১২ নভেম্বর। দীপাবলি। গোটা দেশ আলোর উৎসবে মাতোয়ারা। সেদিন ভোরে উত্তরকাশীতে ৪১ জন শ্রমিকের জীবনে ধেয়ে এল অন্ধকার। হঠাৎ পাহাড়ি ধস নামার পর থেকে ৪১ জন কর্মরত শ্রমিকরা উত্তরকাশীর নির্মীয়মাণ সুড়ঙ্গের ভেতরে আটকে আছেন। বাংলার তিন শ্রমিকও আছেন। প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত তাঁদের উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। নির্মীয়মাণ সুড়ঙ্গটি ‘চারধাম প্রকল্প’-এর অংশ, যা বদ্রীনাথ, কেদারনাথ, যমুনোত্রী এবং গঙ্গোত্রীর হিন্দু তীর্থস্থানগুলিকে একই রাস্তা দিয়ে জুড়বে। এটি একটি বিতর্কিত প্রকল্প। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে এই প্রকল্পটি আকস্মিক বন্যা এবং ভূমিধসের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিয়েছে।
আরও পড়ুন-নয়া অবতারে কিং কোহলি
মনুষ্যসৃষ্ট প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে হিমালয় এখন বিপন্ন। ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশনের রিপোর্টে বলা হয়েছে গত ২৭ ডিসেম্বর থেকে ৮ জানুয়ারির মধ্যে যোশীমঠ ৫.৪ সেন্টিমিটার বসে গেছে। ধ্বসের কারণে যোশীমঠের বিস্তীর্ণ জনবসতি এলাকা হুমকির মুখে। তাও সরকার সতর্ক হয়নি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের স্নেহধন্য উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিং ধামি পর্যটন উন্নয়নের নামে সর্বনাশ ডেকে এনেছেন দেবভূমিতে।
আরও পড়ুন-সাহসী ক্রিকেটেই আস্থা যশস্বীর
২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর নরেন্দ্র মোদি সরকারের প্রথম লক্ষ্য ছিল চিন সীমান্তে যাওয়া সব ক’টা ট্রেক রাস্তা— মিলাম গ্লেসিয়ার থেকে শুরু করে পঞ্চচুল্লী বেস ক্যাম্প। এরপর হাত পড়েছে চারধামের (যমুনোত্রী, গঙ্গোত্রী, কেদারনাথ ও বদ্রীনাথ) দিকে। চারধামের রাস্তা প্রশস্ত করার পরিকল্পনা। বনাঞ্চল ধ্বংস করায় অল্প বর্ষণেই ধুয়ে যাচ্ছে টন টন মাটি। আলগা হচ্ছে পাথর। জমা হচ্ছে নদীখাতগুলোতে। নদীগুলো নালাতে পরিণত হচ্ছে। নাব্যতা কমছে মন্দাকিনী থেকে অলকানন্দার। গাড়োয়াল হিমালয়ের ভিত নড়ে গেছে। কারণ সুড়ঙ্গের পর সুড়ঙ্গ নির্মাণ করা হয়েছে পাহাড়ে। ডিনামাইট ফাটিয়ে হরিদ্বার, হৃষীকেশ, দেরাদুন থেকে উত্তরকাশী, যোশীমঠ পৌঁছনোর রাস্তা সুগম করার জন্য। কেটে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বনাঞ্চল! চারধামের অন্যতম বদ্রীনাথধামের প্রবেশ পথ যোশীমঠের বিপর্যয় আটকানোর পথ বন্ধ হচ্ছে ক্রমশ। উত্তরপ্রদেশ ভেঙে নতুন পাহাড়ি রাজ্য উত্তরাখণ্ডে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে তৈরি হয়েছে রাস্তাঘাট, নতুন জনবসতি। সঙ্গে একের পর এক জলাধার। এরপর হিন্দুত্বের জিগির তুলে মোদির কর্পোরেট বন্ধুরা টাকা কামানোর জন্যে গড়েছে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। পাহাড় ধ্বংস করে বড় বড় হোটেল নির্মাণ হয়েই চলেছে। উন্নয়নের জিগির তুলে চলছে পরিবেশের ধ্বংসলীলা। পাহাড়ে বাস্ততন্ত্র বিপর্যস্ত।
আরও পড়ুন-Uttakashi: ভগবান ভরসা, সুড়ঙ্গের সামনে বিগ্রহে চলছে পুজো
একদিকে মোদির ‘হিন্দু জাগরণের’ স্বপ্নের মহা কর্মযজ্ঞ— চারধামের রাস্তা চওড়া করানো, অন্যদিকে চিন-জুজু দেখিয়ে অবৈজ্ঞানিকভাবে চিন সীমান্তে যাওয়া সব ক’টা রাস্তায় একটার পর একটা প্রজেক্ট। অসংখ্য টানেল। অসংখ্য ছোট-বড় বাঁধ হিমালয়ের মতো নবীন ভঙ্গিল পর্বতে। যেখানে ভূ-কম্পন যে কোনও সময় হতে পারে। অরুণাচল থেকে কাশ্মীর অবধি যে কোনও জায়গায়। যে কোনও সময়ে।
আরও পড়ুন-বাংলায় আছড়ে পড়তে পারে ‘মিগজাউম’
সরকার বাহাদুরের সর্বগ্রাসী লোভ শেখেনি ২০১৩ সালের ‘হিমালয়ান সুনামি’ থেকে। প্রায় পুরোটাই নিশ্চিহ্ন হতে বসেছে গাড়োয়াল রেঞ্জ। ২০০৯ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে অন্তত ১২৮টি ধসের মুখে পড়েছে চামোলি-যোশীমঠ এলাকাটি। ২০২১ সালে তপোবন বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাছেই কাদা-ধসের বন্যায় তলিয়ে গিয়ে প্রায় ২০০ জনের মৃত্যু হয়েছিল। তার মধ্যে বেশিরভাগই পরিযায়ী শ্রমিক ছিল। কিন্তু ডবল ইঞ্জিন সরকার শিক্ষা নেয়নি। শিক্ষা নেয়নি ২০১৩ সালের কেদারনাথ বিপর্যয়ের থেকে। শিক্ষা নেয়নি ১৯৭০ সালে ধৌলিগঙ্গায় আসা হড়কা বান থেকে। যার ফলে পাতাল গঙ্গা, হেলং থেকে টাকনালা অবধি বড় ভূ-ভাগকে একদিকে হেলিয়ে দিয়েছিল। আবার অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আরও ‘উন্নয়ন’! আর এইসবের পরিণাম— বিপর্যস্ত দেবভূমি। বৈজ্ঞানিকভাবে একথা প্রমাণিত— পাহাড়গুলোর মধ্যে নবীন হল ভঙ্গিল পর্বত হিমালয়ের গঠনপর্ব এখনও চলছে। আর এর ওপর গাড়োয়াল হিমালয়ের এই অংশ ধস, ভূকম্প প্রবণ হওয়ায় প্রাকৃতিকভাবে দুর্বল ও ভঙ্গুর। বেশি ভার বইতে পারে না। তা সত্ত্বেও লাগাতার তৈরি হয়েছে-হচ্ছে বড় বড় প্রকল্প। মুনাফার লোভে।
আরও পড়ুন-এবার থেকে কি দার্জিলিংয়ে ঘুরতে গেলে দিতে হবে কর?
কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণে বাজার অর্থনীতির মূল সমস্যা হল মুনাফা লুঠের প্রয়োজনে উন্নয়নের সামনে প্রকৃতি বা পরিবেশ রক্ষার প্রশ্নটাকে উপেক্ষিতই হতে হয়েছে। এতটাই নিষ্ঠুর সেই লোভ যে তুতিকোরিনে দূষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে আসা মানুষ খুন হয়েছেন বুলেটে। আর এইবার ‘বিকাশের’ নামে তীর্থদর্শনের পর্যটন শিল্পের অজুহাতে ধর্মীয় আবেগে ভর করে গোটা হিমালয়ের পাহাড়ি অঞ্চলে বিপর্যয় নামিয়ে আনার, বিপজ্জনক খেলায় নেমেছে আরএসএস-কর্পোরেট চালিত বিজেপির কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার। বাস্তুতান্ত্রিকভাবে অত্যন্ত সংবেদনশীল পাহাড়ি এলাকায় জঙ্গল সাফ করে একটার পর একটা প্রকল্প গড়া হচ্ছে। যেমন হয়েছিল বলসারানোর ব্রাজিলে— পৃথিবীর ফুসফুস আমাজনে। কর্পোরেট বান্ধব বোলসেরোনোর বন্ধু নরেন্দ্র মোদির সরকার সবচেয়ে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছেন, ‘ইকোলজিক্যাল হট স্পট’গুলোকে। এর অন্যতম হিমালয়, পশ্চিমঘাট, উপকূল অঞ্চল ইত্যাদি। দুনিয়া জুড়ে ঘটে চলা জলবায়ু পরিবর্তনে আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি উপকূল বা দ্বীপ অঞ্চলের বাসিন্দাদের বেঘর হওয়ার চিত্র। এখন বাদ যাচ্ছে না হিমালয়ও।
আরও পড়ুন-আমদানির মূল্য কম দেখিয়ে বিরাট শুল্ক ফাঁকি
পাহাড়-পর্বত ইকোসিস্টেমের অংশ। মানুষ, প্রাণী, উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্যের একে অন্যের ওপর চিরন্তন নির্ভরতাই প্রকৃতির পূর্ণতা। এই পাহাড়ই মানুষ ও জীববৈচিত্র্যের খাদ্যের আধার, খনিজ সম্পদের আধার। পাহাড়ে ছড়িয়ে আছে মানুষের রোগ নিরাময়কারী ভেষজগুণসম্পন্ন হাজারো ঔষধি গাছ, লতাগুল্ম। পাহাড়কে ক্ষত-বিক্ষত করলে পাহাড় কীভাবে ভূমিকম্পের মতো আমাদের ওপর আছড়ে পড়ে এবং তছনছ করে দেয় সড়ক ও জনপদ তার প্রমাণ সাম্প্রতিক কালের একের পর এক পাহাড়ধস। পৃথিবীর অনেক বড় শহরের অবস্থান পাহাড়ের শীর্ষে। উঁচু উঁচু পাহাড় অক্ষত রেখে ঢালু জায়গায় গড়ে তোলা হয়েছে অনিন্দ্যসুন্দর জনপদ। এক খণ্ড পাহাড়ও কাটা পড়েনি। এক টুকরো গাছও হয়নি নিধন। এটিই টেঁকসই উন্নয়ন। অথচ দানবীয় প্রক্রিয়ায় আমরা পাহাড়-টিলা ধ্বংস করছি। ডেকে আনছি প্রকৃতির ওপর শোষণ, লুণ্ঠন ও অভিঘাতের এক ভয়ঙ্কর পরিণতি।
আরও পড়ুন-শীত পড়তেই শুরু গঙ্গাসাগর মেলার প্রস্তুতি
স্টিফেন হকিং বলেছিলেন, ‘যে-গ্রহে আমরা বাস করি, তা ধ্বংস করার প্রযুক্তি আমরা আবিষ্কার করে ফেলেছি কিন্তু এ-গ্রহ থেকে পালিয়ে যাওয়ার প্রযুক্তি এখনও আমরা বের করতে পারিনি।’ আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ান নেতা জেরেনিমোর একটি মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছিলেন, ‘যখন শেষ গাছটি কাটা হবে, শেষ মাছটি ধরা হবে এবং শেষ নদীটির জল বিষাক্ত হবে, তখন আমরা উপলব্ধি করব, শুধু টাকা খেয়ে বেঁচে থাকা যায় না।’ পাহাড়-পর্বত ধ্বংসের পাওনা একদিন পাই-পাই করে বুঝিয়ে দিতে হবে মানুষকে। মেকি সভ্যতার অতি দ্রুতগামী রথে চেপে প্রাকৃতিক পরিবেশকে ধ্বংস করে ডিজিটাল ইন্ডিয়ার ইমারত একদিন তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়বে। পরিবেশ ধ্বংসকারী সিন্থেটিক উন্নয়নের অশ্বমেধ ঘোড়াকে থামাতে সাধারণ মানুষের গর্জে ওঠার সময় এসেছে। এ-লেখনী যেন পাহাড়রক্ষায় জাগ্রত করে সকলের বিবেক—এ-আশায় বুক বেঁধে আছি।