সাহিত্য ও ইতিহাসের মেলবন্ধন

অমর কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতিবিজড়িত সামতাবেড়-এর বসতবাটি। লিখেছেন সুগত চক্রবর্তী

Must read

প্রতিবেদন : সময়টা তখন ১৯১৯-২০ সাল। কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বর্মা থেকে ফিরে এলেন মাতৃভূমি বাংলায়। প্রথম পক্ষের স্ত্রী শান্তিদেবী ও শান্তিদেবীর গর্ভজাত একমাত্র পুত্র, দু’জনেরই মহামারী প্লেগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু ঘটেছে বর্মাতেই। কথাশিল্পীর আর মন বসছে না বর্মাতে। এমন একটা জায়গা খুঁজছিলেন যা দেবে দু’ দণ্ড শান্তি, ভুলিয়ে দেবে স্ত্রী-পুত্রের অকালমৃত্যুর শোক। সেই জায়গা খুঁজে পেলেন বর্তমান হাওড়া জেলার অন্তর্ভুক্ত সামতাবেড় গ্রামে। ১৯২৩ সালে ১,১০০ টাকার বিনিময়ে কিনলেন সেখানে জমি। ১৯২৫ সালে গড়ে তুললেন দোতলা বসতবাটি। ১৯২৬-৩৮, এই ১২ বছর বাস করলেন সেই বাড়িটিতে। এই বাড়িটিতেই বসে সৃষ্টি করলেন একের পর এক অমর সাহিত্য। অভাগীর স্বর্গ, রামের সুমতি, কমললতা, শ্রীকান্ত (চতুর্থ পর্ব), পল্লীসমাজ… একদম শেষে লিখলেন বিপ্রদাস। কিন্তু শুধু সাহিত্য সৃষ্টিই তো মূল উদ্দেশ্য নয়, মাতৃভূমি যে পরাধীন, অতএব, এই বাড়িতেই শুরু হল বিপ্লবীদের গোপন বৈঠক ও আস্তানা। সেই সময়ের একাধিক স্বাধীনতা যোদ্ধা, যাঁদের মধ্যে রয়েছেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর মতো নাম, তাঁদের পদধূলি পড়েছিল এই বাড়িতে। এবং সেই সময়েই এই বাড়িতে বসে শরৎচন্দ্রের কলম সৃষ্টি করল ‘পথের দাবী’র মতো উপন্যাস।

সেই বাড়ির উদ্দেশেই একদিন যাত্রা করেছিলাম, দক্ষিণ-পূর্ব রেলওয়ের হাওড়া- মেদিনীপুর লাইনের দেউলটি স্টেশনে নেমে পনেরো মিনিটের টোটো যাত্রা শেষে পৌঁছে গেলাম এই ঐতিহাসিক বাড়ির দোরগোড়ায়। মূল ফটক দিয়ে ঢুকতে গিয়েই থমকে দাঁড়ালাম, ফটকের পাশের দেওয়ালে শ্বেতপাথরের ফলকে খোদাই করা ‘মহেশ’ গল্পের গফুরের সেই উক্তি— ‘‘আল্লা, আমাকে যতখুশি সাজা দাও, কিন্তু আমার মহেশ তেষ্টা নিয়ে মরেছে, তার চরে খাওয়ার মত জমি কেউ রাখেনি, যে তোমার দেওয়া মাঠের ঘাস, তোমার দেওয়া তেষ্টার জল, তাকে খেতে দেয়নি তার কসুর তুমি যেন মাপ কোরো না।” মনে পড়ল, এই বাড়িতে বসেই শরৎচন্দ্র লিখেছিলেন ‘মহেশ’। চোখে পড়ল বাড়ির ঠিক বিপরীতে একটি পুকুর, মনে পড়ল, ‘পল্লীসমাজ’ও তো এই বাড়িতে বসেই লেখা, এই তো সেই গল্পের পুকুর। বাড়িতে ঢুকেই প্রশস্ত লন, চারপাশে ফুলের গাছ, বাঁদিকে শরৎচন্দ্রের মর্মর মূর্তি। একটু এগোলেই কথাশিল্পীর বানানো দোতলা বাড়ি। বাড়িটি ব্রহ্মদেশীয় স্থাপত্য অনুসরণে তৈরি। বাড়িটির বর্তমান মালিক শরৎচন্দ্রের ভ্রাতুষ্পুত্র জয় চট্টোপাধ্যায়। তিনি কলকাতায় বাস করেন। সামতাবেড়ের এই বাড়িটি প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে রক্ষণাবেক্ষণ করছেন অশীতিপর দুলাল মান্না মহাশয়। তিনিই জানালেন, এবং ঘুরিয়ে দেখালেন গোটা বাড়িটি। বাড়ির সামনে শরৎচন্দ্রের নিজের হাতে লাগানো পেয়ারা গাছ, যা আজ মৃত, কিন্তু তার গুঁড়িটি সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। এছাড়া, গোটা বাড়িটিতেই ছড়িয়ে আছে কথাশিল্পীর ব্যবহৃত অসংখ্য দ্রব্য। রয়েছে দেওয়াল ঘড়ি, হুঁকো, বসার আরামকেদারা, তখনকার দিনে বিদ্যুতের অপ্রতুলতার কারণে ব্যবহার করা লণ্ঠন। দুলালবাবুর মুখ থেকে শোনা গেল, এই রকম লণ্ঠনের আলোতেই নাকি গভীর রাতে বিপ্লবীদের বৈঠক হত এই বাড়িতে। ব্রিটিশ পুলিশ একাধিকবার এই বাড়িতে হানা দিয়েছে সন্দেহের বশে কিন্তু, কোনওদিনই শরৎচন্দ্রকে গ্রেফতার করতে পারেনি, পারবে কী করে, গ্রামের স্থানীয় অধিবাসীরা যে ডাক্তারবাবু বলতে অজ্ঞান। অবাক হচ্ছেন? হওয়ারই কথা, আসলে তখনকার দিনে প্রত্যন্ত গ্রামে কথাসাহিত্যিক হিসেবে যত না পরিচিতি ছিল, তার চেয়ে সমাজবন্ধু হিসেবে শরৎচন্দ্রের পরিচিতি ছিল অনেক বেশি, গ্রামের প্রান্তিক মানুষ, জেলে, ধোপা ইত্যাদি জাতের মানুষের কাছে। শরৎচন্দ্র হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা জানতেন। এই বাড়িতে বসে বিনামূল্যে ওষুধ দিতেন এইসব মানুষকে। শোনা যায়, এর জন্য নাকি গ্রামের উচ্চ সম্প্রদায়ের মানুষেরা তাঁকে একঘরে করার চেষ্টা করেছিল। বাড়িটিতে রয়েছে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের দেওয়া রাধা-কৃষ্ণের মূর্তি, যা আজও বাড়ির ঠাকুরঘরে প্রতিষ্ঠিত, নিয়মিত পূজা হয়। রয়েছে একটি চরকা, কংগ্রেস সভাপতি থাকার সময় মহাত্মা গান্ধী দিয়েছিলেন শরৎচন্দ্রকে।

আরও পড়ুন : ওপেনাররা ফিরতেই চাপে নিউজিল্যান্ড, আম্পায়ারের সঙ্গে তর্ক অশ্বিনের

একটি ছোট ঘর, যাতে সযত্নে রক্ষিত আছে কথাসাহিত্যিকের লেখার টেবিল-চেয়ার। পাশেই জানলা দিয়ে দেখা যায় রূপনারায়ণ নদী। যা সেই সময় বাড়ির আরও কাছে ছিল, কালক্রমে বাড়ি থেকে খানিকটা দূরে সরে গেছে। এই জানলা দিয়ে রূপনারায়ণের জলে ঢেউ ও নৌকা দেখতে দেখতে তিনি সৃষ্টি করতেন অবিস্মরণীয় সব সাহিত্য। এই নদীতেই নৌকা করে তাঁর বাড়িতে আসতেন সেই সময়কার স্বাধীনতা সংগ্রামী ও বিশিষ্ট মানুষজনরা। এখনও রূপনারায়ণে নৌকাবিহারের ব্যবস্থা আছে। পর্যটকরা ইচ্ছে হলেই নৌকাবিহার করতে পারেন, ভাবতে পারেন অতীতের সেই মানুষজনের কথা। বাড়িটিতে রয়েছে একটি ধানের গোলা। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, ১৯৭৮-এর বন্যায় রূপনারায়ণের জলে বাড়িটির দোতলায় একটি রান্নাঘর সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়, যা আর উদ্ধার করা যায়নি। তবে, ২০০১ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার বাড়িটিকে হেরিটেজ হাউস ঘোষণা করে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছে। শরৎচন্দ্র ছাড়াও এই বাড়িটিতে থাকতেন তাঁর দ্বিতীয় পত্নী হিরন্ময়ী দেবী, ভাই বেদানন্দ( বেলুড় মঠে সন্ন্যাস নিয়েছিলেন)। এঁদের সবারই সমাধি বাড়িটিতে রয়েছে।

পর্যটকদের যাওয়ার সবচেয়ে ভাল সময় শীতকাল। দূষণ ও কোলাহলহীন পথে যেতে যেতে চোখে পড়বে, বিস্তীর্ণ সরষেখেত, ধানজমি, নাম না-জানা অসংখ্য পাখি, রূপনারায়ণের পাড় ধরে হেঁটে যেতে পারেন মনটা শান্ত করতে, প্রশাসন পিকনিক স্পট নির্মাণ করে দিয়েছে পর্যটকদের জন্য। শরৎচন্দ্রের বাড়ি ছাড়াও এখানে রয়েছে শ্রীরাধা ও মদনগোপালের একটি আটচালার মন্দির। মন্দির গাত্রে টেরাকোটার কাজ। ১৬৫১ সালে এই মন্দির নির্মাণ করেছিলেন মঙ্গলাহাটের জমিদার মুকুন্দপ্রসাদ রায়চৌধুরী। এছাড়া, প্রতি বছর জানুয়ারির ২১ তারিখে এখানে শুরু হয় শরৎমেলা। কুটিরশিল্পের কাজ এখান থেকে সংগ্রহ করতে পারেন, রয়েছে শরৎ স্মৃতি গ্রন্থাগার।

 

কীভাবে যাবেন : কলকাতা থেকে দূরত্ব মোটামুটি ৬০ কিলোমিটার। গাড়িতে আসতে চাইলে কোনা এক্সপ্রেসওয়ে ধরে সাঁতরাগাছি, ধুলাগড়, বাগনান দিয়ে। ট্রেনে আসতে চাইলে, দেউলটি স্টেশনে নেমে টোটোতে মিনিট ১৫। ভাড়া ২০ টাকা।
দেউলটিতে কয়েকটি রিসর্ট রয়েছে। সেখানে থাকতে পারেন।

Latest article