বুদ্ধ পূর্ণিমার (Buddha purnima) দিন কলকাতার ধর্মতলায় ধর্মঠাকুরের পুজোর আয়োজন। আয়োজকরা গেরুয়া শিবিরের মৌলবাদী হিন্দুত্ব সমর্থক লোকজন। আপাত দৃষ্টিতে এই আয়োজন ও উদ্যোগে নেতিবাচক কিছু নেই। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যায়, কেন আশঙ্কার পাংশুটে মেঘ জমছে নৈর্ঝত কোণে। পুরাণ বলছে, নৈর্ঝত কোণ মানে দক্ষিণ-পশ্চিম দিক এবং ওই দিকের অধিপতি কোনও দেবতা নন, রাক্ষস।
প্রথমে আসি, হঠাৎ এমন ঘটা করে ধর্মঠাকুরের পুজো করার হিড়িক কেন, সে-কথায়।
স্বাধীনতা সংগ্রামের অত্যুঙ্গ দশায় ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের লগ্নে দেশের স্বাধীনতাকামী জনতার স্রোতে যোগ না দিয়ে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির দালালি করাটাকেই টিকে থাকার সর্বােত্তম পন্থা হিসেবে বেছে নিয়েছিল এ-দেশের দুটি রাজনৈতিক পক্ষ— হিন্দুত্ববাদীরা এবং বামপন্থীরা।
এরাই জায়গায় জায়গায় শ্রমিক ধর্মঘট ভেঙেছে, ইংরেজ পুলিশ প্রশাসনের চরবৃত্তি করেছে, এমনকী পরবর্তীতে ভারত ভাগকে মদত দিয়েছে।
হিন্দুত্ববাদী নেতা এম এস গোলওয়ালকর ‘এক বীর্যবান জাতীয়তার দিকে’ শীর্ষক প্রবন্ধে সরাসরি বলেছিলেন, ইংরেজ রাজশক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলন করাকে তাঁরা জাতীয়তাবাদ বলে মনে করেন না। হিন্দু মহাসভার নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বাংলার তদানীন্তন গভর্নর জন হাবার্টকে ২৬ জুলাই, ১৯৪২-এ লেখা একটি পত্রে লেখেন, তিনি ব্রিটিশ সরকারকে পূর্ণ সহযোগিতা দিতে তৈরি। এমনকী, ‘যদি কেউ জনতার আবেগ উস্কে দেওয়ার চেষ্টা করে, অভ্যন্তরীণ শান্তি ও নিরাপত্তায় বিঘ্ন ঘটায়’, তবে তা প্রতিরোধ করতে সাম্রাজ্যবাদী সরকার যা যা ব্যবস্থা নেবে, সেগুলোকে হিন্দুত্ববাদীরা পুরোদস্তুর সাহায্য করবে। অর্থাৎ, ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বিপ্লবীদের ওপর ব্রিটিশ পুলিশের দমন-পীড়ন নীতির সাহায্যকারী ভূমিকা নিতে দ্বিধা করেনি হিন্দু মহাসভা।
স্বাধীনতার প্রাক্কালে, ১৭ ও ২২ জুলাই, হিন্দুত্ববাদীদের মুখপাত্র ‘অর্গানাইজার’-এর পাতায় ওই গোলওয়ালকর স্পষ্ট ভাষায় লিখলেন, তাঁরা ভারতের ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা মানেন না। ১৯৪৮-এর ৩০ জানুয়ারি হিন্দু মৌলবাদী নাথুরাম গডসে গুলি করে মারলেন গান্ধীকে। সর্দার প্যাটেল মৌলবাদী হিন্দু সংগঠনগুলো নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেন।
এসব কথা ভুলিয়ে ও ঘুলিয়ে দেওয়ার জন্যই মোদি জমানায় সিনেমা হলে জাতীয় পতাকা নিয়ে এত অতিভক্তির আদিখ্যেতা। গান্ধীর দর্শন নয়, তাঁর চশমাটুকুকে স্বচ্ছ ভারত অভিযানের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার এবং কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে সর্দার প্যাটেলের একটি সুবিশাল মূর্তি নির্মাণ।
এতে এক ঢিলে দুই পাখি মরল। গেরুয়া পক্ষে এমন কোনও আইকন নেই ফাঁকে স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে দেশবাসী মান্যতা দিতে পারে। সেই জায়গায় প্যাটেলকে টেনে আনা গেল। একই সঙ্গে পূর্বকৃত পাপ খানিকটা ঢাকার ব্যবস্থাও হল। লোককে ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হল। কারা জাতীয় পতাকার অবমাননা করেছিল, গান্ধীকে হত্যা করেছিল আর কাদের প্যাটেল নিষিদ্ধ করেছিলেন, সেসব ইতিহাস।
একইভাবে ধর্মতলায় ধর্মপুজোর আয়োজনও একটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বন্দোবস্ত। ধর্মপুজোর কথা বিজয় সেনের ষষ্ঠ শতকের এক তাম্রলিপি থেকে জানা যায়। ইতিহাসবিদদের মতানুসারে, ধর্মই হলেন বৌদ্ধ দেবতা লোকনাথ, ত্রিলোকনাথ। গবেষক-অধ্যাপক পল্লব সেনগুপ্ত (রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও এশিয়াটিক সোসাইটির প্রাক্তন সভাপতি) তাঁর ‘পূজা পার্বণের উৎস কথা’ গ্রন্থে জানাচ্ছে, ‘ধর্ম’ শব্দটি বৌদ্ধ ত্রিশরণ (ধর্ম-সংঘ-বুদ্ধ)-এর অন্যতম। সমাজের অতি-নিম্নবর্গীয়দের মধ্যেই তাঁর ভক্তসমাজ আবদ্ধ। এঁরাই একদিন সামাজিক পীড়নে বৌদ্ধ হয়েছিলেন, ধর্মপুজোর মধ্যে এঁদের সেই পূর্বপুরুষাগত বিশ্বাস নিবন্ধ আছে।
তিনি আরও লিখেছেন, ধর্ম সম্ভবত প্রথমে ডোমজাতির উপাস্য দেবতা ছিলেন। ধর্ম-ধম্ম-ডম্ম-ডোম, এভাবেই ‘ডোম’ কথাটির উৎপত্তি। এর জন্যই রাঢ়বঙ্গে ডোমেরা নিজেদেরকে ‘ধর্মপুত্র’ বলে অভিহিত করেন। লোকসংস্কৃতির গবেষকরা জানাচ্ছেন, ধর্মঠাকুরের প্রধান পীঠস্থান ছিল বর্ধমান জেলা ও বীরভূম জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল।
জাতীয় পতাকা নিয়ে অতিভক্তি, গান্ধীর চশমাকে (তাঁর মতাদর্শকে নয়) প্রতীক হিসেবে ব্যবহার এবং প্যাটেলের বিশাল মূর্তি নির্মাণের পেছনে যেমন দ্বৈত উদ্দেশ্য যুগপৎ সাধনের প্রয়াস প্রচ্ছন্ন, অনুরূপভাবে ধর্মপূজার আয়োজনের পেছনেও দুটি উদ্দেশ্য আছে। এক, বৌদ্ধ সংস্কৃতিকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে হিন্দি-হিন্দুত্ববাদী সংস্কৃতির অগ্রাসন নিশ্চিতকরণ। দুই, ডোম-সহ অতি নিম্নবর্গীয়দের হিন্দুবাদীর মৌল পরিধিতে জায়গা করে দেওয়া, যাতে গেরুয়া পক্ষের জনভিত্তি ছলেবলে কৌশলে হলেও একটু পোক্ত হয়।
এতেও অসুবিধা ছিল না।
অসুবিধাটা আসলে একটা আশঙ্কার কারণে। এবং সেই আশঙ্কা তথ্য-পরিসংখ্যানভিত্তিক। কোনও অহেতুক অমূলক শঙ্কা তা নয়।
আরও পড়ুন-স্বাস্থ্যসাথীতে নজির হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপন
একটি সর্বভারতীয় ইংরেজি দৈনিক রীতিমতো তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে লেখচিত্র সহযোগে সম্প্রতি দেখিয়েছে, রামনবমী এদেশে বহুদিন ধরে পালিত হয়। কিন্তু মে, ২০১৪-তে মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পূর্ববর্তী সময়ে, ২০১২, ২০১৩, এমনকী ২০১৪-তেও রামনবমীকে ঘিরে একটা করে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের খবর আসত।
মোদি জমানা শুরু হওয়ার পর থেকে, ২০১৬, ২০১৮ ও ২০১৯-এ একটির বদলে দুটি করে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ ঘটতে শুরু করে।
২০২০ ও ২০২১-এ কোভিড অতিমারির কারণে মিছিল সমাবেশে নিষেধাজ্ঞা ছিল। ফলে, রামনবমীকে ঘিরে কোনও সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি।
কিন্তু ২০২২-এ দেশের পাঁচটি রাজ্যে রামনবমী পালন ঘিরে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ঘরে মধ্যপ্রদেশের খড়গাঁওতে। তিন জন পুলিশ-সহ কমপক্ষে ২০ জন আহত হন। গ্রেফতার হন ১৭০ জন।
আর এ-বছর, অর্থাৎ ২০২৩-এ রামনবমী পালন ঘিরে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে আটটি রাজ্যে।
এই ঘটনাগুলোর মূল কারণ হিসেবে ওই সংবাদপত্রটি দুটি বিষয়কে নির্দেশ করেছে। এক অনুমোদিত রাস্তার বদলে অন্য রাস্তা দিয়ে রামনবমীর মিছিল যাওয়া এবং সেই মিছিল থেকে প্ররোচনামূলক স্লোগান দেওয়া, বিতর্কিত গান বাজানো বা গাওয়া, ঘৃণাভাষণ প্রদান।
আর দুই, মিছিল থেকে ভিন্নধর্মীদের ধর্মস্থান বা উপাসনা স্থলে পাথর বা ইট নিক্ষেপ।
ধর্মপূজা পরবর্তীকালে এরকম বিদ্বেষ-বিষ ছড়ানোর কারণ হয়ে উঠতে পারে, এই ভাবনাই তাবৎ শঙ্কার কারণ।
অহিংসার পুজারির পবিত্র জন্মতিথিকে যেন হিংসার পুজারিরা কলুষিত না-করতে পারে, সে-দায়িত্ব কেবল পুলিশ-প্রশাসনের নয়, নাগরিক সমাজের শুভবুদ্ধির বলয়ই ভারতের বহুত্ববাদী সংস্কৃতির অন্তিম আশ্রয়।