এক নিঃসম্বল নিরাশ্রয়া বালিকা যে কী না পিতাকে হারিয়ে মায়ের হাত ধরে সহায় সম্বলহীন হয়ে আশ্রয় নিল এক দুর সম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়িতে। অনেক অনুনয় বিনয়ের পর বড় অনিচ্ছায় তাঁদেরকে রাখে আত্মীয়েরা। কিন্তু শুধু মুখে কী আহার জোটে । দুবেলা মা ও মেয়ের অক্লান্ত পরিশ্রম । পরিচারিকার দায়িত্ব পালন করেও অনেক লাঞ্ছনা,কটুবচন হজম করত তাঁরা। তারপর দুমুঠো অন্ন জুটতো তাঁদের। কিন্তু সেও সইল না বেশিদিন। চরম অপমানের গ্লানিতে একদিন সেই বালিকা সাহসে ভর করে ,মরিয়া হয়ে মায়ের হাত ধরে আত্মীয়ের বাড়ি পরিত্যাগ করল ।উপোস করে মরবে সেও ভাল কিন্তু এই কুৎসিত জীবন আর নয়।সামনে ভয়ঙ্কর অনিশ্চয়তা জেনেও সে পিছপা হয়নি।
আরও পড়ুন- ককটেল টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অনুমতি DCGI-এর
ছোটবেলা থেকেই তো সেই মেয়ে বড় স্বতন্ত্র প্রকৃতির। যে বয়সের মেয়েরা অন্য সঙ্গীদের সঙ্গে হেসে খেলে বেড়ায় ,সে বয়স থেকেই সে একলা থাকতে ভালবাসে। আপন মনে পুতুল খেলে,পুতুলের ঘর সাজায় ,পুতুলের ঘর ভাঙে, আবার গড়ে।এই ঘর -সংসার গড়ার নেশাই তার সকল সত্ত্বাটুকু জুড়ে। যা সারাজীবনই তার অন্তরের সবটুকু জুড়েই ছিল।
এমতাবস্থাতেই হঠাৎ পিতৃবিয়োগের দুর্ভাগ্য। চরম দুর্দিনের সাক্ষী করল তাকে ঈশ্বর। তখন দিদির বিয়ে হয়ে গেছে। বাবা শ্রী রতনচন্দ্র দাস ছিলেন সওদাগর অফিসের সাথে কেরানি। ভাল কাজ করলেও কুঅভ্যাসের জন্য ঋণে একেবারে জর্জরিত হয়ে পড়ে ছিলেন। ছোটবেলায় জানত না সে , বড় হয়ে শুনেছিল মা তার বাবার বিবাহিতা স্ত্রী নয়।কিন্তু বাবার প্রতি তাঁর মায়ের আনুগত্য ভালবাসা কোনও বিবাহিতা স্ত্রীর চেয়ে এতটুকু কম দেখেনি কখনও। বাবা মা আর দুই বোন এই ছিল জগৎ। মৃত্যুর পর ভালবাসার সেই কর্তব্য থেকেই বাবার সব ঋণশোধের ভার মা নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল।
আরও পড়ুন- তৃণমূলের দাপটে গদি টলমল, মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সি বাঁচাতে দিল্লি দরবারে বিপ্লব!
আত্মীয়ের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার পর দাঁড়াবার মাটিটুকু যেন পায়ের তলা থেকে সরে যাচ্ছিল একটু একটু করে ।কিন্তু বয়স তার যত তার চেয়েও বেশি ছিল পরিণত অনুভূতি আর উচ্চাকাঙ্ক্ষা।মনে মনে ভেবেছিল কোনমতে বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যু শ্রেয় । বাঁচার মত বাঁচতে না পারলে জন্মানো অর্থহীন।তাই সেই জীবনকে খুঁজে পেতেই হবে।
ইচ্ছে থাকলেই উপায় হয় এমন প্রবাদ সত্যি হল।স্টুডিও পাড়ায় হাজির হয় রোজগার করবে বলেই।ম্যাডান থিয়েটারের ব্যানারে জ্যোতিষ বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত নির্বাক চলচ্চিত্র ‘জয়দেব’ এ সে প্রথম অভিনয় করার সুযোগ পায়। তখন তিনি কাননবালা কিংবদন্তি নায়িকা গায়িকা কানন দেবী হয়ে উঠতে আরও অনেকটা পথ বাকি ছিল।
কানন দেবী যিনি ভারতীয় চলচ্চিত্রে নায়িকাদের মধ্যে প্রথম গায়িকা এবং বাংলা চলচ্চিত্রে প্রথম তারকা হিসেবে স্বীকৃত । প্রথম ফিল্মের সময় তার বয়স ছিল বারো কী তেরো। কানন দেবী নিজের ভাষায় – “আমার মতই চলচ্চিত্রের তখন যাকে বলে একেবার শৈশব অবস্হা। হয়ত আমার চেয়েও আরও শৈশবাবস্হা, কারণ তখনও তার মুখে বুলি ফোটেনি ।সেই যুগের চলচ্চিত্রে আমার প্রথম ছবি জয়দেব”। পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন মাত্র পাঁচ টাকা। জ্যোতিষ বাবুর মত হৃদয়বান মানুষ তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেন।এরপর কে পি ঘোষ পরিচালিত ‘ শঙ্করাচার্য ‘ ছবিতে অভিনয় করেন।ধীরে ধীরে সবাক চলচ্চিত্রের যুগ শুরু হয় ।ছবি কথা বলতে শিখল। ম্যাডান থিয়েটারে ‘জোর বরাতের’ নায়িকা রূপে তার সবাক চলচ্চিত্রে পদার্পণএবং অভিনয় । এই ছবিতে না জানিয়ে তাকে দিয়ে পরিচালক একটি চুম্বন দৃশ্যে অভিনয় করান।যা তাকে ভীষণভাবে অপমানিত ও ব্যথিত করে। এই বিষয়ে তিনি তাঁর আত্মজীবনী গ্রন্থে বলেছেন – ” ঘটনার আকস্মিকতায় হঠাৎ বিহ্বলহয়ে পড়লাম।সামলে
উঠতে সময় লাগল।যখন প্রকৃতিস্থ হলাম বিস্ময়, বেদনা ,অপমান ,অভিমান নিজের অসহায় অবস্থার জন্য কষ্ট সব মিলিয়ে একটা নিস্ফল কান্না যেন মাথা কুটতে লাগল”।
আরও পড়ুন- বিরোধী শূন্য পুরবোর্ডই লক্ষ্য
অভিভাবকহীন, আর্থিক সম্বলহীন ছিলেন বলে তাকে এমন বহু কঠিন পরিস্হিতির শিকার হতে হয়। ‘বাসবদত্তা ‘ ছবিতে শালীনতাহীন পোশাক পরে অভিনয় করতে হয় কাননদেবীকে ( সেই যুগের নিরিখে) যখন শরীর প্রদশর্নে দুঃসাহসীকতা দেখানোর কথা কেউ ভাবতে পারত না । পরিচালকের থেকে আর্থিকভাবে ঠকে যাবার অভিজ্ঞতাও ছিল তাঁর শিল্পী জীবনের ঝুলিতে। যা প্রতি মুহুর্তে তাকে অগ্নিপরীক্ষায় ফেলে। কিন্তু দমিয়ে দেওয়া যায়নি কানন দেবীকে।
ধীরে ধীরে শিল্পী জীবনের বিস্তার শুরু হয়। রাধা ফিল্মসের ‘ শ্রীগৌরাঙ্গ ‘ ছবিতে ‘ বিষ্ণুপ্রিয়া ‘ চরিত্রটি করে কানন দেবী প্রকৃত শিল্পীর সম্মান পান। এরপর ১৯৩৫ সালে ‘ মানময়ী গার্লস স্কুল ‘ এবং ১৯৩৭ এ’ মুক্তি ‘ ছবি তাকে সাফল্য ,প্রতিষ্ঠা দুই এনে দেয় ।বাংলা এবং হিন্দি ছবিতে দক্ষতার সঙ্গে অভিনয় করেছেন। তাঁর সমসাময়িক নামজাদা সহঅভিনেতা হিসেবে যাঁদের পেয়েছিলেন তারা হলেন কে এল সাইগল, পঙ্কজ মল্লিক, প্রমথেশ বড়ুয়া, পাহাড়ি সান্যাল, অশোক কুমার, ছবি বিশ্বাস।
নায়িকার পাশাপাশি তিনি ছিলেন সুগায়িকাও।তৎকালীন জনপ্রিয় নায়িকা এবং গায়িকা ছিলেন তিনি। তার দ্রুত লয়ে গান গাওয়ার ধরণ খুব জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল।ওস্তাদ আল্লারাখার কাছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের শিক্ষা নেন।এছাড়া তিনি ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়,রাইচাঁদ বড়াল ,কাজী নজরুল ইসলাম, অনাদি দস্তিদার,ও পঙ্কজ কুমার মল্লিকের কাছে তালিম নেন।আধুনিক গান ছাড়া ও রবীন্দ্রসঙ্গীতও গেয়েছিলেন।তিনি মেগাফোন গ্রামাফোন কোম্পানিতে সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। অসামান্যা সুন্দরী ছিলেন ।চলচ্চিত্রের ইতিহাসবিদ রবি বসুর মতে – কাননবালাকে দেখে অনেক যুবক ও প্রৌঢ়ের হৃদস্পন্দন বেড়ে যেত।
অভিনয় এবং সঙ্গীতের পাশাপাশি নৃত্যেও সমান পারদর্শী ছিলেন কানন দেবী।৭০টির ও বেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন তিনি। তার কৃতিত্বের জন্য পদ্মশ্রী সম্মান এবং দাদা সাহেব ফালকে পুরস্কারে ভূষিত হন।১৯৩৭ থেকে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত কানন দেবী খ্যাতির শীর্ষে । ১৯৪৮ এ গড়ে তুললেন ‘শ্রীমতী পিকচার্স ‘।এই কোম্পানির অন্তর্গত ছবিতে অভিনয় এবং প্রযোজনা করা ছাড়া নিজে পরিচালনাও করেছেন। তার ছবির একটি পরিচালকের তিন সদস্য বিশিষ্ট দল ছিল যার নাম সব্যসাচী। এই দলে তিনি ছিলেন অন্যতম পরিচালক।
কানন দেবীর প্রথম স্বামী ছিলেন ব্রাহ্ম সমাজের গোঁড়া শিক্ষাবিদ হেরম্ব চন্দ্র মৈত্রর পুত্র অশোক মৈত্র।সেই বিয়ে স্হায়ী হয়নি ।তাঁর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন হরিদাস ভট্টাচার্যকে তিনি ছিলেন তৎকালীন বাংলার গভর্নরের এডিসি ।পরবর্তী কালে যিনি কানন দেবীর সঙ্গে ছবি পরিচালনার কাজে যুক্ত হন।নানাধরনের সমাজসেবামূলক কর্মের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন কাননদেবী।বাংলা রূপোলি পর্দার ফার্স্ট লেডি কানন দেবীর বাংলা তথা হিন্দি সিনেমায় অবদান অনস্বীকার্য। লিখে গিয়েছেন আত্মজীবনী ‘সবারে আমি নমি ‘। ১৯৯২ সালে ৭৬ বছর বয়সে তিনি মারা যান।
তথ্য সৌজন্য – সবারে আমি নমি
কাননদেবীর আত্মজীবনী