বারো মাসে তেরো পার্বণের দেশ হল ভারতবর্ষ। বৈচিত্রময় তার রীতিনীতি এবং আচার সংস্কার। একটু খতিয়ে দেখলে বোঝা যায় যে, পুজো-অর্চনার মধ্যে দিয়ে যে কোনও উৎসবের সূচনা হয়।
ঝুলনযাত্রা সেই রকমই একটি উৎসব। শ্রাবণী পূর্ণিমার পাঁচদিন আগে পালিত হয় এই ঝুলনযাত্রা। কোথাও আবার শ্রাবণ মাসের শুক্লা ত্রয়োদশী থেকে শুরু করে পূর্ণিমা পর্যন্ত— তিনদিন ধরেই ঝুলনযাত্রা পালিত হয়ে থাকে।
আরও পড়ুন-রাখিবন্ধন নিয়েই বাঙালির মুক্তির স্বাদ
পৌরাণিক উৎস খুঁজতে গেলে দেখা যায়, রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলাকে কেন্দ্র করে দ্বাপর যুগে এই ঝুলনযাত্রার সূচনা হয়। কৃষ্ণ অবতার রূপে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন এবং বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বৃন্দাবন তথা নন্দালয়ে নানারকম লীলা সাধন করেছিলেন।
কিশোর কৃষ্ণ আর রাধারানির যে মাধুর্যপূর্ণ প্রেমের পরিপূর্ণ প্রকাশ বৃন্দাবনে হয়েছিল তারই লীলাস্বরূপ এই ঝুলনযাত্রা পালিত হয়ে থাকে।
যদিও শাস্ত্রে কৃষ্ণের বারোটি পৃথক যাত্রার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যার মধ্যে রথযাত্রা, স্নানযাত্রা, দোলযাত্রা, রাসযাত্রা, ঝুলনযাত্রাকে সঙ্গে নিয়ে দ্বাদশযাত্রা বলা হয়। ঝুলন শব্দটির সঙ্গে দোলনা শব্দটি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। এই ঝুলনযাত্রা অতি-বিখ্যাত যাঁদের একত্রে দ্বাদশযাত্রা বলা হয়। ঝুলনলীলাকে অনেকে হিন্দোলনলীলাও বলে থাকেন।
আরও পড়ুন-চন্দ্রযানের সাফল্যে জড়িত বাঙালি বিজ্ঞনীদের সংবর্ধনা দিতে চান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
রামী চণ্ডীদাস লিখছেন—
‘দেখ দেখ ঝুলত নন্দকিশোর
যমুনার তীরে কদম্ব কাননে
রাধা সনে মিলন বিভোর’
রাধাকৃষ্ণ-ভক্তরা রাধা-কৃষ্ণের মূর্তি দোলনায় বসিয়ে দোলান। ভক্তরা মনে করেন দোলনায় দোলালে কৃষ্ণ বেশি খুশি হন। ধুমধাম সহকারে এই যাত্রা বা উৎসব পালন করেন ভক্তরা।
ধীরে ধীরে এই উৎসব জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করে। রাধাকৃষ্ণের যুগল বিগ্রহকে দোলনায় বসিয়ে পুজোর মধ্যে সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক তাৎপর্য প্রস্ফুটিত হয়। সোনা বা রুপোর দোলনা বা কখনও ফুলের দোলনায় রকমারি সাজে দুলতে থাকেন যুগল-বিগ্রহ।
‘দোলে কৃষ্ণ মেঘের ওই সৌদামিনী
দোলে দেয় দোল ব্রজ গোপিনী
বাজায় নূপুর নাচে ময়ূরী ময়ূর
তমাল শাখে দোলা ঝোলে ঝুলনে’
আরও পড়ুন-পাক গুপ্তচর সংস্থাকে ভারতের নথি পাচার করতে গিয়ে এসটিএফের হাতে ধৃত যুবক
শ্রাবণ মাস পুরুষোত্তম মাস। শ্রাবণী পূর্ণিমায় কৃষ্ণের বাঁশির সুমিষ্ট ধ্বনিতে থাকে অমর আকর্ষণ। সেই ডাক অগ্রাহ্য করে রাধারানির সাধ্যি কী! শ্রীরাধা ব্রজবালাদের নিয়ে কুঞ্জবনে আসেন। বৈষ্ণবকাব্যের শ্রীরাধা যেন প্রেমের চিরন্তন অভিসারিণী। অভিসারই হল ঈশ্বর অণ্বেষা। সেখানে ফুলসমাহারে সুসজ্জিত দোলনায় কৃষ্ণের বাঁয়ে রাধাকে বসিয়ে দোল দেয় অষ্ট সখী। বিশাখা, ললিতা, ইন্দুরেখা, চিত্রা, চম্পকলতা, তুঙ্গবিদ্যা, সুদেবী এবং রঙ্গদেবী। এবার আসি রাধা কে? বৃষভানুর কন্যা আর আয়ান ঘোষের স্ত্রী। ‘রা’ অর্থ লাভ করা আর ‘ধ’ অর্থে ধাবমান হওয়া। অর্থাৎ ভক্তির মাধ্যমে ভগবানের সান্নিধ্য লাভ। বৈষ্ণব কবিদের কাব্য-মহিমায় শেষ পর্যন্ত মানবিক দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে রাধাকৃষ্ণের কাহিনি। যা বিশেষত বাঙালি জীবনেই শুধু প্রভাব ফেলে তা নয় সমাজ চেতনায়ও গুরুত্বপূর্ণ বিস্তার লাভ করে।
আরও পড়ুন-বাড়ছে রূপোলী ফসলের জোগান, কমবে দাম, আশাবাদী বাঙালি
কালক্রমে বৈষ্ণবদের তো বটেই, পাশাপাশি আপামর মানুষের মনে ও মানুষের কাছে ঝুলনযাত্রা একটি লৌকিক উৎসবে পরিণত হয়।
যুগলবিগ্রহকে দোলনায় বসিয়ে পুজোর মধ্যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্য প্রস্ফুটিত হয়।
নানাধরনের মাটির পুতুল, কাঠের পুতুল, কাচের পুতুল ও সবুজ গাছপালা ও সুগন্ধী ফুল দিয়ে সাজানো হয় ঝুলনযাত্রা এবং রাধাকৃষ্ণের দোলনা।
বৃন্দাবন-সহ দেশের বহু জায়গায় ঝুলন একটি জনপ্রিয় ও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এক উৎসব। তিথি, নক্ষত্র মেনে পালিত হয় এই উৎসব।
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর জন্মস্থান নবদ্বীপ, মায়াপুর, নদিয়ার শান্তিপুরে বিশেষ সমারোহে পালিত হয় ঝুলনযাত্রার উৎসব। কৃষ্ণের বাল্যকাল থেকে কিশোর বয়স পর্যন্ত নানা বাল্যস্মৃতি পুতুল দিয়ে সাজানো হয়ে থাকে যা জনসাধারণের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়। প্রত্যেকদিন নানা নতুন পোশাকে ফুলের সাজে সেজে ওঠে রাধাকৃষ্ণের দোলনা। রকমারি ভোগ নিবেদন করা হয়ে থাকে।
আরও পড়ুন-জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সেরা বাংলা ছবি কালকক্ষ
শ্রীকৃষ্ণের শতনাম, ভজন, কীর্তন, নামগান চলতেই থাকে।
বরানগরের পাঠবাড়ি, বউবাজারের বিখ্যাত রামকানাই অধিকারী ঝুলনবাড়িতে ঝুলনযাত্রার উৎসব দেখার জন্য আজও বহু মানুষের সমাগম ঘটে।
একটা সময় বউবাজারের এই বিখ্যাত ঝুলন বাড়িতে ধ্রুপদী সংগীতের আসর খুবই জনপ্রিয় ছিল। মহিষাদল রাজবাড়িতে প্রায় দুশো বছর ধরে ঐতিহ্যমণ্ডিত মদনমোহন গোপাল জিউর মন্দিরে রাধাকৃষ্ণের ঝুলন অনুষ্ঠিত হয়। শুধু পশ্চিমবঙ্গই বা কেন সমগ্র ভারতবর্ষেই ঝুলন উৎসব মহাসমারোহে পালিত হয়।
আরও পড়ুন-সতর্ক কবে রেল হবে? তামিলনাড়ুতে ট্রেনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রশ্ন বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর
ইতিহাস পরিবর্তনের পথে চলে। এককালে যেমন প্রতিটা পরিবারে কচিকাঁচারা পালন করতই ঝুলনযাত্রা উৎসব, তার বিলুপ্তি ঘটেছে অনেকটাই। আশি-নব্বই দশকের ছোটরা শহরের নির্দিষ্ট কিছু জায়গা থেকে পুতুল সংগ্রহ করত বছরভর। ঝুলনের দিনে সাজাবে বলে। পাড়াপড়শিদের মধ্যে সূক্ষ্ম প্রতিযোগিতাও চলত। বড় বড় ইটে কাদামাটি, কাপড় দিয়ে পাহাড়, পাশ দিয়ে পুকুর তাতে মাটির মাছ, সিনেমা হল, তার সামনে আবার ফুচকাওয়ালা, সবুজ রং-করা কাঠের গুঁড়ো দিয়ে সবুজ মাঠ, বল পায়ে কিশোর-সহ হত নানান কিছু। এ ওর বাড়ি গিয়ে দেখে আসত কার কী নতুন সংগ্রহ! সেকালের ছোটদের বিশেষ আগ্রহ ছিল এই ঝুলনযাত্রা উৎসব। সে-সময়ে ঝুলন স্বমহিমায় ছিল।
আরও পড়ুন-যোগীরাজ্যে মুসলিম শিশুকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অপমান, ভাইরাল ভিডিও, নিন্দায় সরব তৃণমূল কংগ্রেস
বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কার আর প্রযুক্তির রমরমার এই উত্তর আধুনিক যুগে ঝুলন তার কৌলিন্য হারিয়েছে অনেকটাই। এখন আর বাড়ির ছোটরা পুতুল কেনার জন্য বায়নাক্কা তো করেই না। কেননা, বেশিরভাগ জানেই না ঝুলন যাত্রা কী?
ব্যতিক্রম বাদ দিলে অনেকাংশেই অণু পরিবার। দাদু-ঠাকুমারা ব্রাত্য সেখানে। তাই ঝুলন উৎসবের গল্প কচিকাঁচাদের অজানা।
তবুও আঞ্চলিক ও লৌকিক উৎসব হিসেবে নদিয়ার শান্তিপুর, নবদ্বীপ-সহ ভারতবর্ষের আমেদাবাদের কৃষ্ণমন্দির, ভুবনেশ্বরের কাঠিয়াবাবার আশ্রম, বৃন্দাবনের বাঁকেবিহারী, মথুরার দ্বারকাধীশ মন্দিরে ধুমধাম করে ঝুলন অনুষ্ঠিত হয়। নানা জায়গায় ঝুলনযাত্রা উৎসব আজও জাঁকজমকপূর্ণভাবে পালিত হয়।