শরৎ-উপন্যাসের কয়েকটি নারী চরিত্র

Must read

১৫ সেপ্টেম্বর অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্মদিন। তাঁর উপন্যাসের কয়েকটি নারী চরিত্রের উপর আলোকপাত করলেন অংশুমান চক্রবর্তী

 

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁকে বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় কথাশিল্পী মনে করা হয়। দূর থেকে নয়, তিনি জীবনকে দেখেছেন সাধারণের অন্দরমহলে প্রবেশ করে। নিখুঁত সেই দেখা। অসাধারণ দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছেন সাধারণ মানুষের সুখ, দুঃখ, হাসি, কান্না, ব্যথা, বেদনার কথা। তাঁর সাহিত্য অনেকটাই আয়নার মতো। এক-একটি চরিত্রের মধ্যে পাঠকরা দেখতে পান নিজেদের ছায়া। একজন পুরুষ হয়েও তিনি খুব সহজেই উপলব্ধি করতে পারতেন নারী-হৃদয়কে। তাই তো তাঁর সৃষ্ট নারী চরিত্ররা অতিমাত্রায় রক্তমাংসের। জীবন্ত। চরিত্রগুলিতে যেমন আলো আছে, তেমন কালোও আছে। জনপ্রিয় হয়েছে প্রতিটি চরিত্রই। তাঁর সৃষ্ট নারী চরিত্ররা এক-একজন এক-এক রকম। কেউ সাধারণ মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত ঘরের, আবার কেউ উচ্চবিত্ত। ছকভাঙা নারীদের কথাও তিনি লিখেছেন। বিধবা, বৈষ্ণবী, সতী, পতিতা, অরক্ষণীয়া প্রত্যেকেই সসম্মানে ঠাঁই পেয়েছেন শরৎচন্দ্রের বিভিন্ন উপন্যাসে। আলো ফেলা যাক তাঁর উপন্যাসের কয়েকটি নারী চরিত্রের উপর।

আরও পড়ুন-পুলিশ খালি করল মুকুলের বাড়ি, যোগেনকে মোটা জরিমানা, ছাড় পেলেন দীনেশ

‘পল্লীসমাজ’ উপন্যাসে আছেন রমা। তিনি জমিদারি পরিচালনা করেন। তাঁর চরিত্রটি অপেক্ষাকৃত জটিল। মুখে বিরোধিতা করলেও, তিনি মনে মনে সমর্থন করেন রমেশকে। রমেশের প্রতি তিনি প্রবলভাবে দুর্বল। তবে নীরবে। প্রিয়পুরুষের কাছে নিজেকে সঁপে দিতে ইচ্ছে করে তাঁর। তবে বাধ্য হয়ে পিছিয়ে আসেন। দুজনের সম্পর্কে বাধা হয়ে দাঁড়ায় গ্রাম্য কদাচার। এই রমা আমাদের বড়ো চেনা। উপন্যাসে দেখা যায় বিশ্বেশ্বরীকে। যিনি রমেশের জ্যাঠাইমা। বেণীর মা। রমেশ সৎ, প্রজাবৎসল। বেণী তার উল্টোপিঠ। এই দুজনের মাঝে রয়েছেন বিশ্বেশ্বরী। তাঁর আছে সন্তানস্নেহ। পাশাপাশি তিনি এক আদর্শপরায়ণ মহিলা। যিনি পক্ষ নেন ন্যায়ের। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গোরা’ উপন্যাসের আনন্দময়ীর ছায়া দেখা যায় এই মহিয়সী নারী চরিত্রে। এককথায় তিনি একজন আদর্শ বঙ্গনারী। শরৎচন্দ্রের সার্থক নির্মাণ।

আরও পড়ুন- ভবানীপুরে মীরজাফরদের জায়গা নেই: ফিরহাদ হাকিম

‘বড়দিদি’ উপন্যাসে দেখতে পাই মাধবীকে। তিনিই বড়দিদি। অতিমাত্রায় মায়াবী। যিনি আড়ালে থাকেন। সহ্য করেন। আগলে রাখেন। যাঁর আছে ফুলের মতো পবিত্র একটি মন। সুরেন্দ্র কিছুতেই বুঝে উঠতে পারেন না তাঁকে। শুধু এটুকু বোঝেন, বড়দিদি আছেন। এটাই মস্তবড় ভরসা।
‘গৃহদাহ’র অচলা চরিত্রের মধ্যে মিশে রয়েছে আলো এবং অন্ধকার। উপন্যাস জুড়ে রয়েছে বৈধ-অবৈধের দ্বন্দ্ব। একদিকে স্বামী মহিম, অন্যদিকে সুরেশ। প্রেমের ত্রিমুখী সংঘর্ষে সৃষ্টি হয়েছে তীব্র অন্তর্দাহ। অচলার দেহ অশুদ্ধ হলেও তিনি পতিব্রতা। যদিও নৈতিক হিন্দু সমাজে তাঁর ঠাঁই নেই। কারণ বিবাহোত্তর নারীর প্রেম সমাজবিরুদ্ধ। স্বামীর প্রতি হৃদয়ের একাগ্রতা হারানো অপরাধ, একনিষ্ঠতার অভাব পাপাচার। ফলে অচলা অপরাধী। যে কারণে তাঁর শেষ পরিণতি নিরাশ্রয়তায়, সমাজ-বিচ্ছিন্নতায়।

আরও পড়ুন-ভবানীপুরে মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে প্রার্থী এন্টালির “গো-হারা” প্রিয়াঙ্কা! বিজেপির অন্তর্দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে

‘দেবদাস’ উপন্যাসের দুই প্রধান নারী চরিত্র পার্বতী এবং চন্দ্রমুখী। প্রথমজন প্রেমিকা, দ্বিতীয়জন রক্ষিতা, বারবনিতা। একজন আঘাত দিলে, অন্যজন ক্ষতের প্রলেপ। বৈধ অবৈধের সীমা অতিক্রম করে এই উপন্যাসে আলো পেয়ে যায় সম্পর্কের তীব্র টানাপোড়েন। নায়ক দেবদাসের পাশে অতিমাত্রায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠেন বিপরীত চরিত্রের দুই নারী।
এবার ‘শ্রীকান্ত’। এই উপন্যাসের তিন প্রধান নারী চরিত্র রাজলক্ষ্মী, কমললতা, অন্নদাদিদি সমাজকে অস্বীকার করে ছিটকে বেরোতে চেয়েছেন। কিন্তু পারেননি সমাজের তুচ্ছ সংস্কারের মোহ ত্যাগ করতে। যদিও রাজলক্ষ্মীর বৈধব্য ও পেশাকে শ্রীকান্ত সংস্কারবোধ ও প্রচলিত সামাজিক মূল্যবোধের মাপকাঠিতে বিচার করেছেন।

আরও পড়ুন-মন্ত্রী-বিধায়কদের নামে চার্জশিট দেওয়ায় “আইনি গলদ”, এবার স্পিকারের সম্মুখীন সিবিআই-ইডি

‘অরক্ষণীয়া’ উপন্যাসে শরৎচন্দ্র এক সমাজ পরিত্যক্তা নারীর চরম দুর্দশার ছবি পাঠকদের সামনে তুলে ধরেছেন। এই উপন্যাসের ১১ বছরের নাবালিকা কন্যা জ্ঞানদা এককথায় অনন্যসাধারণ একটি চরিত্র। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সেরা করুণ নারী চরিত্র বললেও ভুল বলা হবে না। এই চরিত্র মনকে করে তোলে বেদনাসিক্ত।
ভারতে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে এক অসাধারণ বিপ্লবী সব্যসাচী ও তাঁর সঙ্গীদের সংগ্রামের কাহিনী নিয়ে লেখা উপন্যাস ‘পথের দাবী’। বইটি নিষিদ্ধ হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে। সব্যসাচীর পাশে দেখা গেছে কয়েকজন নারীকে। যাঁরা দেশের জন্য নিজেদের উৎসর্গ করেছিলেন।
‘পরিণীতা’ উপন্যাসের ললিতা একটি উল্লেখযোগ্য নারী চরিত্র। তিনি অনাথিনী। তাঁর কাকা দরিদ্র ব্রাহ্মণ। জমিদার-পুত্র শেখরের সঙ্গে ললিতার বন্ধুতা। যদিও বিষয়টি ভালো চোখে দেখেন না জমিদার। তিনি ললিতাকে অপমান করেন। যদিও জেদী ললিতাই একদিন হয়ে ওঠেন জমিদারের পুত্রবধূ।

আরও পড়ুন-সরকার গড়লেও অর্থসংকট বন্ধ আন্তর্জাতিক সাহায্য, বেকায়দায় তালিবান

‘শেষ প্রশ্ন’ উপন্যাসের কমল চরিত্রে চারিত্রিক দ্বন্দ্বের চেয়ে মতাদর্শের দ্বন্দ্ব প্রকট। অবাধে একাধিক পুরুষকে তিনি জীবনসঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করেছেন। এই উপন্যাসে উন্মোচিত হয়েছে বিবাহিত নারীর নৈতিক সংকট।
‘নিষ্কৃতি’ উপন্যাসে দেখা যায় তিন নারী চরিত্র। সিদ্ধেশ্বরী, নয়নতারা, শৈল। শৈল ছিল সবার ছোট। কিন্তু সংসারের সমস্ত দায়িত্ব ছিল তাঁর কাঁধে। তিনি ছিলেন বড়ো জা সিদ্ধেশ্বরীর কন্যাসমা। কিন্তু কুটিল নয়নতারার বিষমন্ত্রে সেই সম্পর্কে চিড় ধরে। স্বামী-সন্তান নিয়ে গৃহত্যাগ করেন শৈল। সম্পর্কের জটিলতা এই উপন্যাসে প্রবলভাবে ফুটে উঠেছে।
‘দত্তা’ উপন্যাসে আছেন বিজয়া। তিনি এক দৃঢ়চেতা নারী। বুদ্ধিমতী। নিজের সিদ্ধান্তে অবিচল থাকেন। তাই সহজেই বুঝতে পারেন কোনটা ঠিক কোনটা ভুল। তাঁর কাছে গুরুত্ব পান সকল ধর্মের মানুষ। এই নারী চরিত্র বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সেরা চরিত্র।

আরও পড়ুন- মনোনয়ন জমা দিয়েই গণেশ বন্দনায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়

গভীর বিশ্লেষণ নয়, শরৎ-উপন্যাসের কয়েকটি নারী চরিত্রের উপর স্বল্প পরিসরে আলোচনা করা হল। এ যেন নৌকায় ভেসে যাওয়া। গভীরভাবে চরিত্রগুলোর সন্ধান পেতে হলে তাঁর সৃষ্টির অতলে পাঠকদের তলিয়ে যেতে হবে। শরৎ-সৃষ্ট এই নারী চরিত্রগুলো আসলে আমাদের বড়ো চেনা। যেন প্রতিদিনের দেখা এক-একটি চরিত্র। যাঁদের সঙ্গে আমাদের নিত্য ওঠাবসা, ভাব বিনিময়। আসলে বদল ঘটেছে সময়ের, চরিত্রগুলোর নয়। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সৃষ্টিকর্তার সাফল্য এখানেই।

Latest article