ষোলো বছর বয়সে জন্মস্থান বেলিয়াতোড় থেকে কলকাতায় চলে আসেন যামিনী রায়। ভর্তি হন আর্ট কলেজে। তারপর আর মহানগরী ছেড়ে যাননি। উত্তর কলকাতার বাগবাজারে ছিলেন দীর্ঘদিন। ভাড়া বাড়িতে। ১৯৪৯ সালে সেই বাড়ি ছেড়ে চলেন আসেন দক্ষিণ কলকাতার বালিগঞ্জ প্লেসে। নিজের বাড়িতে। নিজের বাড়ি ছিল তাঁর বহুদিনের স্বপ্ন। দেরি হলেও, সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছিল। শিল্পী মানুষ। ততদিনে তিনি বিশ্ববরেণ্য। তার বহু আগেই, ১৯৩০ সালের প্রথম দিকে, পটুয়া শিল্পকে কেন্দ্র করে শহরের শিল্পজগতে তৈরি করেছিলেন নিজের স্থায়ী জায়গা। তাঁর আঁকা ছবি প্রদর্শিত হয়েছে কলকাতায় রাস্তায়। মুগ্ধ করেছিলেন সমঝদার থেকে সাধারণ মানুষকে। এইভাবেই তিনি চিত্রশিল্পকে জাদুঘরের দেওয়াল থেকে মধ্যবিত্তের গৃহস্থালিতে পৌঁছে দিয়েছিলেন। তাঁর শিল্পের সন্ধান পেয়েছিল পাশ্চাত্য দুনিয়াও। যদিও ফিরিয়ে দিয়েছিলেন বিদেশের আমন্ত্রণ।
আরও পড়ুন-মধ্যাহ্ন ভোজন
সেই তিনি, বিশ্ববরেণ্য চিত্রশিল্পী যামিনী রায়, ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে বাড়িটি সাজিয়ে তোলেন। মনের মাধুরী মিশিয়ে। একেবারে ছবির মতো। যেমন থাকার ঘর, তেমন আঁকার ঘর। ছিল একটি বাগান। খুব বড় নয়। মাঝারি মাপের। সুসজ্জিত। সেখানে ছিল একটি আমগাছ। তার নিচে বসে ছবি আঁকতেন। উজাড় করতেন যা তিনি অর্জন করেছেন।
ছাত্রজীবনে লাভ করেছিলেন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের শিক্ষা। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে পেয়েছিলেন ভাইস-প্রিন্সিপাল হিসেবে। সান্নিধ্য পেয়েছিলেন ইতালীয় শিল্পী গিলার্দি এবং অধ্যক্ষ পার্সি ব্রাউনের। তাঁদের মাধ্যমেই প্রাচ্য-পাশ্চাত্য উভয় শিল্পের কলা-কৌশলের সঙ্গে তিনি সুপরিচিত হয়েছিলেন। পল সেজান, ভ্যান গগ, পাবলো পিকাসো প্রমুখ বিশ্ববিখ্যাত চিত্রশিল্পীর প্রভাব দেখা যেত তাঁর শিল্পকর্মে। কিছুদিন ফার্সি শিল্পীদের মতো ছবি আঁকার চেষ্টা করেছিলেন। তারপর একদিন কালীঘাটের পট দেখে বদলে যায় মন। ধীরে ধীরে খুঁজে পান নিজস্বতা। চলে আসেন মাটির কাছাকাছি। ক্যানভাসের পরিবর্তে ব্যবহার করতেন কাপড় দিয়ে তৈরি উপকরণ। রং প্রস্তুত করতেন খড়িমাটি, ভুসাকালি, ইটের গুঁড়ো, কাজল, লাল সিঁদুর, সাদা খড়ি, আলতা, কাঠ-কয়লা, মাটি, লতাপাতার রস দিয়ে।
আরও পড়ুন-কালিয়াগঞ্জে হামলা ও অশান্তি বিজেপির
সেই গাছটির নিচে বসে আপনমনে ছবি আঁকতেন। দীর্ঘ সময় ধরে। সাধের বাড়িটি ছিল তাঁর বহু সৃষ্টি এবং সুখ-দুঃখের সাক্ষী। সিঁড়িতে পদধূলি পড়েছিল কত বিখ্যাত মানুষের। জমজমাট আড্ডা, গভীর আলোচনা। নিরিবিলি দেয়াল সব জানে।
বালিগঞ্জ প্লেসের বাড়িতে থাকার সময় ১৯৫৪ সালে পেয়েছিলেন ‘পদ্মভূষণ’। ১৯৫৫ সালে সর্বপ্রথম ললিতকলা অ্যাকাডেমি পুরস্কার। পরের বছর ডি-লিট সম্মান।
১৯৭২-এর ২৪ এপ্রিল তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। পঁচাশি বছর বয়সে। আজীবন থেকেছেন মাটির কাছাকাছি। বিচ্ছিন্ন হননি শিকড় থেকে। তবে তাঁর মৃত্যুর পর সাধের বাড়িটি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। বেহাল হয়ে যায় দশা। দীর্ঘদিন পড়ে ছিল অযত্নে, অবহেলায়।
খবর পৌঁছয় দিল্লি আর্ট গ্যালারির কাছে। এই প্রতিষ্ঠান বাড়িটিকে পুরোনো চেহারায় ফিরিয়ে দিতে উদ্যোগী হয়। শিল্পীর পরিবারের কাছ থেকে বাড়িটা কিনে নিয়ে শুরু করে সংস্কার।
আরও পড়ুন-রবিবার রাতেও মিলবে বিশেষ মেট্রো
এইভাবেই দিল্লি আর্ট গ্যালারির ব্যবস্থাপনায় শিল্পী যামিনী রায়ের তিনতলা বাড়িটি ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হতে চলেছে একটি আধুনিক মিউজিয়ামে। মেক্সিকোতে কাসা আজুল নামে একটি জায়গা রয়েছে। দেশ-বিদেশ থেকে সেখানে আসেন ফ্রিদা কাহলোর ভক্তরা। যামিনী রায়ের এই বাড়িকে তেমনই একটি মিউজিয়াম হিসেবে সারা বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে চায় সংস্থাটি।
বাড়ির নিচের তলায় ছিল স্টুডিও। সেখানে প্রদর্শিত হবে শিল্পীর কাজ। বাড়ির বাগানে আমগাছের তলায় তৈরি হবে একটি ঝকঝকে ক্যাফে। শিল্পীর আঁকা ছবি থাকবে বাড়ির উঠোন জুড়ে। প্রথম এবং দ্বিতীয় তলায় তৈরি হবে গ্যালারি। থাকবে লাইব্রেরি, দোকান, ক্যাফেটেরিয়া। বাড়ির খোলা জায়গা ওয়ার্কশপ, লাইভ পারফরম্যান্সের জন্য ব্যবহার করা হবে। বাড়িটাকে এমন ভাবেই সংগ্রহশালায় পরিণত করা হচ্ছে, যাতে রসিক মানুষজন সহজেই শিল্পীর শিল্পকর্ম এবং জীবন সম্পর্কে জানতে পারে। সম্ভবত ২০২৪ সালের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে কাজ এবং সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হবে।
আরও পড়ুন-রিজওয়ানুরের বাড়িতে মুখ্যমন্ত্রী, সঙ্গে ছিলেন অভিষেক-বাবুল
স্বাভাবিক ভাবেই খুশি শিল্পী এবং সংস্কৃতিমহল। তাঁরা মনে করেন, এতদিনে একটা কাজের কাজ হল।
একদিকে আলো, অন্যদিকে অন্ধকার। কলকাতার বাড়িটি সেজে উঠছে, এটা আনন্দের। তবে অযত্নে অবহেলায় পড়ে রয়েছে শিল্পী যামিনী রায়ের বেলিয়াতোড়ের বাড়িটি। ১৮৮৭-র ১১ এপ্রিল বাঁকুড়া জেলার যে-বাড়িতে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন বর্তমানে বাড়িটির করুণ দশা। ফাটল ধরেছে, শ্যাওলা জমেছে, চারপাশে মাথাচাড়া দিয়েছে আগাছা। ভূমিপুত্রের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা রয়েছে বেলিয়াতোড়ের। তাই শিকড়কে অস্বীকার বাড়িয়েছে মনোবেদনা। স্থানীয়দের বক্তব্য, এখানে যামিনী রায়ের নামে আছে কলেজ। প্রতি বছর তাঁর স্মরণে অনুষ্ঠিত হয় জমজমাট মেলা। নানাভাবে চর্চা করা হয় তাঁকে নিয়ে।
আরও পড়ুন-গিরিরাজের নাটক, নিজের চিঠি নিজেকেই ফরোয়ার্ড!
তাঁদের দাবি, বিশ্ববরেণ্য চিত্রশিল্পীর আদি বাড়িটাকে ‘হেরিটেজ’ তকমা দেওয়া হোক। করা হোক সংরক্ষণ। না হলে ভবিষ্যতে কোনওরকম চিহ্ন থাকবে না। দেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে নতুন প্রজন্ম এবং উৎসাহীরা। অবিলম্বে শুরু হোক কাজ।
নতুন রূপে সেজে উঠছে শিল্পী যামিনী রায়ের কলকাতার বাড়ি। বেলিয়াতোড়ের বাড়িটির ভবিষ্যৎ কী? সময় উত্তর দেবে।