মূল সংসদ ভবনের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৯২৭-এ। এটা হল সেই দুটি বৃত্তাকার ভবন, যা এতদিন ধরে আমরা দেখে আসছিলাম, বাইরে থেকে। ১৯৫৬-তে আরও দুটি তল যুক্ত হয় সেটির সঙ্গে। আরও কর্মী আর আধিকারিকদের বসার ব্যবস্থার জন্য। ১৯৭৫-এ সংসদের অ্যানেক্স ভবনটি নির্মিত হয় একই প্রয়োজনে। ২০০২-তে এই সংসদ চত্বরেই সংযুক্ত হয় গ্রন্থাগার। ২০১৬-তে অ্যানেক্স ভবনটি আরও বড় করা হয়।
আজ থেকে অতীতের এসব সংযোজন, পরিমার্জন ধূলিসাৎ করে দিয়ে নবনির্মিত একটি ভবন হবে আমাদের সংসদ।
আরও পড়ুন-বিদ্যুতের উন্নয়নে ১২ হাজার কোটি
এই নতুন ভবনটিকে আমরা, ভারতের জনগণ, আগের মতো একই প্রত্যয়ে ও সাংবিধানিক প্রণোদনায় ‘আমাদের’ বলতে পারব কি না, তা নিয়ে সংশয় ও সন্দেহ কিন্তু থেকেই যাচ্ছে।
থেকেই যাচ্ছে, কারণ মদীয় প্রধানমন্ত্রী মোদিজি প্রবল অহমিকাবশে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুকে ঠেলে সরিয়ে এই নয়া ভবনের উদ্বোধনের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। সংবিধানের ৯ নং ধারায় স্পষ্ট ভাবে বলা আছে, দুটি কক্ষ— রাজ্যসভা ও লোকসভা এবং রাষ্ট্রপতিকে নিয়ে সংসদ গঠিত। অর্থাৎ, রাষ্ট্রপতি সংসদের দুটি কক্ষের কোনওটির সদস্য না হয়েও সংসদের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। প্রধানমন্ত্রী কিন্তু তা নন। অথচ, নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধনে প্রধানমন্ত্রী প্রধান মুখ, রাষ্ট্রপতি উপেক্ষিত। এটা আমাদের চেনা গণতান্ত্রিক চেতনায় সরাসরি আঘাত। এর আগে ১০ ডিসেম্বর, ২০২০-তে যখন নতুন ভবনের ভূমিপূজোতে ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনে প্রধান মুখ ছিলেন প্রধানমন্ত্রী, তখনই আমাদের ব্যাপারটা বোঝা উচিত ছিল।
আরও পড়ুন-বিশ্বকাপের কমিটি, সূচি ঘোষণা পরে
লক্ষণীয় এবং আদৌ উপেক্ষণীয় নয়, ২০২০-তে ভারতের রাষ্ট্রপতি ছিলেন রামনাথ কোবিন্দ। জাতি পরিচয়ে তিনি ছিলেন কোলি। ব্রিটিশ ভারতে ক্রিমিনাল ট্রাইবস অ্যাক্টে কোলিদের অপরাধপ্রবণ উপজাতি হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছিল। স্বাধীন ভারতে ভারত সরকার গুজরাত, কর্নাটক, মহারাষ্ট্র ও উত্তরপ্রদেশে কোলিদের অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণিভুক্ত করেছেন। তবে, মহারাষ্ট্রে তোকরে কোলি, মালহার কোলি ও মহাদেব কোলিরা তফসিলি উপজাতির আওতায় পড়েন। ২০০১-এর আদমশুমারি মোতাবেক দিল্লি, মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থানে তফসিলি জাতিভুক্ত বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
আরও পড়ুন-সেরাটাই দেব, ট্রফি নিয়ে ভাবছি না: হার্দিক
সব মিলিয়ে একটা কথা পরিষ্কার, নতুন সংসদ ভবনে ভিতপুজোর সময় যিনি ভারতের রাষ্ট্রপতি ছিলেন, তিনি নিম্নবর্ণের প্রতিনিধি ছিলেন। এবং এখন নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধনের সময় যিনি ভারতের রাষ্ট্রপতি, তিনি সাঁওতাল। অর্থাৎ আদিবাসী সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি। নয়া সংসদ ভবনের জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান ও আড়ম্বরে, দু’জনেই ব্রাত্য। কী অদ্ভুত সমাপতন।
আমরা এই নতুন সংসদীয় গঠন ও নির্মাণ নিয়ে সংশয়ী ও সন্দিহান কারণ, ভারতের কুস্তি সংস্থা ডব্লুএফআই-এর সভাপতি তথা ভারতীয় জনতা পার্টি, দেশের শাসক দলের সাংসদ ব্রিজভূষণ অযোধ্যার সন্ত সভার আওয়াজের অনুরণন তুলে বলছেন, পসকো আইন ভারতীয় সমাজের কাছে ক্যানসারস্বরূপ। এই ‘ভদ্রলোক’টি নাবালিকা-সহ অন্যান্য মহিলা কুস্তিগিরদের উপর যৌন হেনস্থা চালানোর দায়ে অভিযুক্ত। সাক্ষী মালিক, বিনেশ ফোগত, বজরং পুনিয়ার মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কুস্তিগিরেরা এই ‘ভদ্রলোক’টির বিরুদ্ধে আন্দােলন চালাচ্ছেন ২৩ এপ্রিল থেকে। মাসাধিক কালব্যাপী এই আন্দোলনের জেরে কুস্তি ফেডারেশনের সভাপতির বিরুদ্ধে পসকো আইনে মামলা রুজু করার নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। গত ২৮ এপ্রিল দিল্লি পুলিশ এই ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে দুটি এফআইআর দায়ের করেছে, যার মধ্যে একটি দায়ের করা হয়েছে পসকো আইনে।
আরও পড়ুন-অগণতান্ত্রিক অধ্যাদেশ বাতিল করুন, দাবি কেসিআরের
শিশুদের যৌন হেনস্থার থেকে বাঁচানোর জন্য প্রণীত হয়েছিল প্রোটেকশন অব চিলড্রেন ফ্রম সেক্সুয়াল অফেন্সেস অ্যাক্ট। সংক্ষেপে এটিই পসকো আইন নামে পরিচিত।
এর পাশাপাশি আরও একটি আইনের ধারায় বদল আনার দাবি তুলেছেন ব্রিজভূষণ। নাম উল্লেখ না করে বিষোদ্গার করেছেন যে আইনটির বিরুদ্ধে, সেটি হল সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট অব উইমেন অ্যাট ওয়ার্ক প্লেস (প্রিভেনশন, প্রোহিবিশন অ্যান্ড রিড্রেসাল) অ্যাক্ট। সংক্ষেপে এটি পোশ আইন নামে পরিচিত।
ব্রিজভূষণের দাবি, এই আইনের অপব্যবহারের ভয়ে বেসরকারি সংস্থার কর্তারা মহিলা কর্মীদের নিয়োগ করতে চান না। ফলে, শেষ বিচারে, ভুগতে হচ্ছে মহিলাদেরই।
আরও পড়ুন-ফের বিভাজনের নীতির ছায়া শিক্ষাক্ষেত্রে, উর্দু কবি ইকবালের জীবনী বাদ দিচ্ছে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়
২৫ মে বাহারাইচের এক জনসভায় ভাষণ দেওয়ার সময় উল্লিখিত বক্তব্য পেশ করেন ব্রিজভূষণ একেবারে চাঁচাছোলা হিন্দি ভাষায়। উল্টোদিকে ধরনারত প্রতিবাদী কুস্তিগির বিনেশ ফোগতকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তিনি আজকের অর্থাৎ রবিবারে নয়া সংসদ ভবন উদ্বোধন নিয়ে কিছু বলতে চান কি না। সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে বিনেশ দিল্লির যন্তরমন্তরে বসে গত শুক্রবার (২৬ মে) সাফ জানিয়েছেন, ‘যদি সংসদ ভবনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ব্রিজভূষণ উপস্থিত থাকেন, তবে সেটাই সমগ্র দেশের কাছে একটা বিশেষ বার্তা হিসেবে পরিগণিত হবে।’
দৌপদী মুর্মু ব্রাত্য, ব্রিজভূষণ শরণ সিং আমন্ত্রিত সাংসদ। বিষয়টা অবশ্যই বিশেষ বার্তাবহ। এই আবহে আরও একটি লক্ষণীয় কিন্তু উপেক্ষণীয় নয় এমন বিষয়।
আরও পড়ুন-কেন্দ্রের রিমোট আছে, ইভিএমের বোতাম আছে আপনাদের : অভিষেক
গত ২১ মে দিল্লিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ‘দ্য ট্রিটিজ অন ইন্ডিয়ান সেন্সাসেস সিন্স ১৯৯১’ ঘটা করে প্রকাশ করেছেন। তাতে দেখা যাচ্ছে, আদমশুমারিতে কেবল ছটি ধর্মের পৃথক অস্তিত্বের কথা স্বীকার করা হবে। জনজাতি, উপজাতিদের দাবি সত্ত্বেও সেই তালিকায় নেই সরনা ধর্ম। অরণ্য উপাসক আদিবাসী সম্প্রদায়ের ধর্ম। ঝাড়খণ্ড, ছত্তিশগড় এবং ওড়িশার আদিবাসী সমাজের একটা বড় অংশ এই সরনা ধর্মাবলম্বী। বিশেষ করে মুণ্ডা সম্প্রদায়ের মানুষ এই ধর্ম অনুসরণ করেন। ২০১১-তে টাইমস অফ ইন্ডিয়ায় প্রকাশিত একটি সংবাদ জানাচ্ছে, তফসিলি উপজাতিদের জন্য গঠিত জাতীয় কমিশন সরনাকে পৃথক ধর্মের মর্যাদা দেওয়ার সুপারিশ করেছিল। কিন্তু তাদের হিন্দু ধর্মের স্রোতে ভিড়িয়ে দেওয়ার তাগিদে এ-সংক্রান্ত যাবতীয় দাবি ও সুপারিশকে অগ্রাহ্য করল গেরুয়া সরকার।
এর পরেও কীভাবে নিঃসংশয়ে, বলিষ্ঠ গর্বিত কণ্ঠে বলব, এ হল আমাদের সংসদ।
সংশয়ের মেঘ দীর্ণ করছে এতদিন ধরে লালন করে আসা প্রত্যয়।
আরও পড়ুন-ইউক্রেনের হাসপাতালে রুশ মিসাইল হামলা, মৃত ২
সোরেন কিয়েরকেগার্দ ছিলেন উনিশ শতকের ডেনমার্কে ধর্মতত্ত্ববিদ। এই দার্শনিক বলতেন, দুভাবে বোকা বানানো যায়। একটা হল, যেটা সত্যি সেটাকে বিশ্বাস না করা।
অপরটি হল যেটা সত্যি সেটাকে সত্য বলে মেনে নিতে অস্বীকার করা।
আজ নবনির্মিত সংসদ ভবনের উদ্বোধনে গর্বিত বোধ করলে আমরা নিজেদের কীভাবে বোকা বানাব, সেটা যদি একটু বলে দেন নরেন্দ্র মোদি, তবে বড় ভাল হয়।