বিরক্তিকর পেটের ব্যামো

আমাদের দেশে পেটের সমস্যা নেই এমন মানুষ কমই আছেন। যার মধ্যে অন্যতম হল ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম বা আইবিএস। আয়ুর্বেদের পরিভাষায় যাকে বলে ‘গ্রহণী’ রোগ। যে কোনও বয়সেই হতে পারে এই রোগ তবে তুলনামূলক ভাবে বয়স্করা বেশি ভোগেন এতে। কেন হয় আইবিএস? এর নিরাময়ই বা কী? বললেন শ্যামাদাস বৈদ্য শাস্ত্রপীঠের বিশিষ্ট আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক ও শিক্ষক ড. প্রদ্যোতবিকাশ কর মহাপাত্র। লিখেছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

আইবিএস বা ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম অর্থাৎ যেখানে বাওয়েল ইভাকুয়েশন বা মলত্যাগ-সংক্রান্ত ও অন্ত্রগত যে ইরিটেশন অনুভুত হয়। এটি এক ধরনের পেটের সমস্যা, যেখানে অনিয়মিত মলত্যাগ বা কখনও কোষ্ঠকাঠিন্য আবার কখনও তরল মল সঙ্গে পেটফাঁপা, ব্যথা ইত্যাদি অন্ত্রগত অস্বস্তি ক্রমাগত লেগে থাকে। আয়ুর্বেদে ‘বাতজ গ্রহণী’ নামে যে রোগটি পরিচিত আছে তার লক্ষণ এই আইবিএস-এর অনুরূপ। আয়ুর্বেদের পরিভাষায় ‘গ্রহণী’ হল স্টমাক থেকে স্মল ইন্টেস্টাইন বা ক্ষুদ্রান্তের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত অংশ, তার মধ্যে এক অংশে ষষ্ঠী পিত্তধরা কলা নামে একটি কলা থাকে যা আমাদের সব রকম পাচনক্রিয়ায় অংশ নেয় ও সেখানেই অগ্নি উৎপন্ন হয়। সেই জায়গায় যখন বিকৃতি হয় তখন অগ্নিবলেরও বিকৃতি হয় যাকে আয়ুর্বেদে আমরা বলি গ্রহণী দোষ। অর্থাৎ ঠিকমতো পাক না হওয়া। যেসব খাদ্য আমরা গ্রহণ করি তার যদি সঠিক পাক হয় তবেই তার অ্যাসিমিলেশন ঠিকমতো হবে এবং পরের ধাপে অ্যাবজর্বশনও ঠিকমতো হবে। কিন্তু যদি তা না হয় অর্থাৎ ডাইজেশনের সমস্যা হয় তাহলে খাদ্য পাচিত হবে না ফলে ঠিকমতো শোষিত হবে না আর শোষিত না হলে সেইসব খাদ্য শরীর পোষণের কাজে না লেগে মলের আকারে বেরিয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে অগ্নিবল কমার সঙ্গে সঙ্গে শরীরের বলও হানি হয়। রোগী ক্রমশ মলত্যাগ নিয়ে অস্বস্তি ও নানান পেটজনিত সমস্যায় ভুগতে থাকে। কখনও থাকে কোষ্ঠকাঠিন্য আবার দেখা যায় তিন-চার দিন পরে লুজমোশন শুরু হয়ে যাওয়া। এই ধরনের একটা সমস্যা প্রায়শ লেগে থাকে, যাকে আমরা ম্যাল অ্যাবজর্বশন সিনড্রোমের সঙ্গে তুলনা করতে পারি।

আরও পড়ুন-নির্বাচনী ইস্তেহার প্রতিশ্রুতি নয়, প্রতিজ্ঞা: অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়

সাধারণ উপসর্গ
তলপেটে ব্যথা হয়, অনেকক্ষেত্রে মলত্যাগের পর সেই ব্যথা কমে যায়।
খাবার পর অস্বস্তিবোধ।
পেট ফেঁপে যাওয়া।
ঘন ঘন বাথরুমে ছোটা অথচ মলত্যাগ করে তৃপ্ত না হওয়া।
ডায়েরিয়া অথবা কোষ্ঠকাঠিন্য দুই একসঙ্গে থাকে। এর সঙ্গে শারীরিক দুর্বলতা থাকে।
মাথাব্যথা হয় ও বমিভাব হতে পারে।
ক্ষুধামান্দ্য হয়।
চিকিৎসা
আয়ুর্বেদ অনুযায়ী চিকিৎসা করতে হলে আমাদের পাচক অগ্নি অর্থাৎ আমাদের স্টমাকে যে সিক্রেশন বিশেষ করে অ্যাসিড পেপসিন নিঃসরণ হয় তাকে নর্মালাইজ করতে হবে। কিন্তু এখন বেশিরভাগ মানুষ অত্যধিক ফাস্টফুডে আসক্ত, গুরুপাক অর্থাৎ যা সহজপাচ্য নয় তেমন খাবার খেতেও অভ্যস্ত। এই ধরনের খাবার অগ্নিবল কমিয়ে দেয় ফলে খাদ্য পাচিত হয় না ফলে খাদ্যরস ঠিকমতো শোষিত ও বিয়োজিত হতে পারে না যার জন্য আম বা মিউকাস সঞ্চয় হয় বা যাকে আয়ুর্বেদিক পরিভাষায় আমরা অপক্ব অন্যরস বলি। সেই আম যদি পেটে সঞ্চিত হতে থাকে তখন রোগীর একটা ক্রনিক সমস্যা একটানা থেকেই যায়। কবিরাজি মতে, জীবনশৈলীর পরিবর্তন যদি করা যায় সঙ্গে ঠিকমতো ওষুধ নিলে রোগী ভাল এবং সুস্থ থাকবে।
আয়ুর্বেদ দুটো বিষয়ের উপর গুরুত্ব দিয়েছে— ‘যা হল সুস্থ ব্যক্তির স্বাস্থ্য রক্ষা’ করা বা প্রিভেনশন এবং অপরটি হল অসুস্থ ব্যক্তির রোগ নিরাময় করা বা ট্রিটমেন্ট। আমরা জানি ‘প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিওর’ কাজেই আগে থাকতে নিয়ম মেনে চললে সমস্যা তৈরিই হবে না।

আরও পড়ুন-প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজ: রেড রোডে শেষ চূড়ান্ত মহড়া, বিশেষ আকর্ষণ কী?

ডুজ অ্যান্ড ডোন্টস
অনেকক্ষণ খালি পেটে না থাকা।
অতিভোজন না করা।
গুরুপাক বা হজম করা কঠিন এমন খাদ্য না খাওয়া।
পূর্বাহার হজম না হওয়া অবস্থায় আবার খাবার খাওয়া।
কাঁচা, সুসিদ্ধ না হওয়া অর্থাৎ অপক্ব খাবার।
বাইরের খাবার বেশি নয়। বাসি খাবার বজর্ন করতে হবে।
অতি-শুকনো, অতি-অম্ল, অতি-কটু বা ঝাল খাবার খাবেন না। জাঙ্ক ফুড, ফার্মেন্টেড ফুড বর্জন করতে হবে। তাহলে রোগের আশঙ্কা কম হবে। আমাদের অন্ত্রস্থ পাচকাগ্নি বা জঠরাগ্নিকে প্রিজার্ভ করাটা বাঞ্ছনীয়।

আরও পড়ুন-কাল নিলাম

কথায় কথায় অ্যান্টাসিড
মুড়ি-মুড়কির মতো অ্যান্টাসিড দিনের পর দিন খেলে আমাদের শরীরে পাচকরস সিক্রেশন কমিয়ে দেয় তখন আমাদের অগ্নিবল কমে যায়। সঠিক কারণ না বুঝেই ওগুলো খেলে মন্দাগ্নিতে ভোগা শুরু হবে অর্থাৎ হজমক্ষমতা বলে কিছু থাকবে না।
ফলে শরীরে মলসঞ্চয় হবে। রোগ শরীর থেকে মনে ছড়িয়ে যাবে। সেই কারণে আইবিএস রোগীরা দৈহিক বিকারের পাশাপাশি স্নায়বিক এবং মানসিক বিকারে ভোগেন।
দাওয়াই
আমলকি, হরীতকী, শুকনো আদা, সৈন্ধব লবণ, জিরে, যমানী, বেলশুঁঠ, মুথা, ইসবগুল ইত্যাদি ভেষজকে আয়ুর্বেদে বিভিন্নভাবে এই রোগের নিরাময়ে ব্যবহার করা হয়েছে।

আরও পড়ুন-চড়ছে তাপমাত্রার পারদ, রাজ্যে বাড়বে গরম?

আইবিএস কোষ্ঠকাঠিন্য এবং ডায়েরিয়াভিত্তিক রোগ। সাধারণত দু’ধরনের চিকিৎসা হয়— মূল কাজ হল অগ্নিবল বাড়ানো। এক্ষেত্রে লবণ ভাস্কর চূর্ণ বা ভাস্কর লবণ বড়দের তিন গ্রাম করে দু’বার এবং ছোটদের ক্ষেত্রে দেড় গ্রাম করে দু’বার দুপুরে- রাত্রে খাওয়ার পর খেতে হবে। অগ্নিমুখ চূর্ণ বড়দের তিনগ্রাম করে দু’বার এবং ছোটদের একগ্রাম বা দেড়গ্রাম করে দু’বার খাওয়ার পর দেওয়া যাবে। অনিয়মিত মলত্যাগ হলে বিল্লাদিচূর্ণ শাস্ত্রীয় ঔষধ এটা তিনগ্রাম করে দু’বার সকাল-সন্ধ্যা দেওয়া যেতে পারে। যাদের হাইপ্রেশার তাঁদের আইবিএস-এর সমস্যায় স্বল্প অগ্নিমুখ চূর্ণ দেওয়া যেতে পারে। চতুঃসম অর্থাৎ হরিতকী, সৈন্ধব, শুট আর জোয়ান— এই দিয়ে তৈরি করা ওষুধ সমমাত্রায় নিয়ে পাউডার করে দুপুরে ও রাতে খাওয়া যেতে পারে। বড়দের তিনগ্রাম, ছোটদের এক থেকে দেড়গ্রাম। যাঁদের প্রচণ্ড কোষ্ঠকাঠিন্য তাঁদের শোবার সময় পথ্যাদি ও বিরেচণচূর্ণ মিশিয়ে রাতে তিন থেকে পাঁচগ্রাম দেওয়া যেতে পারে। পেট ফাঁপা এবং মাঝেমধ্যেই ডায়েরিয়া হচ্ছে তাঁদের ক্ষেত্রে চিত্রকাদি বোটি, মহাশঙ্ক বোটি দুটো করে এবং ছোটদের একটি করে বোটি দিলে খুব ভাল ফল পাওয়া যাবে।

Latest article