প্রতিবেদন : ভারতে আইন ধর্মীয় বিধিনিষেধ থেকে শুরু করে বর্তমান সাংবিধানিক ও আইনি ব্যবস্থায় বিকশিত হয়েছে, যা ধর্মনিরপেক্ষ আইনি ব্যবস্থা এবং সাধারণ আইনের মধ্য বহু পথ অতিক্রম করে এসেছে। ভারতে বৈদিক যুগ থেকে শুরু করে একটি নথিভুক্ত আইনি ইতিহাস রয়েছে এবং ব্রোঞ্জ যুগ এবং সিন্ধু উপত্যকা সভ্যতার সময় কিছু ধরণের নাগরিক আইন ব্যবস্থা চালু ছিল। ধর্মীয় বিধিনিষেধ এবং দার্শনিক চিন্তাভাবনার বিষয় হিসাবে আইনের ভারতে একটি বর্ণাঢ্য ইতিহাস রয়েছে। বেদ, উপনিষদ এবং অন্যান্য ধর্মীয় গ্রন্থ থেকে উদ্ভূত, এটি একটি উর্বর ক্ষেত্র ছিল যা বিভিন্ন হিন্দু দার্শনিক বিদ্যালয়ের অনুশীলনকারীদের দ্বারা এবং পরে জৈন ও বৌদ্ধদের দ্বারা সমৃদ্ধ হয়েছিল।
আইন ব্যবস্থার ইতিহাসে
ভারতে আইন ব্যবস্থা অঞ্চল থেকে অঞ্চলে এবং শাসক থেকে শাসক পর্যন্ত ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়। দেওয়ানি এবং ফৌজদারি বিষয়গুলির জন্য আদালত ব্যবস্থা প্রাচীন ভারতের অনেক শাসক রাজবংশের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য ছিল। মৌর্যদের (321-185 খ্রিস্টপূর্বাব্দ) এবং মুঘলদের (16 তম – 19 শতক) অধীনেও চমৎকার আদালত ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল যা বর্তমান সাধারণ আইন ব্যবস্থাকে পথ দেখিয়ে ছিল।
সাধারণ আইন ব্যবস্থা বা নথিভুক্ত বিচার বিধির নজিরগুলির উপর ভিত্তি করে আইনের একটি সুষম ব্যবস্থা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে ভারতে এসেছিল। ১৭২৬ সালে রাজা জর্জ-এর দ্বারা প্রথম ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে মাদ্রাজ, বোম্বে এবং কলকাতায় ( বর্তমানে যথাক্রমে চেন্নাই, মুম্বাই এবং কলকাতা) “মেয়রস কোর্ট” প্রতিষ্ঠার জন্য সনদ দেওয়া হয়েছিল। পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভের পর কোম্পানির বিচার সংক্রান্ত কার্যাবলী উল্লেখযোগ্যভাবে প্রসারিত হয় এবং ১৭৭২ সালের মধ্যে কোম্পানির আদালত তিনটি প্রধান শহর থেকে বিস্তৃত হতে শুরু করে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ধীরে ধীরে তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন জায়গাগুলিতে বিদ্যমান মুঘল আইনি ব্যবস্থা প্রতিস্থাপন করতে থাকে।
১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের পর, ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অঞ্চলগুলির নিয়ন্ত্রণ ব্রিটিশ ক্রাউনের হাতে চলে যায়। সাম্রাজ্যের অংশ হওয়ায় ভারতীয় আইনি ব্যবস্থায় পরবর্তী বড় পরিবর্তন দেখা যায়। বিদ্যমান মেয়র আদালতের পরিবর্তে সুপ্রিম কোর্ট প্রতিষ্ঠিত হয়।১৮৬২ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট কর্তৃক গৃহীত ভারতীয় হাইকোর্ট আইন দ্বারা অনুমোদিত পেটেন্টের চিঠির মাধ্যমে এই আদালতগুলিকে প্রথম হাইকোর্টে রূপান্তরিত করা হয়েছিল। নিম্ন আদালতের সুপারিনটেনডেন্স এবং আইন প্র্যাকটিশনারদের নথিভুক্তকরণ সংশ্লিষ্ট উচ্চ আদালতে নিযুক্ত করা হয়েছিল। হিসাবমতো সেই সময়ই, এই কলকাতা হাইকোর্ট স্থাপনা হয়েছিল। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর নতুন দেশকে এবং দেশের নাগরিকদের সুসংঘব্ধ ব্যবস্থার মাধ্যমে পরিচালনার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট আইন ব্যবস্থা এবং সংবিধান তৈরির প্রয়াস শুরু হয়। তৈরি হয় ভারতীয় সংবিধান এবং সেই মহামান্য সংবিধান পরিচালনা এবং প্রতিষ্ঠিতকরণের জন্য বিভিন্ন রাজ্য অনুযায়ী উচ্চ আদালতের উপর দায়িত্ব ন্যস্ত হতে থাকে।
আরও পড়ুন : সাহিত্য ও ইতিহাসের মেলবন্ধন
কলকাতা হাইকোর্টের ইতিহাস
কলকাতা হাইকোর্ট ১৮৬২ সালে, ১৪ মে পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতায় প্রতিস্থিত হয়। কলকাতায় থাকলেও তার কার্যকরী জুরিসডিকশান বিশাল অঞ্চল জুড়ে রয়েছে। কলকাতা হাইকোর্ট (এক্সটেনশন অফ জুরিসডিকশন) অ্যাক্ট, ১৯৫৩ অনুযায়ী, ২ মে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত কলকাতা হাইকোর্টের এখতিয়ার চন্দননগর (বর্তমানে চন্দননগর বলা হয়) এবং আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জকে আওতায় আনার জন্য প্রসারিত করা হয়েছিল। কলকাতা হাইকোর্ট তার সার্কিট বেঞ্চকে প্রসারিত করেছিল আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের রাজধানী পোর্ট ব্লেয়ারে এবং উত্তরবঙ্গ অঞ্চলের বিভাগীয় সদর দপ্তর জলপাইগুড়িতে। ৭ ফেব্রুয়ারী ২০১৯-এ, ভারতের রাষ্ট্রপতি রাম নাথ কোবিন্দ নতুন সার্কিট বেঞ্চ জলপাইগুড়িতে করার বিষয়টি চূড়ান্ত করেছেন যেটির অধীনে ৫ টি জেলা -দার্জিলিং, কালিম্পং, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার এবং কোচবিহারের রয়েছে।
হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি আদালতের বর্তমান প্রধান বিচারপতি হলেন বিচারপতি প্রকাশ শ্রীবাস্তব। স্যার বার্নস পিকক ছিলেন হাইকোর্টের প্রথম প্রধান বিচারপতি। ১৮৬২ সালের ১ জুলাই আদালত প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বিচারপতি রমেশ চন্দ্র মিত্র ছিলেন প্রথম ভারতীয় ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি এবং বিচারপতি ফণী ভূষণ চক্রবর্তী ছিলেন আদালতের প্রথম ভারতীয় স্থায়ী প্রধান বিচারপতি। সবচেয়ে বেশি সময় ধরে প্রধান বিচারপতি ছিলেন বিচারপতি শঙ্কর প্রসাদ মিত্র।
স্থাপত্যের ইতিহাস
নিও-গথিক স্থাপত্যের হাইকোর্ট ভবনটি ১৮৭২ সালে নির্মিত হয়েছিল, আদালত প্রতিষ্ঠার দশ বছর পরে। এই বিল্ডিঙের নকশা তৎকালীন সরকারী স্থপতি ওয়াল্টার গ্র্যানভিল, বেলজিয়ামের তেরশো শতকের ক্লথ হলের আদলে তৈরি করেছিলেন। কাজের পরিধি বাড়াতে ১৯৭৭ সালে হাইকোর্ট সেন্টেনারি বিল্ডিং বা অ্যানেক্সড বিল্ডিং নামে আরেকটি ভবন উদ্বোধন করা হয়।