মন্দির-শহর ঢেঙ্কানল

আছে জঙ্গল, আছে পাহাড়। মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ। তবু ঢেঙ্কানলের পরিচিতি মন্দির-শহর নামে। কারণ শহরে এবং আশপাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে বেশকিছু ছোট-বড় মন্দির। প্রাচীন ভারতের স্থাপত্য সম্পর্কে আগ্রহ থাকলে দু-চারদিনের জন্য ঘুরে আসতে পারেন। লিখলেন অংশুমান চক্রবর্তী

Must read

ওড়িশার ঢেঙ্কানল (Odisha-Dhenkanal)। জায়গাটার নাম শোনা শোনা লাগছে? হতেই পারে। কারণ এখানেই জন্মেছিলেন বাংলা ভাষার স্বনামধন্য কবি-সাহিত্যিক, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির প্রথম সভাপতি অন্নদাশঙ্কর রায়। তাই শিক্ষিত বাঙালির কাছে নামটি যথেষ্ট সুপরিচিত। যাঁরা সবুজ প্রকৃতি ভালবাসেন, তাঁদের মনের মতো জায়গা। আছে পাহাড়, আছে জঙ্গল। এখানকার নির্জন নিরিবিলি পরিবেশ পর্যটকদের মন ভাল করে দিতে পারে। ঢেঙ্কানলে আছে বেশ কিছু প্রাচীন মন্দির। তাই অনেকেই বলেন, মন্দির-শহর। মন্দিরগুলো দেখলে প্রাচীন ভারতের স্থাপত্য সম্পর্কে ধারণা হবে। যে কোনও সময় যাওয়া যায়। তবে বর্ষা এবং শীত ঢেঙ্কানল (Odisha-Dhenkanal) বেড়ানোর আদর্শ সময়। বৃষ্টির মরশুমে হাতে দুই-চারদিন সময় নিয়ে সপরিবারে ঘুরে আসতে পারেন। তার আগে জেনে নিন, শহরে এবং কাছেপিঠে কী কী দর্শনীয় স্থান আছে?

সপ্তশয্যা
সপ্তশয্যা একটি চিরসবুজ গ্রাম। ঢেঙ্কানল শহর থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। মূলত পার্বত্য এলাকা। আছে ঘন জঙ্গল। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মুগ্ধ করার মতো। মানসিক শান্তি খুঁজতে চাইলে এর চেয়ে ভাল জায়গা খুব বেশি পাবেন না। জনশ্রুতি, বনবাস-পর্বে রাম, সীতা, লক্ষ্মণ নাকি এখানে সাতদিন ছিলেন। তাই ঢেঙ্কানলের রানি রত্নপ্রভাদেবী এখানে রামমন্দির তৈরি করেন। রামনবমীর দিন বিশাল উৎসব আয়োজিত হয়। হয় প্রচুর লোক সমাগম। আরও একটি জনশ্রুতি, অজ্ঞাতবাসের সময় পাণ্ডবরা নাকি এখানে কিছুদিন ছিলেন। এখানকার জলপ্রপাত এবং টিকউড গার্ডেন দেখার মতো।

কনকেশ্বর মন্দির
ঢেঙ্কানল (Odisha-Dhenkanal) শহর থেকে ৭২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত কনকেশ্বর মন্দির। তালচের শহর থেকে দূরত্ব ২৫ কিলোমিটার। মন্দিরে পূজিত হন কনকেশ্বর, বৈদ্যনাথ, পশ্চিমেশ্বর এবং কপিলেশ্বর। ওড়িশায় যে সময় থেকে মন্দির তৈরি শুরু হয়েছে, সেই সময়কার নিদর্শন পাওয়া যায় এখানে।

কপিলাস
ঢেঙ্কানল (Odisha-Dhenkanal) শহর থেকে ২৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত কপিলাস। উচ্চতা ২২৩৯ ফুট। এখানে রয়েছে পয়ামৃত কুণ্ড এবং মারিচী কুণ্ড। জানা যায়, রাজা নরসিংহদেবের রাজত্বকালে, ১২৪৬ অব্দে এখানে মহাদেব চন্দ্রশেখরের মন্দির নির্মাণ করা হয়। কপিলাস পাহাড়ের শীর্ষে। এই মন্দিরে পৌঁছনোর দুটি পথ। একটি গাড়ি নিয়ে যাওয়ার, অন্যটি পায়ে হেঁটে। ১৩৫২টি সিঁড়ি হেঁটে পাহাড়ে উঠতে হয়। পাহাড়ে রয়েছে বেশ কিছু প্রাচীন গুহা। শ্রীধর স্বামীর নাম জড়িয়ে রয়েছে এই পাহাড়ের সঙ্গে। তিনি ভাগবতের প্রচার শুরু করেন। প্রবর্তন করেন মহিমা গোঁসাই নামে বৈষ্ণব ধর্মের এক শাখা। ইতিহাসবিদদের মতে, এখানেই প্রথম ছিল কপিল মুনির আশ্রম। জায়গাটা পরে দ্বিতীয় কৈলাস হিসেবে জনপ্রিয় হয়। যে কারণে কৈলাসের সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে কপিলাস নামটা হয়েছে। কার্তিক, গণেশ, গঙ্গা, জগন্নাথ নাকি এখানে তপস্যা করেছেন। সারা বছর বহু মানুষের সমাগম হয়।

আরও পড়ুন-সমলিঙ্গের দম্পতিদের সুবিধা দেওয়ার ভাবনা কেন্দ্রের

জোরান্ডা
মহিমা গোঁসাইয়ের সমাধি এখানকার বিশেষ আকর্ষণ। জোরান্ডাই মহিমা ধর্মের প্রধান কার্যালয়। বহুদিন আগে থেকেই জায়গাটা জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এছাড়া এখানকার শূন্য মন্দির, গদি মন্দির এবং ধুনি মন্দির দেখার মতো। মাঘ মাসের পূর্ণিমায় এখানে মেলা বসে। বছরের বড় উৎসবে কৌপীনধারী সাধকদের দেখা মেলে।

নাগনাথেশ্বর মন্দির
ঢেঙ্কানল থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরে নাগিনা গ্রামে রয়েছে নাগনাথেশ্বর মন্দির। প্রতি বছর শিবরাত্রিতে ভক্ত সমাগম হয়। জানা যায়, একসময় এখানে ছিল কেশারী বংশের রাজত্ব। মনে করা হয়, এটাই ওড়িশার সবচেয়ে পুরনো শিবমন্দির। সুপ্রাচীন দারুকাবন বা নিমবন রয়েছে এখানে। অঙ্গ এবং কলিঙ্গের সীমান্তে অবস্থিত এই জায়গায় পুরনো একটি দুর্গের ধ্বংসাবশেষ দেখতে পাওয়া যায়।

শ্রীরঘুনাথ মন্দির
ঢেঙ্কানলের বিখ্যাত বৈষ্ণব পীঠস্থান। স্থাপত্যের দিক দিয়েও খুবই উচ্চমানের। এখানে হয় নিত্যপুজো। প্রতিদিন বহু দর্শনার্থী ভিড় জমান। পুজো দেন। দেবতার আশীর্বাদ নেন।

অষ্টশম্ভু মন্দির
ঢেঙ্কানল থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরত্বে গোদাবরী নদীর তীরে অবস্থিত এই মন্দির। নদীর তীরে আটটি জায়গায় রয়েছে আলাদা শিবমন্দির। যে কারণে এই মন্দিরকে অষ্টশম্ভু মন্দির বলা হয়। জানা যায়, দশম শতাব্দীতে নির্মিত হয়েছিল মন্দিরটি। দেখা যায় কলিঙ্গ স্থাপত্যকলার নিদর্শন। মন্দিরে ৪.১৫ মিটারের একটি বিমানের আদল রয়েছে। অষ্টশম্ভু মন্দির ভুবনেশ্বর স্টেশন থেকেও যাওয়া যায়। দূরত্ব দুই কিলোমিটার।

যতন নগর রাজপ্রাসাদ
ঢেঙ্কানলের আরও একটি আকর্ষণীয় জায়গা যতন নগর রাজপ্রাসাদ। প্রাসাদটি ধ্বংসপ্রাপ্ত। পাহাড়ের চূড়ার উপর অবস্থিত। কঙ্কালসার চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে। যেতে হয় দীর্ঘ নির্জন পথ পেরিয়ে। জঙ্গলে ঘেরা। পুরো পরিবেশটাই ভৌতিক। গা ছমছমে। প্রাসাদটি ঘিরে লোকমুখে ছড়িয়েছে কিছু গল্প। জানা যায়, একটা সময় নাকি ১০০টি ঘর ছিল। প্রাসাদটি তৈরির সময় পাথর তুলতে নাকি মানুষের পাশাপাশি কয়েকটা বিশাল আকারের হাতিকে ব্যবহার করা হয়েছিল। একটা সময় গমগম করত প্রাসাদ। বসবাস করতেন রাজ পরিবারের সদস্যরা। অথচ কোনও একদিন পরিবারের সবাই রহস্যজনকভাবে উধাও হয়ে যায়। তারপর থেকেই প্রাসাদটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে।

দণ্ডধর ড্যাম
ঢেঙ্কানল শহর থেকে ৬৭ কিলোমিটার দূরে রামিয়াল নদীর উপর অবস্থিত। সারা বছর বহু মানুষ বেড়াতে আসেন। নদীর স্বচ্ছ জল পর্যটকদের আনন্দ দেয়।

সারঙ্গ
ব্রাহ্মণী নদীর তীরে অবস্থিত সারঙ্গ। এখানে বিষ্ণুর আরাধনা করা হয়। দেবতা এখানে পাথরের উপর শায়িত। নানা সময় আসেন বহু মানুষ।

Latest article