‘‘ভারতমাতার দু’চোখ বাঁধা, ধর্মে লাগে ঘোর;
বিকিয়ে যাওয়া সত্য জানে চৌকিদার-ই চোর।’’
ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই জীর্ণ হাতে ভাঙা চায়ের কেটলি কিংবা জংধরা সাইকেলের কেরিয়ারে ছেঁড়া সবজির বস্তা চাপিয়ে বেরিয়ে পড়ে আমার শ্রমজীবী ভারতবর্ষ। কর্পোরেটপ্রেমী কৃষিবিলের আতঙ্কে কীটনাশক খেয়ে আত্মহত্যা করা কৃষকের ছোট্ট ছেলেটা তখন তেরো তলায় মাচা বাঁধে রাজমিস্ত্রির সহায়ক হয়ে কিংবা রেললাইনে চাপা পড়া পরিযায়ী শ্রমিকের কিশোর সন্তান কুয়াশার নীরবতা ভেঙে বাড়ি বাড়ি ফেরি করে চলে সংবাদপত্র।
আরও পড়ুন-হোটেল-রিসর্টের পরিবেশ রক্ষায় উদ্যোগী পঞ্চায়েত
ভেতরে কালো হরফে লেখা, পাঁচবছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও অধরা ঋণখেলাপি মেহুল চোকসি ও নীরব মোদি। টাকার অঙ্কটা ১৩০০০ কোটি। না! ১৩০০০ কোটিতে কতগুলো শূন্য আছে, তা গুনতে বসলে হয়তো মাথা ঝিমিয়ে আসবে গ্যাস কিনতে চাল ফুরোনো ওই খেটে খাওয়া মানুষগুলোর। যে-দেশে গ্যাসের ভরতুকি ১৩ টাকারও কম, সে-দেশে ১৩০০০ কোটির স্বপ্ন দেখা পাপ। ক্ষুধার্ত এই ভারতবর্ষ যেখানে মুখে লাগাম গুঁজে, দিকশূন্যপুরে ছুটে চলে মাসে মাত্র তেরো হাজার টাকার খোঁজে, সেখানে তেরো হাজার কোটি? সে তো সাক্ষাৎ রূপকথার গল্প!
আরও পড়ুন-বারাসত যেন হ্যারি পটারের জাদুনগরী
কিন্তু সেই রূপকথাকেই বাস্তবায়িত করে দেখিয়েছেন আচ্ছে দিনের রূপকার শ্রী নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদি। বুভুক্ষু ভারতবাসীর ট্যাক্সের ১৩০০০ কোটি টাকা নিয়ে মেহুল চোক্সি, নীরব মোদিরা মগ্ন তাই বৈদেশিক দিবানিদ্রায়। চিন্তা কী! তাদের বিশ্বস্ত পাহারাদার নরেন্দ্র মোদি আছেন যে…
কিস্তির নয় হাজার টাকা বাকি পড়লেই বারবার ব্যাঙ্কের নোটিশ আসতে থাকে মধ্যবিত্ত ভারতবাসীর বাড়িতে। সেখানে নয় হাজার কোটি ঋণ নিয়ে বিদেশে পালিয়ে যাওয়া আমার-আপনার কাছে অলীক স্বপ্ন হলেও এমন উদাহরণ হাজির সাক্ষাৎ এই গেরুয়া ভারতবর্ষেই। ক্ষতিগ্রস্ত সতেরোটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক। নিরাপদে বিদেশে বিলাসযাপন পলাতক ইউবি গ্রুপের কর্ণধার বিজয় মালিয়ার। কারণ, কর্পোরেটের বিশ্বস্ত তাবেদার তাঁর প্রিয়তম বন্ধু নরেন্দ্র মোদি যে প্রধানমন্ত্রীর মসনদে। চায়ের ভাঁড়ে দেশ না বেচলে কি আর আচ্ছে দিন আসে! তাই ব্যাঙ্ক হয়ে সাধারণ মানুষের টাকা পলাতক ঋণখেলাপির হাত ধরে চলে যায় বিদেশে। এক কেটলি চায়ে দু’চামচ গরিবের রক্ত আর তিন চামচ ধর্মজুয়া— ব্যস! বিকাশ সুপারহিট।
আরও পড়ুন-রাজধানীর বায়ুদূষণ রাজনীতির যুদ্ধক্ষেত্র নয়, বলল সুপ্রিম কোর্ট
সান্ধ্যকালীন গদি মিডিয়ায় কণ্টাইয়ের এই তরুণ বিজেপি নেতাকে প্রায়ই দেখা যায় তৃণমূল নেতাদের অপ্রমাণিত দুর্নীতি নিয়ে খাপ পঞ্চায়েত বসাতে। অথচ তোয়ালে জড়িয়ে টাকা নিতে দেখা গিয়েছিল তাঁকেও। তারপর যমুনা দিয়ে ভেসে গিয়েছে কোভিড লাশের সারি। পরিযায়ী শ্রমিকের রক্তে লাল হয়েছে গঙ্গা। সময়ের নিয়মে শঙ্কুদেব পণ্ডা আজ বিজেপিতে। তাই আর তাঁর বিরুদ্ধে কোনও ইডির নোটিশ আসে না। আসে না সিবিআইয়ের সমন। উল্টে তিনি গেরুয়া নামাবলি চড়িয়ে চ্যানেলে বসে ন্যায়নীতির পাঠ শোনান। সব দেখেশুনে মনে পড়ে যায় কবিগুরুর সেই বিখ্যাত লাইন—
‘‘আমি শুনে হাসি আঁখিজলে ভাসি, এই ছিল মোর ঘটে—
তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে!’’
আরও পড়ুন-হংসেশ্বরী মন্দিরে ২০৯ বছর পর ছেদ পড়ছে বলিপ্রথায়
যেদিকে দু’চোখ যায় কেবল অধিকারীদের সম্পত্তি। জায়গাটার নাম কাঁথি। জেলা পূর্ব মেদিনীপুর। একদা দোর্দণ্ডপ্রতাপ গদ্দার অধিকারীর বিচরণভূমি। ২০১১-২০২১ সময়কালে একাধিক সরকারি সংস্থার চেয়ারম্যান তথা জোড়াফুল প্রতীকে নির্বাচিত লোকসভার সদস্য। পদাধিকারীর সমস্ত সুযোগসুবিধা ভোগ করেছেন চেটেপুটে। ২০০৯ থেকে ২০১২ মাত্র তিনবছরে তাঁর শ্রদ্ধেয় পিতার সম্পত্তি ১০ লাখ থেকে বেড়ে হয়েছে ১০ কোটি। বিজেপি মানেই যেন টাকার বৃদ্ধিতে ‘‘স্যাকা লাকা বুম বুম’’-এর ম্যাজিক পেনসিলের ছোঁয়া। সাধারণ ক্যালকুলেটরে যার হিসেব মেলে না কিছুতেই। সারদা-কাণ্ডে অভিযুক্ত সুদীপ্ত সেন জেরায় নাম বলেন তাঁর, নারদার ভিডিও ফুটেজেও দেখা যায় তাঁকে। তারপরও তাঁর ঠিকানায় হানা দেয় না কোনও ইডির গাড়ি। ডাকা হয় না নিজাম প্যালেস কিংবা সিজিও কমপ্লেক্সে। আসলে বিজেপির রক্ষাকবচ আছে কিনা!
আরও পড়ুন-দেশে বেকারত্বের হার নিয়ে মোদি সরকারকে তোপ দাগলেন অমিত মিত্র
অমিত শাহের পুত্র জয় শাহের কোম্পানি টেম্পল এন্টারপ্রাইজ প্রাইভেট লিমিটেড। ‘দ্য ওয়ার’- এর দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মাত্র ৫০ হাজার মূলধনের কোম্পানি ২০১৪-১৫ আর্থিক বর্ষে ছুঁয়েছে ৮০ কোটির ল্যান্ডমার্ক। বৃদ্ধিটা ১৬০০০ গুণ! অর্থাৎ কেন্দ্রীয় সরকারের পালাবদলের ঠিক পরেই জয় শাহের অর্থতরীতে দামাল হাওয়া কিন্তু এ ব্যাপারে ইডি, সিবিআই স্পিকটি নট! আসলে তাদের সুপারবসের হুকুম আসেনি যে…
ঘোটালার আরেক নাম পিএম কেয়ার ফান্ড। ভয়াবহ কোভিডকালে নুন আনতে পান্তা ফুরোনো ভারতবাসী নিজেদের বিশ্বাসকে উজাড় করে দিয়েছিল যেখানে। নাহ্! সাড়ে তিনবছরেও সেই ফান্ডের কোনও অডিট হয়নি। মেলেনি কোনও হিসেব। হয়নি কোনও সিবিআই তদন্ত। গরিব কাটিয়েছে অনাহারেই। বেড়েছে স্কুলছুট। মরেছে পরিযায়ী শ্রমিক। আসলে রোদে পোড়া দরিদ্র ভারতবাসীর তামাটে চামড়া না হলে ভগবানের বরপুত্রের উন্নতির ঢাকটা সশব্দে বাজবে না যে…
আগামী ২০২৪-এর নির্বাচনে কিন্তু গর্জে উঠতে চলেছে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে ঘুরে দাঁড়ানোর গান—
‘‘বাড়তে থাকে রক্তচাপের একশো চারের জ্বর
বাড়তে থাকে বন্দি দেহের একশো কণ্ঠস্বর,
তাই আর দেরি আর নয়
এই কাচের খাঁচা ভাঙতে কিসের ভয়?
এই রাজপ্রাসাদের রাজার ঘরে গিয়ে
জানতে চাইবি রাজার পরিচয়,
শুনছি রাজা অপরাধী বলেই
সারা জীবন পাচ্ছে এত ভয়।’’