিল্পের সম্ভবনা আরও উজ্জ্বল করার জন্য ‘ওয়ার্ল্ড ব্যাম্বু অর্গানাইজেশন’ পৌঁছাক তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে।
আরও পড়ুন-পুলিশের ‘নবদিশা’, শেখাবে পড়ুয়াদের
বাঁশ একা থাকে না, জন্মায় ও বেড়ে ওঠে গুচ্ছে, একে অপরকে জড়িয়ে একত্রিত হয়ে, আমরা যাকে বলি বাঁশঝাড়। আজকের নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি, উঁচু-নিচু, জাতপাত ও ধর্মের বিভেদের দিনে এ-ও তো এক পরিবেশের দেওয়া শিক্ষা। সব ভুলে আমরাও কি পারি না সংগঠিত হয়ে বাঁচতে, একত্রিত হয়ে বাঁচতে!