গতকাল অন্তর্বর্তীকালীন বাজেট পেশ করলেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে। এই বাজেটে, কার্যত, ভোটের প্রাক্কালে শুধুমাত্র আগামী ৩/৪ মাসের খরচ বরাদ্দ পেশ করার কথা থাকলেও বাস্তবে ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষের পূর্ণাঙ্গ বাজেটই পেশ করলেন শ্রীমতী নির্মলা সীতারামন। সেখানে তিনি গত ১০ বছরের মোদি সরকারের কৃতিত্ব তুলে ধরলেন। বলা হল, গত ১০ বছরে মোদি সরকার ২৫ কোটি মানুষকে দারিদ্র্য থেকে বের করে এনেছেন। অনেক কিছুর মধ্যে আরও বলা হল। জনগণের প্রকৃত আয় গত ১০ বছরে ৫০ শতাংশ বেড়েছে, জনধন অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ৩৪ লক্ষ কোটি টাকা সরাসরি মানুষের হাতে হস্তান্তর করা গিয়েছে, মুদ্রাস্ফীতি সীমাবদ্ধ, বিনামূল্যে রেশন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি ইত্যাদি ক্ষেত্রে উন্নতি অনেক বেশি। আরও বলা হল ২০৪৭ সালের মধ্যে দেশ ‘বিকাশিত ভরত’-এ পরিণত হবে। আমাদের লক্ষ্য সবকা সাথ, সবকা বিকাশ, সবকা বিশ্বাস। এছাড়া বলা হল, বাজপেয়ীর আমলে স্লোগান ছিল : জয় জোয়ান, জয় কৃষাণ ও জয় বিজ্ঞান। এবার স্লোগান হবে : (মোদি সরকারের) জয় জোয়ান, জয় কৃষাণ, জয় বিজ্ঞান এবং জয় অনুসন্ধান।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর চরিত্রহীন উপন্যাসে লিখেছিলেন: ‘‘মিথ্যা পাপ, কিন্তু মিথ্যায়-সত্যে জড়িয়ে বলার মত পাপ সংসারে অল্পই আছে।’’ আসলে মোদি সরকারের কৃতিত্ব অনেকাংশে ফাঁকা আওয়াজ ও মিথ্যার ফুলঝুরি।
মোদির আমলে গত ১০ বছরে যে ২৫ কোটি মানুষকে দারিদ্র্য থেকে মুক্ত করা গেছে এমন কোনও বলিষ্ঠ তথ্য মোদি সরকার এখনও প্রমাণ করতে পারেনি। এ ছাড়া জনধন অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে বলা হচ্ছে ৩৪ লক্ষ কোটি টাকা সরাসরি হস্তান্তর করা গেছে। কিন্তু সমীক্ষা থেকে বলা হচ্ছে যারা হাতে পেয়েছে তাদের সিংহভাগই এর সাফল্য থেকে কার্যত বঞ্চিত। অধিকন্তু স্বাস্থ্যে এবং পুষ্টিতে যদি এত উন্নতি হয়ে থাকে তাহলে ২০২৩ সালের বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ১২৫টি দেশের মধ্যে কেন ভারতের স্থান (নিম্নের ক্রমপর্যায় থেকে শুরু করে) ১১১তম? এমনকী শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রগতির সূচক বাড়েনি।
সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৯-এ দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর প্রথম দু’বছরে মোদি সরকার মোট খবরের ২.৪ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করেছিল। শেষ তিন বছরে তা ২ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। গতকালের বাজেট থেকেই দেখা যাচ্ছে বর্তমান বছরের সংশোধিত বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় ৭৯,২২১ কোটি টাকা, যেখানে বাজেটের মোট ব্যয় ৪৪,৯০,৪৮৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ বর্তমান বছরে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় হচ্ছে বাজেটের সংশোধিত মোট ব্যয়ের মাত্র ১.৭৬ শতাংশ। অথচ বলা হচ্ছে মোদির সময়ে মানুষের স্বাস্থ্য ও পুষ্টির ক্ষেত্রে যথেষ্ট উন্নতি ঘটেছে। কার্যত অসত্যের পরিসংখানে ভরা।
শিক্ষাক্ষেত্রেও অবস্থা একই। ২০১৯ সালে মোদি সরকার দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পরে প্রথম দু বছরে বাজেটের মোট ব্যয়ের ৩.৩ শতাংশ খরচ হলেও এখন তা ২.৫-এর ঘরে। গতকালের বাজেট থেকেও দেখা যাচ্ছে বর্তমান বছরের সংশোধিত বাজেটে শিক্ষা ক্ষেত্রে মোট ব্যয় ১,০৮,৮৭৮ কোটি টাকা, যা বর্তমান বছরে বাজেটে সংশোধিত মোট ব্যয়ের মাত্র ২.৪২ শতাংশ।
সরকারি মূলধনী ব্যয় নিয়ে কোভিডের পর থেকে ব্যাপকভাবে ঢাক পেটানো হচ্ছে যে মোদি সরকারে আমলে সরকারিভাবে মূলধনী খাতে ২০২২, ২০২৩ ও ২০২৪ অর্থবছরের মতো অতীতে কোনও বছরই এমন বিশাল অঙ্কের অর্থ খরচ করা হয়নি। আসলে এটাও একটা বিভ্রান্তি। ২০২২, ২০২৩, ২০২৪ অর্থবছরে মোদি সরকারের আমলে মূলধনী খাতে ব্যয় যথাক্রমে জিডিপি’র ২.৫ শতাংশ, ২.৭ শতাংশ ও ৩ শতাংশ। ২০২৪ অর্থবছরে মূলধনী ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ লক্ষ কোটি টাকা, কিন্তু সংশোধিত বাজেটে এই অঙ্ক কমে দাঁড়িয়েছে ৯ লক্ষ ৫০ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু অন্য আরেকটা বিষয় মোদি সরকার সামনে আনছে না। সেটা হল সরকারি ক্ষেত্রের প্রতিষ্ঠানগুলোতে (Public sector Enterprises) বিনিয়োগের অঙ্ক। সরকারি ক্ষেত্রের প্রতিষ্ঠানগুলোয় বিনিয়োগ প্রতি বছর ১০ থেকে ২০ লক্ষ কোটি টাকার মতো বাস্তবায়িত হত পূর্বে। এটা মোদির আমলে প্রতি বছর শোচনীয়ভাবে কমেছে। অর্থাৎ ৩ বছর ধরে সরকারিভাবে যে পরিমাণ মূলধনী বিনিয়োগ ঘটছে, অন্যদিকে প্রায় একই অঙ্কের সরকারি ক্ষেত্রের প্রতিষ্ঠানগুলির বিনিয়োগের অঙ্ক হ্রাস পাচ্ছে। এর নিট ফল হল কার্যত মোদির আমলে ৩ বছর ধরে নিট মূলধনী বিনিয়োগ বাড়ছে না। রিজার্ভ ব্যঙ্কের তথ্য থেকেই এটা স্পষ্ট। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তথ্য থেকেই দেখা যাচ্ছে যে, একদিকে মোদির আমলে নিট মূলধনী বিনিয়োগ কার্যত বাড়ছে না এবং অন্যদিকে নিট আর্থিক পারিবারিক সঞ্চয় ২০২৩ সালে গত ৫ দশকের চেয়ে কম। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ভারত নিট আর্থিক পারিবারিক সঞ্চয় জিডিপির মাত্র ৫.১ শতাংশ যা গত ৫০ বছরে সর্বনিম্ন। মোদির আমলে চাহিদার অবস্থা এত নিম্নস্তরে এসেছে যে যাতে সঞ্চয় শোচনীয়ভাবে নেমে গেছে। এর ফলে বিনিয়োগ কমেছে। উৎপাদনও কমছে। ফলে বেকারত্ব চরমভাবে বাড়ছে। আর এর ফলে মোদির আমলে গত ৫০ বছরের মধ্যে বেকারত্ব সর্বোচ।
বেকারত্বের আসল সত্যটা স্বীকার না করে কর্যত মিথ্যা ঢাক পেটাচ্ছে বর্তমান মোদি সরকার। এর সঙ্গে মুদ্রাস্ফিতির তীব্রতাও বাড়ছে। বর্তমানে যা প্রায় ৬ শতাংশের মতো। গত এক বছরে আনাজের দাম বেড়েছে ১৫ থেকে ৬০%। কাজ নিয়ে উদ্বেগ এক-তৃতীয়াংশ লোকের। অথচ সমৃদ্ধি বলেও বর্তমান বাজেটে জিগির তোলা হয়েছে। মূলত ৭ শতাংশের জিডিপি সমৃদ্ধির হারের দাবিদার মূলত ভারতের উচ্চবৃত্তের মাত্র ১ শতাংশ লোক।
এই বাজেট থেকে আরও দেখা যাচ্ছে আগত বছরে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পেও বরাদ্দ কার্যত বাড়েনি বললেই চলে। প্রধানমন্ত্রী সতক যোজনা, কৃষি সম্মাননিধি, স্বচ্ছ ভারত মিশনে বর্তমান বছরের বাজেট এস্টিমেটের চেয়ে এক কানাকড়িও বাড়েনি। ১০০ দিনের প্রকল্পে বর্তমান বছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় এক কানাকড়িও বাড়েনি। আগামী বছরে যে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে তার সিংহভাগ অংশই সুদ দিয়ে খরচ হচ্ছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যক্ষেত্রেও বৃদ্ধির হার নগণ্য। কর্যত, নির্বাচনের প্রাক্কালে মোদি সরকারের বাজেট বক্তৃতা যতই ঢাক পেটাক না কেন দেশে বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি, আর্থিক মন্দা ও শূন্য কর ছাড়ের তীব্রতা এই বাজেটে স্পষ্ট।
পুরোটাই ফাঁকিবাজি
মিথ্যা পাপ, কিন্তু মিথ্যায় সত্যে জড়িয়ে বলার মতো পাপ সংসারে অল্পই আছে। শরৎচন্দ্রের লেখা কথাগুলো যে কতটা সত্যি, সেকথা বুঝিয়ে দিল মোদি সরকারের এবারের অন্তর্বর্তীকালীন বাজেট। লিখছেন অর্থনীতিবিদ ড. দেবনারায়ণ সরকার