ঠিকঠাক হিসেব ধরলে টেলিভিশন আবিষ্কারের বয়েস হয়ে গেল ৯৮ বছর। জন লোগি বেয়ার্ড টেলিভিশন আবিষ্কার করেছিলেন সেই ১৯২৪ সালে। যদিও টেলিভিশন-এর বাণিজ্যিক সম্প্রচার শুরু হতে হতে ১৯৩৬ সাল হয়ে যায়। ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন, যারা এতদিন রেডিও নিয়ে কাজ করছিল, তারা টেলিভিশন নিয়ে কাজ করতে উদ্যোগী হয়। আরও ৩ বছর পরে কলম্বিয়া ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন আমেরিকায় টেলিভশন সম্প্রচার শুরু করে। এরপর আর টেলিভিশনকে পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। বিশ্বের সব অগ্রণী দেশই টেলিভিশনকে বেছে নেয় যোগাযোগের এবং প্রচারের মাধ্যম হিসেবে।
আরও পড়ুন-বাক্স ফিকে মুঠোয় ম্যাজিক
ভারত এই সময়টায় ঘুমিয়ে ছিল। সত্যিই কি ঘুমিয়েছিল নাকি কপট নিদ্রায় আচ্ছন্ন ছিল? ১৯৫০ সালে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস রিপোর্ট করে যে মাদ্রাজ অধুনা চেন্নাই-এর তেনামতে শহরে বি শিবকুমার নামে এক ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ার টেলিভশন নামে একটি যন্ত্রের সাহায্যে সম্প্রচার করছেন। কিন্তু, সেইসময় রেডিও সম্প্রচারে বুঁদ হয়ে থাকা ভারতীয়রা বিষয়টিতে আগ্রহ প্রদর্শন করেননি। সেই সময় ভারত সবে স্বাধীন হয়েছে। স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু প্রায় বিদেশ সফরে যাচ্ছেন। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেহরু বুঝতে পারেন যে টেলিভিশন হল এমন একটি মাধ্যম যার দ্বারা ভারতের আমজনতার সঙ্গে মুহূর্তে যোগাযোগ করা সম্ভব।
ভারতে টেলিভিশন সম্প্রচার শুরু হয়ে গেল ১৯৫৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর। টেরেস্টিয়ল সম্প্রচার। দু ঘণ্টার শিক্ষা। স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কিত অনুষ্ঠান প্রচারিত হত। শুধুমাত্র দিল্লিতে দেখা যেত এই টেলিভিশন। কাগজে বিজ্ঞাপন দিতে হত অমুক সময়ে অমুক জায়গায় টেলিভিশন দেখানো হবে। লোকে হুদোয় হুদোয় ছুটত এই নতুন চলমান ছবি দেখার জন্যে।
আরও পড়ুন-নন্দীগ্রামে আজ থেকে চাটাই পেতে বৈঠক
বিশ্ব টেলিভিশনের বয়েস যদি ৯৮ হয়, ভারতীয় টেলিভিশনের বয়েসও হয়ে গেল ৬৩ বছর। কিন্তু, আজও কি ভারতীয় টেলিভিশন সাবালক হতে পারল? অস্বীকার করব না যে ভারতীয় সংবাদ চ্যানেল আর বিনোদনের চ্যানেল অনেকটা দৌড় দৌড়েছে। কিন্তু প্রার্থিত সমাপ্তি রেখা আজও হয়তো ছোঁয়া সম্ভব হয়নি। ১৯৬৫-তে মেক শিফট স্টুডিও আর নড়বড়ে সম্প্রচার ব্যবস্থা নিয়ে যে অল ইন্ডিয়া রেডিও টেলিভশন তৈরি হয় তাতে না ছিল আধুনিক প্রযুক্তি, না ছিল উন্নত সম্প্রচার ব্যবস্থা। ১৯৭২-এ বম্বে অধুনা মুম্বই ও অমৃতসরে সম্প্রসারিত হয় এই সম্প্রচার। ১৯৭৫ কলকাতা-সহ আরও ৭টি শহরে সম্প্রচার শুরু হয় অল ইন্ডিয়া রেডিও টেলিভিশন হিসেবে। শুরু হয় স্যাটেলাইট ইন্সট্রাকশনাল টেলিভিশন এক্সপেরিমেন্ট বা সাইট।
১৯৭৬-এর পয়লা এপ্রিল শুরু হয় ভারতীয় দূরদর্শন। তারিখটা উল্লেখযোগ্য। পয়লা এপ্রিল। অল ফুলস ডে। তাই কি এদেশে টেলিভিশনকে ইডিয়ট বক্স বলা হয়? ভারতীয় টেলিভশনকে এরপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ১৯৮২-তে কলকাতায় নেহেরু গোল্ড কাপ ফুটবল খেলা হয়। এক বাঙালি সিনেমা পরিচালক— প্রবীর রায়— সেই খেলাগুলির সম্প্রচার করেন রঙিন পাঁচ ক্যামেরা বসিয়ে। সুইচার ব্যবহার করে পাঁচ ক্যামেরার ছবি একত্রিত করে সম্প্রচার হয়। এর পর ওই বছরই নভেম্বর-এ দিল্লি এশিয়াড-এ রঙিন সম্প্রচার। শুরু হয়ে গেল টেলিভিশন-এর রঙিন যুগ।
আরও পড়ুন-প্রাক্তন নৌ-কর্মী খুনে গ্রেফতার হল স্ত্রী ও ছেলে
একটি ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণা এখানে অপ্রাসঙ্গিক হবে না। সেই সময় দূরদর্শনের নিয়মিত ক্রীড়া ভাষ্যকার হিসেবে কাজ করতাম। আমার একটা প্রিয় লাল শার্ট ছিল। সেটা গায়ে দিয়ে সাদা কালো টেলিভিশনেও কাজ করতাম। ১৯৮২ সালে এক প্রডিউসার বলেছিলেন, এবার লাল শার্টটা মর্যাদা পাবে। রংটা বোঝা যাবে!
সেই সময় হামলগ, ওয়াগলে কি দুনিয়া, বুনিয়াদ, চিত্রহার, সুপারহিট মুকাবিলা, মালগুডি ডেজ ভারত কাঁপাচ্ছে। আটের দশকের শেষের দিকে এসে গেল রামানন্দ সাগরের রামায়ণ এবং বি আর চোপড়ার মহাভারত। মানুষ টেলিভিশন-এ মগ্ন হল। ১৯৯১ সালে প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাও ও তাঁর অর্থমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং প্রাইভেট টেলিভিশন এবং বিদেশি ব্রডকাস্টারদের দরজা খুলে দিলেন। সিএনএন, স্টার টিভি নেটওয়ার্ক সম্প্রচার শুরু করল। এলজি টিভি, ইটিভি, সান-এর মতো প্রাইভেট টেলিভিশন-সহ এনডিটিভি যাত্রা শুরু করল। আঞ্চলিক নিউজ চ্যানেল আরও পরে দিনের আলো দেখল।
আরও পড়ুন-বিদ্যালয়ে গিয়ে ক্লাস নিলেন বিডিও
ততদিনে টিভিতে গালফ ওয়ার দেখে নিয়েছে মানুষ। টিভির সর্বজনগ্রাহ্যতা স্বীকৃতি পেয়েছে। সেই সময় বাংলা নিউজ চ্যানেল শুরু হয়নি। এমনকী বাংলা খবরের মাইলস্টোন খাসখবরও দিনের আলো দেখেনি। কলকাতা দূরদর্শন প্রচার করল প্রবাহ নামের এক সংবাদ ম্যাগাজিন। কুণাল ঘোষ সম্পাদিত, সুজিত রায় পরিচালিত, সজ্জন খৈতান প্রযোজিত এই অনুষ্ঠানটির কথা যদি না বলি তাহলে হয়ত ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। আজ যে বাংলা নিউজ চ্যানেলের রমরমা তার বীজ তো উপ্ত হয় প্রবাহ থেকেই। বিনীত ভাবে জানাই সেই ম্যাগাজিন-এর সঞ্চালকের ভূমিকায় সেদিন কুণাল আমাকেই বেছে নিয়েছিলেন। প্রথমে শ্যুটিং হত ওয়েলিংটন স্কোয়্যারে, পরে লেকের পাশে বিবেকানন্দ পার্কের পাশে এক প্রাইভেট স্টুডিওতে। ভাবতে পারেন ধান ভানতে শিবের গীত কেন, নিজেদের বিজ্ঞাপিত করতেই কি? না, আমি আজও ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি, কয়েকজন তরুণের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল প্রবাহর কথা যদি না বলি তাহলে ভারতীয় টেলিভিশন-এর ইতিহাস ও পরম্পরা বর্ণনায় এক ঐতিহাসিক ভুল হয়ে যাবে।
আগেই বলেছি, ১৯৯১-এর পরে খরগোশের মতো ভারতীয় টেলিভিশন খালি দৌড়েছে। ২০১৬-র একটি হিসাব দেখছিলাম, ৮৫৭টি চ্যানেল আছে ভারতে যার মধ্যে ১৯৪টি পে চ্যানেল, বাকিগুলি ফ্রি টু এয়ার। এই ২০২২-এ সংখ্যাটি নিশ্চয়ই ১৫০০ এবং ৩০০। টেলিভিশন সম্প্রচারের ক্ষেত্রেও বিপ্লব এসেছে।
আরও পড়ুন-পরিযায়ী শ্রমিকের বাড়িতে ৩৮ লাখ
একটা সময় ছিল যখন মাটির তলায় কেবল ফেলে লোকের বাড়ি বাড়ি তা পৌঁছে সম্প্রচার হত যা কেবল টিভি নামেই পরিচিত ছিল। তারপর এল স্যাটেলাইট সম্প্রচার, ডিশ। কন্ডিশনাল একসেস সিস্টেম-এর মাধ্যমে ব্রডকাস্টার সিগন্যাল পাঠায় কেবল অপারেটরদের কাছে। তারা সেই সিগন্যাল পাঠায় বাড়ি বাড়ি। এই কেবল অপারেটররা আবার এমএসও বা মাল্টি সার্ভিস অপারেটরদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ফলে, ব্রডকাস্টারকে গাঁটের কড়ি খরচ করে পৌঁছাতে হয় এমএসওর কাছে। তবে, তারা লোকের বাড়ি বাড়ি পৌঁছাতে পারে। এ এক ভিসিয়াস সার্কল। কত চ্যানেল যে বন্ধ হয়ে গেছে এমএসও-কে টাকা দিতে না পেরে!
আরও পড়ুন-আইডল নেইমারের চাপ কমাতে চান ভিনি
বলা হয়ে থাকে উন্নত দেশের মতো বাড়ি বাড়ি গ্যাস কিংবা টেলিফোনের লাইনের মতো যদি টিভির লাইন নিয়ে যাওয়া যেত তাহলে হয়তো ব্রডকাস্টাররা বেঁচে যেত। এমএসও-কে দেদার অর্থ দেওয়ার বদলে কনটেন্ট-এ ব্যায় করতে পারত ব্রডকাস্টাররা। এখন সাবেক টেলিভিশন-এর চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে ডিজিটাল টিভি, ওটিটি, আইপিটিভি প্রভৃতি। তবু সাবেক টেলিভিশন-এর মার নেই। যদিও ভারতীয় টেলিভিশন এখনও কটেন্ট-এর দিক থেকে সাবালক হতে পারেনি। কিন্তু কে যেন বলেছিল, ওল্ড ইজ গোল্ড! ভারতীয় টেলিভশন সেই নিখাদ সোনা, যার বিচ্ছুরণে দর্শক আজও মজে।