ব্রিটিশ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৬০০ খ্রিস্টাব্দ থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশে বাণিজ্য করার অধিকার পেয়েছিল। দুশো বছর ধরে ইউরোপের অজস্র বিদেশি ভারতে সব রকম সুবিধা নেওয়ার পর বাংলা-প্রদেশটি ইংরেজদের সম্পূর্ণ করায়ত্ত হয় ১৮১৩ সালে। এক চার্টার-অ্যাক্টের মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকার কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যাধিকার বিলুপ্ত করে এবং দেশের শাসনভার কোম্পানির উপর ন্যস্ত করে। ইংরেজ শাসনের সূচনাপর্বে কোম্পানি ভারতে ইংরেজি-শিক্ষা বিস্তারের বিরোধী ছিল, পাছে ভারতবর্ষের মানুষের চোখে আলো পড়ে স্বাধীনতাকাঙ্ক্ষী হয় পরিণতিতে ভারতে কোম্পানির শাসনভার হয়তো হাতছাড়া হয়ে যাবে। বড়লাট লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের শাসনকালে সরকারি শিক্ষানীতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে। এ-সময় টমাস ব্যাবিংটন মেকলে নামে এক খ্যাতনামা ব্রিটিশ পণ্ডিত, ঐতিহাসিক, সাহিত্যিক এবং হুইগ দলের রাজনৈতিক নেতা, বড়লাটের আইনসভার সচিব হয়ে ভারতে আসেন। তাঁর মতে ইংরেজি-ভাষার চর্চা না করাটা ভারতের পক্ষে অমঙ্গলজনক। ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রে তাঁর প্রস্তাব মেকলে মিনিট নামে পরিচিত।
আরও পড়ুন-বনলতাকে ছুঁয়ে সটান চেরাপুঞ্জি
কোম্পানিও এই সুবাদে দেশীয় শাসন করতলে এনে ১৮৩৫ সালে ইংরেজিকে অফিস-আদালতের ভাষা হিসেবে ঘোষণা করেছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় উদারনৈতিক চিন্ত্যক ও সম্ভ্রান্ত বুদ্ধিজীবী হওয়া সত্ত্বেও মেকলে ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতীয়দের সমস্যাগুলি বোঝেননি, তাদের সঙ্গে হৃদয়ের সংযোগ গড়ে তোলেননি। অনেক আইনি খসড়া অসমাপ্ত রেখে মেকলে ভারত ছেড়ে চলে যান ১৮৩৮ সালে। তাঁর-ই স্থলাভিষিক্ত হয়ে দশ বছর পরে ভারতে এসেছিলেন আরেক রাজপুরুষ জন এলিয়ট ড্রিংকওয়াটার বেথুন। শিক্ষায়, সংস্কৃতিতে শুধু অসামান্য ছিলেন না, ছিলেন এক বিরল মানবদরদি। ভারতের অনেক মানুষের কাছে আজ হয়তো তিনি শুধুই একটি উনিশ শতকের বিশেষ নাম, বাঙলার নারীশিক্ষার এক পুরোধা ব্যক্তিত্ব। এটুকু বললে হিমশৈলর সূক্ষ্ম চূড়াটুকুর হদিশ দেওয়া হয়। তাঁর দিকচক্রবাল প্রসারিত হৃদয়-ব্যাপ্তির কথা জানলে ভারতবাসীর মনে শ্রদ্ধার পরতে কত যে রঙ লাগতে পারে, তারই জন্য এ নিবন্ধের অবতারণা। এ বছর তাঁর ভারতে আগমনের ১৭৫তম বছর।
আরও পড়ুন-এই আমাদের নববর্ষ বিভেদ মোছা হর্ষ সুখে
আসল নাম জন এলিয়ট ড্রিংকওয়াটার, জন্মেছিলেন ১৮০১ সালের ১২ জুলাই। ইংল্যান্ডের এলিং গ্রামে। বেথুন নামটি সংযুক্ত হয়েছে তাঁর ৩৬ বছর বয়সে, মামারবাড়ির পারিবারিক সম্পত্তি প্রাপ্তির অধিকারে। ভারতীয়রা তাঁকে আদর করে বিটন-সাহেব বা বেথুন-সাহেব বলেই ডাকতেন। অসাধারণ মেধাবী জন এলিয়ট, কেম্ব্রিজের ট্রিনিটি কলেজের অংকের র্যাংলার, সে বিষয়ে পরবর্তী পাঠ না নিয়ে চলে গেলেন আইন পড়তে। বাবা ছিলেন নৌ-বাহিনীর ডাক্তার। সে সময় বিলেতে আইন ব্যবসার খুব কদর। জন এলিয়ট ব্যারিস্টারি পাশ করে আইনি পেশায় যুক্ত হলেন। একই সঙ্গে তিনি আগ্রহী আরও অনেক কাজে। শিখছেন একাধিক ইউরোপীয় ভাষা, ফরাসি, জার্মান, ইতালিয়ন, স্প্যানিশ, সুইডিশ— তাঁর অন্তরে রয়েছে সংবেদনশীল এক কবির বাস, যে নাকি ভাষা শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে সেই ভাষার কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করে ফেলার ক্ষমতা রাখেন। অবসর সময় সাহিত্য-পাঠ তাঁর কাছে অপ্রতিরোধ্য ছিল। সন্দেহ থাকে না ‘A History of the Siege Of Gibraltar’ গ্রন্থের লেখক-পিতার উত্তরাধিকার সূত্রে এই চিত্তবৃত্তি তিনি অর্জন করেছিলেন। ছাত্র-অবস্থা থেকেই বুঝতে চেয়েছেন বই-এর ব্যবসা। সেই সুবাদে ছাপিয়েছেন আইনি ব্যাংক-নোট, ডাকটিকিট। আযৌবন তিনি কর্মযোগী, মানবকল্যাণে আমূল বিশ্বাসী। ইংল্যান্ডে থাকতেই যুক্ত হয়েছিলেন হুইগ পার্টির সংসদ সদস্য ও লর্ড চ্যান্সেলার হেনরি ব্রুহ্যামের গড়ে তোলা ‘সোসাইটি ফর দ্য ডিফিউসান অফ ইউস্ফুল নলেজ’-এর সঙ্গে। উদ্দেশ্য বিদ্যালয়ের সীমা পেরোনো জনসাধারণের মনে শিক্ষার দিগন্ত উন্মোচন করা, বিজ্ঞান সচেতন করা। তার জন্য লিখেছেন একাধিক বই। প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী হয়েও লিখলেন সহজপাঠ্য আলজেব্রার বই, বিজ্ঞানী গ্যালিলিও আর কেপলারের জীবনী।
আরও পড়ুন-রাজনারায়ণ বসু স্মৃতি পাঠাগার বাংলার নবজাগরণের অন্যতম কেন্দ্র
তাঁর নিজের দেশের সাধারণ মানুষকে যেমন উন্নত জ্ঞানের স্বাদ চেনাতে চেয়েছেন ভারতের মাটিতে পা রাখার আগেই এদেশের শিক্ষার অগ্রগতি, সরকারি-স্কুলের ছাত্রদের ব্যুৎপত্তি সম্বন্ধে পাঠ নিয়েছেন, গোপনে ইচ্ছেও ছিল এ বিষয়ে নিজেকে নিয়োজিত করার। সেই গোপন চাওয়াকে হয়তো বা না জেনেই ভারতের বড়লাট সম্মানিত করে দিলেন— উপদেষ্টা ছাড়াও সারা ভারতে শিক্ষাসংসদের সভাপতির পদটি উপহার দিয়ে। অন্যান্য রাজপুরুষের মতো কর্মসূত্রে ভারতে আসার তাগিদ তাঁর ছিল না। মূলত সমকালের ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লর্ড জন রাসেল আর ইংল্যান্ডে ভারত বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক বেথুনের বিশেষ গুণমুগ্ধ, স্যার জন হবহাউসের বিশেষ আগ্রহে ভারতে আসা। প্রথম যৌবনে শপথ নিয়েছিলেন সারা জীবন বিজ্ঞানের সাধনা করে যাবেন। ইংল্যান্ডে তাঁর তখন বহু ব্যস্ত জীবন, আইনি পরিষেবায়, রাশিবিজ্ঞান নামক বিজ্ঞানের এক নতুন শাখার প্রতিষ্ঠায়, জ্যোতির্বিজ্ঞানের চর্চায়, সাহিত্যপাঠে, বিভিন্ন বস্তুর বিজ্ঞানসম্মত ভাবে ওজন আর পরিমাপের মূল্যমান নির্ধারণে ইত্যাদি প্রভৃতিতে। আর ছিল ভয়ংকর এক পিছুটান, অশীতিপর বৃদ্ধা মা।
আরও পড়ুন-রেলের জন্মদিন
শেষ পর্যন্ত মায়ের অনুমতি নিয়েই ভারতের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করলেন ১৮৪৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি। সে-বছর ১১ এপ্রিল ভারতে এসে বুঝলেন নতুন এক পৃথিবীতে তিনি চোখ মেলেছেন, সব কিছু তাঁর প্রত্যাশা মতো নয়। ভারতে এসে কিন্তু এই প্রতিভাময় আইন-বিশেষজ্ঞটি তো লর্ড মেকলের কোডগুলিকে আইনে রূপান্তরিত করার ব্যাপারে তেমন আগ্রহ দেখালেন না। একটি বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন মানুষকে কি আর নীরস আইনের অধ্যাদেশ প্রস্তুতিতে বেঁধে রাখা যায়? বরং সারা ভারতের শিক্ষাসংসদের সভাপতির সাম্মানিক পদ পেয়ে মেতে উঠলেন নারী-শিক্ষার কাজে। এ-নিয়ে স্যার হবহাউসের সঙ্গে তাঁর ধারাবাহিক মনোমালিন্য শুরু হল। বিরক্ত হবহাউস ব্যস্ত হলেন আইনি কাজে বেথুন সাহেবের চূড়ান্ত অপদার্থতা পদে পদে প্রমাণ করতে। কিন্তু বেথুন ব্যারিস্টার, ইংলন্ডের নর্দার্ন সার্কিটের সদস্য। ব্রিটেনের স্বরাষ্ট্র-দপ্তরের প্রভাবশালী আইন-সচিবের পদে নিযুক্ত, বহু গুরুত্বপুর্ণ অধ্যাদেশের খসড়া রচয়িতা, তাঁর পক্ষে এমন দায়সারা কাজ করা হয়তো কঠিন। বিনয়ী, সুভদ্র বেথুন বারে বারে ক্ষমা চেয়েও হবহাউসের ক্ষোভের প্রশমন ঘটাতে ব্যর্থ হয়ে দুটি পৃথক কর্ম-বৃত্তে অর্থাৎ আইনি পরিষেবা ও শিক্ষা বিষয়ে স্বাধীন-স্বচ্ছন্দ আনাগোনা করতে লাগলেন। অসামান্য প্রতিভাধর মানুষটির মনের সায় সম্বল করে মেধা-মনন-চিন্তন উজাড় করে দিলেন শিক্ষাক্ষেত্রে। বহু বিষয়ে পুস্তক রচনা করলেও আইনবিদ বেথুন আইন বিষয়ে একটিও পুস্তক রচনা করেননি। ভারতে বসবাসকালে শিক্ষার প্রসার এবং আধুনিকীকরণে তিনি কিন্তু তাঁর সব সময়টুকু উজাড় করে নিবেদন করে গেছেন। মানুষ বেথুন আসলে ছিলেন এক আদ্যন্ত শিক্ষাবিদ।
ভারতে তিনি ছিলেন মাত্র তিন বছর চারমাস সময়কাল। এরই মধ্যে খুঁজে নিয়েছিলেন সমমনস্ক কিছু শিক্ষাব্রতী মানুষ, কলকাতায় মেয়েদের জন্য স্কুল খুললেন। শিক্ষার প্রসারে সংযোজন করলেন তাঁর নিজস্ব ধ্যান-ধারণা। সবস্তরে শিক্ষার পাঠ্যক্রম, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক রূপ, শিক্ষকদের আচরণবিধি, দেশীয় ভাষা বিশেষত শিক্ষার্থীর মাতৃভাষার চর্চা, শিক্ষার্থীর উপযোগী পুস্তক রচনা, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়মিত সংযোগ, তাদের মেধার প্রতি সম্মান প্রদর্শন, পুরস্কৃত করে তাদের উৎসাহিত করা, সবার ওপরে যোগ্য মানুষ হয়ে ওঠার দীক্ষা ইত্যাদি। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে বালিকাশিক্ষার প্রসারের জন্য তাঁর উৎসাহ, সহযোগিতা, উদ্দীপনা ছিল আকাশপ্রতিম ব্যাপ্ত। জন এলিয়ট ভীষণভাবে চেয়েছিলেন ভারতে শিক্ষার যথার্থ প্রসার হোক। লর্ড মেকলের মতো ভারতের মানুষকে সামান্য ইংরেজি শিখিয়ে কেরানি তৈরি করার বাসনা তাঁর ছিল না। ১৮৫১ সালের ২৩ জানুয়ারি শিক্ষা দপ্তরের সভায় তাঁর নিজের মনের যে কথা ব্যক্ত করেছিলেন সে-কথাই চিনিয়ে দেয় এক অনন্য শিক্ষাপ্রশাসকের। এ-দেশে স্কুল স্থাপনের মূল উদ্দেশ্য শুধু ভাল মুন্সেফ, ভাল গ্রাম্য হিসাবপরীক্ষক, ভাল নগররক্ষক অথবা অজস্র নিম্নমানের দেশীয় কর্মচারী তৈরি করে জনসেবায় সহায়তা করা নয়। তাঁর নিজের কথায়, “I entirely dissent from this doctrine. I believe it to be equally opposed to the the sentiments entertained by the most enlightened among our predecessors who have devoted their zeal and talent to the cause of native education.”
আরও পড়ুন-মোদি জমানায় শিক্ষার মান নামল শিবপুর বিইতে
উনিশ শতকের মধ্যভাগে বাঙালি মেয়েদের শিক্ষার বহর ছিল যথেষ্ট হতাশাব্যঞ্জক। ধর্ম-পরিবর্তনের গোপন উদ্দেশ্য সহযোগে মিশনারিদের প্রচেষ্টাই ছিল প্রধান, আর দু-একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা ছাড়া শিক্ষিত, অভিজাত অথচ রক্ষণশীল বাঙালি জনমানস তখনও ঘরের মেয়েদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য প্রস্তুত হয়নি। পরিস্থিতি দেখে বেথুন অনুভব করলেন, এই অন্ধকারে ঢাকা সমাজে অসহায় মেয়েদের চোখে আলো ধরতে হবে। জানা যায় না এই আবেগের পেছনে দেড় দশক আগেকার কোনও হৃদয়-অনুতাপ সঞ্চিত ছিল কি না। ভারতে সতীদাহ প্রথা জারি রাখার জন্য ইংল্যান্ডে প্রিভি কাউন্সিলে ১৮৩৩ সালে রাধাকান্ত দেব এবং অন্যান্য সমাজপতিদের হয়ে ব্যারিস্টার বেথুন সাহেব জোর সওয়াল করেছিলেন। মামলায় অবশ্য বেথুনের হার হয়। সে বেদনা কী গোপনে হৃদয়ে বহন করেছিলেন, তথ্য প্রমাণ নেই। শোনা যায় স্বয়ং বিদ্যাসাগর মশাইয়ের কাছে নাকি এ-নিয়ে আফসোস করেছেন। অবশ্য বারাসতে কালীকৃষ্ণ মিত্রের বালিকাবিদ্যালয় পরিদর্শন করতে গিয়ে প্রভাবিত হওয়ার ঘটনাটিও ছিল। পরিচয় হল শিক্ষাসংসদের অন্যতম সদস্য, শিক্ষানুরাগী ধনী-ব্যবসায়ী, সমাজসেবী রামগোপাল ঘোষের সঙ্গে আর সেই সূত্রে পরিচিত হলেন আর কিছু সমমনস্ক নারী-শিক্ষাব্রতী মানুষের, জমিদার দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, পণ্ডিত মদনমোহন তর্কালঙ্কার প্রমুখ। আর সর্বতোভাবে পাশে এসে দাঁড়ালেন ভারতের বড়লাট লর্ড ডালহৌসি । প্রতিষ্ঠিত হল সরকারি সাহায্য ছাড়া সেকুলার হিন্দু ফিমেল স্কুল, ১৮৪৯ সালের ৭ মে, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে। পরবর্তীতে স্কুল পেল তার স্থায়ী ঠিকানা, হেদুয়ার উত্তর পশ্চিম প্রান্তে। এই স্কুল ছিল বেথুনের প্রাণ।
আরও পড়ুন-হতাশ ম্যান ইউ সমর্থকদের বিক্ষোভ
শিক্ষা দপ্তরের সভাপতি হয়ে কৃষ্ণনগর, হুগলি, ঢাকা, হিন্দু প্রভৃতি কলেজে পরিদর্শন-কালে যথার্থ শিক্ষাবিদের মতো ছাত্রদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন শিক্ষার কোনও মূল্য থাকে না, যদি না সে শিক্ষা তাদের হৃদয় ও ভালবাসা বোধকে শুদ্ধ করে তুলতে না পারে, একই সঙ্গে বৌদ্ধিক শক্তির উন্নয়ন না ঘটায়, নীচ, অসৎ কাজে প্রণোদিত না করে। ছাত্রদের উচিত সরকারি আনুকূল্যে শিক্ষা লাভ করার পর অধীত জ্ঞান পরিপার্শ্বের মানুষের কল্যাণের কাজে লাগানো। বিভিন্ন সময়ে তাঁর ভাষণে উঠে এসেছে নারীশিক্ষার উপযোগিতার কথা, যেমন— মেয়েদের শিক্ষিত করলেই সীমাহীন গার্হস্থ্য-সুখ পাওয়া যাবে, জাতির উন্নতি ঘটবে। জাতির মেয়েরা, মাতৃরূপে সন্তান পালন, তাদের প্রাথমিক শিক্ষা, রুচি, কল্পনার নিত্য সারথি হয়ে উঠে জাতির উন্নতি ঘটান। পরিণত জীবনেও মানুষের প্রতিটি সম্পর্ক, নারীসান্নিধ্যে অপার শক্তিতে সমৃদ্ধ হয়।
১৮৪৯ সালের ৭ মে, ক্যালক্যাটা ফিমেল স্কুল (যা এখন বেথুন স্কুল নামে পরিচিত) প্রতিষ্ঠার দিনে উপস্থিত অভিভাবকদের আশ্বস্ত করেছিলেন ধর্মশিক্ষা-বিহীন এ স্কুলে মূলত মাতৃভাষায় পাঠ দেওয়া হবে, ইংরেজি শিক্ষা প্রয়োজনে দেওয়া হবে। শিক্ষার ভিত্তিপ্রস্তর মাতৃভাষায় স্থাপিত হলে ইংরেজি সাহিত্যের পাঠ নেবে। এ ছাড়াও মেয়েদের শেখানো হবে হাতের-কাজ, সূচিশিল্প, এম্ব্রয়ডারি, ফ্যান্সি আঁকাজোকা, যাতে শিক্ষিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা হবে গৃহকর্ম-নিপুণ, সম্ভ্রমপূর্ণ কর্মবৃত্তে নিজেদের নিয়োজিত করতে পারবে। স্বপ্ন দেখেছিলেন অদূর ভবিষ্যতে এই স্কুল হয়ে উঠবে নারীশিক্ষার পীঠস্থান।
আরও পড়ুন-হাঁসখালি-কাণ্ড গ্রেফতার হল আরও এক
শুধু নারীশিক্ষা নয়, উৎসাহ দিয়েছেন হিন্দু কলেজের জ্যোতির্বিজ্ঞানের তিন ছাত্রকে, দিল্লির জনৈক কলেজ শিক্ষক রামচন্দ্র মাথুরের গাণিতিক প্রতিভাকে ইউরোপের দরবারে পৌঁছে দিয়েছেন, ভারতের প্রথম শব-ব্যবচ্ছেদকারী পণ্ডিত মধুসূদন গুপ্তের যুগান্তকারী আবিষ্কারের স্বীকৃতিতে তাঁর জীবদ্দশায় এক বিশাল তৈলচিত্র কলকাতা মেডিক্যাল-কলেজের লেকচার-থিয়েটারে স্থাপন করেছেন। ব্রিটিশ স্বার্থবিরোধী এবং নেটিভ-স্বার্থে বিশেষ কিছু আইন প্রণয়ণ করে তাদের ভারতবাসীর সুরক্ষা সুবিধার ব্যবস্থা করতে গিয়ে নিজের দেশবাসীর কাছেই নিন্দিত হয়েছেন। মানুষটি ছিলেন সর্বার্থেই নীতিনিষ্ঠ, আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রেও যেমন শিক্ষা প্রশাসনেও তেমন। ধর্মের ভিত্তিতে কলকাতায় যে হিন্দু কলেজের উদ্ভব, সেখানে সব আর্থ-সামাজিক শ্রেণির ছাত্রের শিক্ষার অধিকার দিতে বাধ্য করেছিলেন বেথুন। যেমন বাধ্য করেছিলেন মাইসোরে টিপু সুলতানের পারিবারিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে সম্ভ্রান্ত মুসলিম জনগণের শিক্ষার অধিকার দিতে। শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে হিন্দু-কলেজের ছাত্রপ্রিয় অধ্যক্ষ ক্যাপ্টেন রিচারডসনের অন্যায় কাজের বিরুদ্ধে যেমন মুখর হয়েছেন, তেমনি অকারণে স্টাইপেন্ডের প্রলোভন দেখিয়ে ক্যালক্যাটা ফিমেল স্কুলের ছাত্রী-সংখ্যা বাড়াতে চাননি। সাহায্য করেছেন শুধুমাত্র তাদের যারা দরিদ্র, গাড়িভাড়া দিয়ে যাতায়াতে অক্ষম। গোপনে প্রকাশ্যে বহু বালিকাকে সাহায্য করেছেন।
আরও পড়ুন-মাথায় সেলাই নিয়েও অদম্য মনোতোষ শুভমের গোলে, জিতল বাংলা
বাঙ্গলায় মাতৃভাষায় শিক্ষাচর্চায়, গ্রন্থনির্মাণে বেথুন এক অলোক-সামান্য পথপ্রদর্শক। বাঙ্গলায় মাইকেল মধুসূদনের কাব্যপ্রতিভা হয়তো প্রকাশিত হত না, যদি না বেথুন তাঁকে এ-বিষয়ে বিশেষ ভাবে উজ্জীবিত করতেন।
উদারহৃদয় ভারতীয় শিক্ষিতরা তাঁর কাছে যথাযোগ্য মান পেয়েছেন, বিদ্যাসাগরের মতো বন্ধু তাঁর মানবহিতৈষায় অন্য মাত্রা যোগ করেছেন। নিজস্ব উদ্যোগে মেয়েদের স্কুলটির জন্য শুরুর দিন থেকে মৃত্যুশয্যায় চেতনালোপের আগের মুহূর্ত পর্যন্ত আর্থিক অনুদানের ব্যবস্থা রেখে গেছেন। নারীশিক্ষার দায় তো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ছিল না। এ তাঁর একার দায়। এর জন্য কত যে ত্যাগ, শ্রম, অপমান স্বীকার করেছেন তার ইতিহাস একই সঙ্গে বড় নাটকীয় এবং করুণ। ভারতীয় ‘আনন্দ বৃক্ষ’ তথা অশোক গাছ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রোপণ করে নারীশিক্ষার যে উদ্ভাস তিনি প্রতিকূল সময়ে রচনা করেছিলেন, সেই আলোতেই, পঞ্চাশ বছরের পার্থিব জীবনধারী সন্ন্যাসীপ্রতিম মানুষটিকে চেনা, অনুভব করা কি খুব কষ্টসাধ্য?