মানব শরীর রহস্যময় ধাঁধার থেকে কোনও অংশে কম নয়। এর প্রতিটি ছত্রে রয়েছে নতুন নতুন চমক। আর এরই মধ্যে অন্যতম বড় চমক লুকিয়ে রয়েছে আমাদের অন্ত্রে। আমাদের চিরচেনা অন্ত্র হল এক রহস্যের খনি। অন্ত্র (Intestine) হল প্রায় সবধরনের জীবাণুদের আঁতুড়ঘর। এখানে তারা মহাসুখে জীবনধারণ করে, অন্ত্রের জলপড়া স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশ তাদের বেড়ে ওঠার পক্ষে এক্কেবারে আদর্শ। শুনে অবাক লাগছে তো? তবে এর থেকেও আরও অবাক করা ঘটনা হল আমাদের অন্ত্রে (Intestine) আমাদের অজান্তেই বেড়ে ওঠা এসব জীবাণুদের সংখ্যা নেহাতই কম নয়। সাধারণত মনে করা হয় যে ব্রাজিলের আমাজনের ঘন অরণ্যে থাকা বিভিন্নপ্রকার প্রজাতির চেয়েও বেশি সংখ্যক প্রজাতির অণুজীব পাওয়া যায় আমাদের অন্ত্রে (Intestine) বা বলা ভাল বৃহদন্ত্রে। এবার প্রশ্ন হল, এত বেশি সংখ্যক জীবাণুর উপস্থিতি সত্ত্বেও আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ি না কেন? এর উত্তরও কিন্তু বেশ সোজা, আসলে এই সমস্ত প্রজাতির জীবাণুই আমাদের জন্য খুবই উপকারী, এরা আমাদের থেকে পায় এক নিশ্চিত আশ্রয় আর তার পরিবর্তে এরা আমাদের খাদ্যদ্রব্য থেকে পুষ্টি উপাদান শোষণে আমাদের সাহায্য করে, তবে সবটাই এরা করে নিজেদের বাঁচার তাগিদে। কিন্তু এই উপকারী, প্রকারান্তরে আমাদের দেহের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এই জীবাণু বা বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে মাইক্রোবায়োটা-ও কি না এক গুরুতর দোষে দুষ্ট— অবসাদ বা মানসিক অবসাদ। আজ অবসাদের অন্যতম কারণ হিসেবে এই উপকারী তথা আমাদের চিরসঙ্গী মাইক্রোবায়োটা-কে কাঠগড়ায় তোলা হয়েছে। তবে এই দোষে তারা কতটা দুষ্ট বা আদৌ তারা দোষী কি না সেটাই আজকের আলোচ্য।
অবসাদ
অবসাদ বা মানসিক অবসাদ এই কথাটির সঙ্গে আজ আমরা সবাই পরিচিত, এমনকী আমাদের নিত্যদিনের যাপনে আমরা কোথাও না কোথাও বা কখনও না কখনও এর আভাস পেয়েছি বা বলা ভাল নিজেরাই উপলব্ধি করেছি, কখনও বা কম আবার কখনও বেশি। অবসাদে ভোগেনি এমন মানুষ পাওয়া আজ প্রায় দুষ্কর। যে কোনও কাজে অনীহা, সবসময় হীনমন্যতায় ভোগা, দুঃখযাপন, খিটখিটে মেজাজ ইত্যাদি হল অবসাদের কিছু সাধারণ লক্ষণ। পরিসংখ্যান বলছে, গোটা পৃথিবীর প্রায় ৩.৮ শতাংশ মানুষ আজ এই অবসাদের শিকার। যার মধ্যে বেশিরভাগই হল পরিণত এবং ৬০ বছরের বেশি বয়স্ক মানুষ। সংখ্যায় বলে, সারা পৃথিবী জুড়ে প্রায় ২৮০ মিলিয়ন লোক আজ এই অবসাদের কবলে। তবে এটির সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দিক হল মৃত্যু। সারা পৃথিবী জুড়ে প্রত্যেক বছর প্রায় ৭ লক্ষেরও বেশি মানুষ শুধুমাত্র অবসাদের কবল থেকে বাঁচতে মৃত্যুর পথ বেছে নেয় আর এর মধ্যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে এই পথ বাছাইকারীর প্রায় প্রত্যেকেরই বয়স ১৫-২৯ এর মধ্যে। এই পরিসংখ্যান, এই বয়স সবটাই আমাদের সকলের মাথায় চিন্তার রেখাকে গভীর করে তুলতে যথেষ্ট। মানুষের মনের জটিলতার এই দিক তাবড় বিজ্ঞানীদের পক্ষেও বুঝে ওঠা প্রায় অসম্ভব, তাও চেষ্টা করে যে বিষয়টির সন্ধান পাওয়া গেছে তা হল আমাদের অন্ত্রবাসী (Intestine) কিছু জীবাণুকে নিয়ন্ত্রণের দ্বারা আমরা এই জটিল সমস্যার কিছুটা হলেও সমাধান করতে পারি।
আরও পড়ুন-৭ জানুয়ারি পুরস্কার তুলে দেবেন রাষ্ট্রপতি, রাজ্য বিজেপির মুখে ঝামা
অন্ত্রবাসী জীবাণুদের কীর্তি
কথায় বলে, পেট নাকি মনের রাস্তা— কথাটা যে খুব একটা ভুল তা বলতে পারি না কারণ বিজ্ঞান এর সপক্ষে কিছু যুক্তি দেয়। যেমন, আমাদের দশম করোটীয় স্নায়ু ভেগাস কিন্তু পেটের সঙ্গে মস্তিষ্কের সংযোগ ঘটায়। যা একাধারে পাচনে সহায়তা করে ও অন্যদিকে আবার মস্তিষ্কে থাকা তৃপ্তিদায়ক কেন্দ্রকে যথাসময় নির্দেশ পাঠিয়ে শান্ত করে। আর এই পথের সন্ধান পেয়েই এই অন্ত্রবাসীরা আমাদের মাথার দখল নেয়। সাধারণত এই জীবাণুগুলি খাদ্য থেকে বিপাকীয় ক্রিয়ার দ্বারা কিছু ক্ষুদ্র শৃঙ্খল ফ্যাটি অ্যাসিডের সৃষ্টি করে, যা কি না স্নায়ুগুলি চিনতে পেরে সেই তথ্যনির্দেশ মস্তিষ্কে প্রেরণ করে, এবং মস্তিষ্ক সেই তথ্য অনুযায়ী পাচন ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই ক্ষুদ্র শৃঙ্খল ফ্যাটি অ্যাসিডগুলি হল যথাক্রমে অ্যাসিটেট, বিউটারেট ও প্রোপিয়োনেট এবং এই অ্যাসিড সংশ্লেষকারী কিছু জীবাণু হল ফেকালি ব্যাকটেরিয়া বা কপ্রোকক্কাস ব্যাকটেরিয়া ইত্যাদি, যা অন্ত্রে এই অ্যাসিডগুলির মাত্রা বজায় রাখার দ্বারা আমাদের অন্ত্র তথা মস্তিষ্কের ভারসাম্য বজায় রাখে। কারণ এই অ্যাসিডগুলির অভাবে মানসিক অবসাদ দেখা দেয়। সাধারণত এই ক্ষুদ্র শৃঙ্খল ফ্যাটি অ্যাসিডগুলি মস্তিষ্কের কার্যকারিতার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উপাদান নিউরোট্রান্সমিটার সংশ্লেষে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পালন করে, এরা রক্ত-মস্তিষ্ক ব্যবধায়ক পর্দা(মস্তিষ্কের অন্দরমহলের দরজা) অতিক্রম করে মস্তিষ্ক মেরুরসে প্রবেশ করে এবং ট্রিপ্টোফ্যান হাইড্রক্সিলেজ ১ নামক উৎসেচক সংশ্লেষ করে যা কি না সেরোটোনিন তৈরি করে আবার টাইরোসিন হাইড্রক্সিলেজ ডোপামিন, অ্যাড্রেনালিন প্রভৃতি নিউরোট্রান্সমিটার সংশ্লেষে অংশ নেয়। বলা বাহুল্য এই সমস্ত নিউরোট্রান্সমিটার আমাদের মস্তিষ্কের স্বাভাবিক ক্রিয়াশীলতার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। তবে গোল বাধে অন্য স্থানে, কোনও কারণে মূলত ডিসবায়োসিসের জন্য যদি এই মাইক্রোবায়োটাগুলির সামঞ্জস্যে ব্যাঘাত ঘটে তবে তারা রূপ পাল্টে হয়ে ওঠে ভয়ঙ্কর, ফলস্বরূপ তারা তাদের নিঃসৃত বিভিন্ন পদার্থের মাধ্যমে আমাদের ক্ষতি করতে থাকে। আর এই ক্ষতির অন্যতম নমুনা হল অবসাদ। তবে এই ভোল বদলের জন্যে কি শুধুমাত্র এইসমস্ত জীবাণুগুলিই দায়ী? একটু তলিয়ে ভাবলে দেখা যায়, এর জন্য কোনও না কোনওভাবে দায়ী আমাদের রোজকার জীবনযাপন। খাদ্যে শাকসবজির অভাব, অতিরিক্ত টেনশন, মানসিক চাপ, শারীরিক স্থবিরতা এই সকল কারণে ধীরে ধীরে উপকারী জীবাণুগুলি তাদের স্বাভাবিক কর্মদক্ষতা হারাতে থাকে আর ক্রমেই তার স্থান দখল করে অপকারী জীবাণু, যা দেহে প্রদাহজনিত বিভিন্ন বিক্রিয়ার সৃষ্টি করায়, অন্ত্রও (Intestine) নিজের কাজ থেকে অব্যাহতি নেয় আর মানব মস্তিষ্ককে ঘিরে ধরে অবসাদ।
মুক্তির উপায়
অবসাদে ভোগা মানুষের মৃত্যুমিছিল রুখতে, অকালে অ্যান্টি ডিপ্রেসেন্ট বড়িকে অবলম্বন করে সারাজীবন বাঁচার লড়াই চালিয়ে যাওয়ার হাত থেকে মুক্তি পেতে– খুব বেশি নয়, কাজের ফাঁকে একটু সময় বের করে হালকা ব্যায়াম করে নেওয়া, শাকসবজি একটু বেশি করে খাওয়া, মানসিক চাপ কমাতে কিছুক্ষণ হলেও প্রাণায়াম করা বা পারতপক্ষে হালকা মিউজিক বা গান শোনা, যতটা হোক সময় মেনে আহার গ্রহণ করা ইত্যাদি করলে অন্তত সবটা না হোক কিছুটা হলেও অবসাদের খাঁড়ার কোপ থেকে আমরা রেহাই পেতে পারব। সবশেষে একটা কথা না বললে হয়তো এই আলোচনা সম্পূর্ণতা পাবে না, তা হল, মস্তিষ্ক বাঁচাতে চাইলে আমাদের সবার আগে পেটের যত্ন নিতে হবে, নিতেই হবে।