স্বাধীনতা @ ৭৫ যেগুলো এখনই দরকার

নানা উৎসব, অজস্র আয়োজন। হর ঘর তেরঙ্গার বিপুল সমাহার। কিন্তু এ-সব বাহ্যিক আড়ম্বরের অন্তরালে জাগরুক কিছু চাওয়া, অবহেলিত। অনুল্লেখিত। কিন্তু প্রবলভাবে অভিপ্রেত। তেমনই কিছু দাবিদাওয়ার কথা লিখছেন আকসা আসিফ

Must read

আর একটা ১৫ অগাস্ট চলে গেল (India’s 75th Independence Day)। ৭৬তম স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপিত হল রমরমিয়ে। কী পেয়েছি, কী পাইনি তার জাবেদা-খতিয়ান খুলেও চলল বিস্তর আলোচনা। প্রতপ্ত প্রতর্কেরও কোনও কমতি ছিল না টিভির পর্দায় কিংবা সংবাদপত্রের পাতায়।

এখন শোনা যাচ্ছে, আমাদের চিরচেনা ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে নির্মিত হতে চলেছে ‘শব্দলোক’। দেশের ২২টি সরকারি ভাষার উৎপত্তি ও বিকাশের পথ বোঝানোর জন্য জাদুঘর। সেখানে সংরক্ষিত হবে ভাষার ইতিহাসের নথি, পণ্ডিতবর্গের লেখা পাণ্ডুলিপি, বিদগ্ধ স্বনামধন্য কবি-লেখকদের রচনায় মূল নথি ইত্যাদি।

অভিনব এবং প্রশংসনীয় উদ্যোগ। স্বাধীনতার ৭৫ বছরে (India’s 75th Independence Day) নিঃসন্দেহে একটা বড় প্রাপ্তি। দেশে ইতিহাস-ভূগোল-সংস্কৃতি-আত্মা বুঝতে গেলে, জানতে গেলে, চিনতে গেলে, এরকম একটা জাদুঘর থাকা, সেখানে যাওয়া, সেখানে শিক্ষার্থীদের নিয়ে যাওয়া, এগুলো জরুরি। খুব, খুবই দরকার। এ-বিষয়ে দ্বিমতের কোনও অবকাশ নেই।
কিন্তু একই রকমভাবে ভীষণ দরকার ছিল আর একটা জাদুঘরের। সেখানে সংরক্ষিত হত এদেশে অস্পৃশ্যতার ইতিকথা। উৎপত্তি, প্রসৃতি এবং প্রস্থানের ইতিবৃত্ত।
সেটা আর হল কই!
হবেই বা কীভাবে?
যে-বছর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালিত হল, সে-বছরেই ঘটেছিল ঘটনাগুলি।

মুম্বইয়ের রমাবাই আম্বেদকর নগরে জনৈক মারাঠা পুলিশ অফিসারের নেতৃত্বে সংঘটিত হল অস্পৃশ্য-দলিত মানুষজনের গণহত্যা। দক্ষিণ ভারতের মাদুরাইয়ে উচ্চবর্গীয় থেবাররা প্রকাশ্য দিবালোকে ছ’জন দলিত নেতার মুন্ডু কেটে নিয়েছিল। বিহারে লক্ষ্মণপুর বাথেতে রণবীর সেনা গুলি করে মেরেছিল ৫৮ জন দলিতকে। স্বাধীনতা দিবস পালনের আগে-পরেই ঘটনাগুলো ঘটেছিল।
আর এ-বছর, যখন স্বাধীনতার ৭৫ বছর উপলক্ষে ঘরে-ঘরে ত্রিবর্ণরঞ্জিত জাতীয় পতাকার উত্তোলন নিশ্চিত করার আয়োজন দেখে আমরা যুগপৎ মুগ্ধ ও গর্বিত হলাম, সে-বছর রাজস্থানে স্বাস্থ্যকর্মী জিতেন্দ্র মেঘওয়ালকে কুপিয়ে মারল দু’জন ব্রাহ্মণ কারণ জিতেন্দ্র আর তাঁর মা নিম্নবর্ণের মানুষ হয়েও ব্রাহ্মণদের দিকে চোখ তুলে তাকিয়েছিল।
বেঙ্গালুরুতে দলিত যুবক বিজয় কাম্বলেকে মরতে হল এক মুসলমান মেয়ের প্রেমে পড়ার অপরাধে। ঘাতক মেয়েটির ভাই শাহাবুদ্দিন। সে অচ্ছুতের সঙ্গে বোনের ভালবাসার সম্পর্ক মেনে নিতে পারেনি।

আরও পড়ুন: নির্বাচনের আগে অন্তর্দ্বন্দ্ব গুজরাত বিজেপিতে, খর্ব দুই মন্ত্রীর ক্ষমতা

মধ্যপ্রদেশে দলিত সম্প্রদায়ভুক্ত তথ্যাধিকার কর্মী শশিকান্ত যাদবকে পিটিয়ে মারা হল। মেরে ফেলার আগে তাঁকে প্রস্রাব-পানে বাধ্য করা হয়।
আর এই তো সেদিন, ন’বছর বয়সি বালক ইন্দ্রকুমার মেঘওয়ালকে পিটিয়ে মারল তারই ‘শিক্ষক’ চৈল সিং। ছেলেটির অপরাধ, সে উচ্চবর্ণের পাত্র থেকে জল খেয়েছে, দলিত অস্পৃশ্য হওয়া সত্ত্বেও।
এখানে দাঁড়িয়ে একটা প্রশ্ন।
পরিবারে নাতি নিহত হলে কি ঠাকুরদার জন্মদিন পালন করা হয়?
যদি তা না হয়, তবে স্বীকার করতেই হবে, দেশের অস্পৃশ্য দলিত প্রান্তিক মানুষদের কাছে স্বাধীনতা দিবস অপমানের নামান্তর। স্বাধীনতার ৭৫ বর্ষপূর্তি উৎসব পালনের নামে তাদের নিজেদের মৃত্যুবার্ষিকী পালনে বাধ্য করাটা চরম নিষ্ঠুরতা।

যে-দেশে দলিত ঘোড়ায় চেপে ঘুরলে উচ্চবর্ণের লোকজন ক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ হয়, চোখ রাঙায়, যে-দেশে দলিতকন্যা স্কুলে গেলে গোটা গ্রাম ত্রস্ত হয়ে উঠে তার শিক্ষার পথ আটকায়, যে-দেশে দলিত যুবক গোঁফ রাখলে কিংবা ধোপদুরস্ত পোশাক পরলে উচ্চবর্ণের লোকজন সেটাকে তাদের প্রতি অবমাননা বলে মনে করে, যে-দেশে যে-যত দামি ডিজাইনার স্যুট পরুক না কেন আদতে দলিতদের ‘স্বচ্ছ ভারতে’র প্রয়োজন শৌচালয়ের সাফাইকর্মীর বেশি কিছু ভাবতে পারে না, সে-দেশে ‘স্বাধীনতা’ কথাটাই একটা বড়সড় ঠাট্টা হয়ে দাঁড়ায়। আর সেখানে অস্পৃশ্যতাকে জাদুঘরে পাঠানোর ভাবনাটাও নেহাতই বাতুলতা বলে মনে হয়। সেটাই স্বাভাবিক।
এই প্রসঙ্গে একটা কথা না বললেই নয়।
‘শব্দলোক’ বা ভাষার ইতিহাস-বিষয়ক জাদুঘর যে-রাজ্যে তৈরি করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে সেই রাজ্যে কিন্তু অস্পৃশ্যতা কিংবা ‘দলিত’ বলে কাউকে নির্যাতন করার বিষয়টা অবশিষ্ট ভারতের মতো নয়। পশ্চিমবঙ্গে অস্পৃশ্যতা একেবারেই জাদুঘরের সামগ্রীতে পরিণত হয়েছে। স্পষ্টত রবীন্দ্র-নজরুলের রাজ্য ‘জাতের নামে বজ্জাতি’ আর হতে দেয় না।

৭৬তম স্বাধীনতা দিবস পেরিয়ে তাই একটা জিজ্ঞাসা, দক্ষিণ আফ্রিকায় যদি বর্ণবৈষম্যের জাদুঘর তৈরি হতে পারে তবে আমাদের দেশে অস্পৃশ্যতার জাদুঘর তৈরি করা যাবে না কেন? স্বচ্ছ ভারত নিয়ে সদা-ভাবিত, কর্পোরেট ভারত নিয়ে নিয়ত-ব্যস্ত গৈরিক সরকার কেন এই কথাটা, এই চিন্তাটা, এই সংক্রান্ত আলোচনাটা চাইছে না, করছে না এবং হতে দিচ্ছে না?
আরও একটা কথা।
বিগত ৭৫ বছরে ভারত আরও সমৃদ্ধশালী হয়েছে, দেশের খাদ্যনিরাপত্তাও বেড়েছে, কিন্তু পানীয় জল বা কৃষির প্রয়োজন জলের ব্যাপারে অনিশ্চয়তা কমেনি। চিনের চোখরাঙানি নিয়ে দিল্লির মাতব্বরেরা ভীষণ চিন্তাভাবনা করার চেষ্টা দেখাচ্ছেন। সমুদ্রতলের বৃদ্ধি আর পরিবেশ দূষণ নিয়েও নানা মহলে আলোচনা চলছে। কিন্তু জল যে ক্রমেই এদেশে দুষ্প্রাপ্য হচ্ছে, তা নিয়ে কোনও সংকল্পের কথা লালকেল্লা থেকে পাওয়া যাচ্ছে না।
কেন?

প্রশ্নগুলো জাগছে, উত্তরগুলো অজানা। চিন্তা তাই থেকেই চলেছে। আতঙ্ক ও আশঙ্কাও।
জল আর জাতপাতেই না আমাদের স্বাধীনতার চরম সর্বনাশ হয়ে যায়!

Latest article