করোনাকালের কর্তব্য

রাজ্য সরকারের ওপর দায় চাপিয়ে কুৎসা কি ঠিক?

Must read

কুণাল ঘোষ : লকডাউন আর বিধিনিষেধ থাকছে কেন? রাজ্য সরকারের দোষ!
করোনা বাড়ছে, লকডাউন কড়াভাবে হচ্ছে না কেন? রাজ্য সরকারের দোষ!
করোনা তো কী! পুজোয় কেন বিধিনিষেধ থাকবে? রাজ্য সরকারের দোষ!
পুজোয় কেন এত লোক বেরোল? রাজ্য সরকারের দোষ!
অদ্ভুত এরকম বিপরীতধর্মী অভিযোগগুলির লক্ষ্যবিন্দু বাংলার সরকার।
অভিযোগ তুলছেন কারা? একটি অংশের মানুষ, মূলত অন্য রাজনৈতিক দলের সমর্থক।
অভিযোগ ছড়াচ্ছে কীভাবে? সাধারণভাবে সোশ্যাল মিডিয়া দিয়ে। কিছু একটা লিখে দিলেই হল। কিছু একটা বলে দিলেই হল। আধুনিক প্রযুক্তি, হাতে ফোন, বাংলায় গণতন্ত্র— এ সুযোগ ছাড়া যায়!

আরও পড়ুন-রাজ্যের অর্থনীতিতে দুর্গাপুজোর প্রভাব, ব্রিটিশ কাউন্সিলের রিপোর্ট

একটু ভেবে দেখবেন সরকারের দায়িত্বটা।
করোনা বাড়লে লকডাউন দরকার। কঠোর লকডাউন দরকার। একসময়ে হয়েওছে। স্বাস্থ্যের দিক থেকে দেখলে এটা জরুরি।
কিন্তু রাজ্য সরকারকে শুধু এটা দেখলে চলবে?
যতদিন সম্ভব তাঁরা লকডাউন রেখেছেন।
কিন্তু তারপর?

যাঁরা একটু সচ্ছল, যাঁদের সঞ্চয় আছে, যাঁরা পাকা চাকরি করেন, যাঁরা ছ’মাস ঘরবন্দি থাকলেও কোনও ক্ষতি নেই, তাঁদের জন্য লকডাউন ঠিক আছে। তাঁদের কাছে পেটের সমস্যা গৌণ, সুস্থ থাকা অগ্রাধিকার।
কিন্তু যাঁদের সঞ্চয় নেই, যাঁরা দৈনিক আয়ে নির্ভরশীল, যাঁদের পাকা চাকরি নেই, যাঁদের বেতন কমে যাচ্ছে, যাঁদের চাকরি চলে যাচ্ছে, যাঁরা কর্মসূত্রে আটকে পড়েছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে? যাঁদের টালির ছাদের একটা ঘরে ছ’সাতজনকে গাদাগাদি করে থাকতে হয় তাঁদের? যাঁরা অসংগঠিত শ্রমজীবী, কাজ নেই আয় নেই, তাঁরা? এই সরকার এঁদের নয়? বিনামূল্যে খাদ্য ইত্যাদি সব পরিষেবা দেওয়ার পরেও এঁদের জীবনযুদ্ধে সরকার কতদিন চোখ বুজে থাকবে? কেন থাকবে?
করোনা রুখতে অপ্রিয় কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। সরকার নিয়েছেন। কিন্তু আমাদের সমাজের আর্থিক কাঠামোয় একাংশের মানুষের ওপর চাপ বাড়লে সরকার বিধি শিথিল করবে না? যাঁদের কর্মসংস্থান আর অন্নসংস্থান দৈনিক চক্রাবর্তে জড়িত, সরকার যতই সাহায্য করুন, তিনি কাজে ফিরতে চাইবেন।
সরকারকে সব দিক দেখেই অবস্থান নিতে হয়।

ধরা যাক পুজো আর পুজোর ভিড়।
কী করত সরকার? পুজো বন্ধ?
সরকার, প্রশাসন কিছু গাইডলাইন দিয়েছে। পুজো হোক।
কারণ, পুজো একটা অর্থনীতিও বটে। এই করোনাকালে লক্ষ লক্ষ পরিবারে পৌঁছে যাবে টাকা। কুমোরটুলির মৃৎশিল্পী থেকে ফুলচাষি পর্যন্ত। সরকার এই টাকার জোগানের জন্য পুজোকমিটিগুলিকে অনুদানও দিচ্ছেন, করোনাকালে বাড়িয়েছেন।
এখন, যদি কোথাও ভিড় হয়, সরকারের দোষ?
আমরা সবাই সচেতন নই? আমরা জানি না যে করোনার বিপদ এখনও আছে? আমরা জানি না যে ভিড়ে যাওয়া অনুচিত? আমরা জানি না যে মাস্ক পরা দরকার?
সবটা সরকারের দায়?
একদিকে কেন্দ্রের গাইডলাইন, অন্যদিকে আদালতের নির্দেশ।
তার মধ্যে দাঁড়িয়ে এই কঠিন সময়ে পরিবেশ সুস্থ রাখতে, অর্থনীতিতে যথাসম্ভব অক্সিজেন দিতে রাজ্য সরকার বাস্তবধর্মী পথ নিয়েছেন। কিন্তু আমরাই যদি তার অপব্যবহার করি, তার দায় সরকারের?
সরকার চান অসংখ্য ব্যবসায়ী এবং তাঁদের কর্মচারীদের কথা মাথায় রেখে দোকান খোলা থাকুক।
তারপর সেখানে আমরাই যদি একসঙ্গে ভিড় করে মাস্কছাড়া ঝাঁপিয়ে পড়ি, তখন সেই ছবি পোস্ট করে যিনি সরকারকে কটাক্ষ করছেন, এটা কি সরকারের প্রাপ্য?
দোকানপিছু, ক্রেতাপিছু একজন করে পুলিশ দিতে হবে? সম্ভব?
যদি করোনা-আক্রান্ত বাড়ে, দায়ী প্রশাসন? আমরা, এই সমাজের বাসিন্দারা নই?
আমাদের নিজেদের কাণ্ডজ্ঞান এবং দায়িত্বশীলতার পরিচয় আমরা দেব না?
পুজো হলে সব ক্লাব, সব মণ্ডপ সেজে উঠবে। তাকে ঘিরে দোকান, স্টল, ঘুগনি, বেলুন, ফুচকা। ছোট ছোট বিক্রেতা। আমরা কি এই করোনাকালে এবার চারপাশের এলাকার পুজোয় ঘুরতে পারতাম না? কেন ঘুরে ঘুরে ঠাকুর দেখতে হবে, দশটা বড় পুজোয় না গেলে কি জীবনবৃথা? আমরা ঘুরে মরব আর ফেসবুকে গাল খাবে সরকার!! আমাদের আত্মসংযম নেই, তার দায় অর্থনীতি চালু রাখতে মরিয়া সরকারের?
সরকার সমাজের সব অংশের ভাল করার চেষ্টায় পুজো করতে দিচ্ছে।
আর আমরা নিজেদের ভাল নিজেরা বুঝব না?
সরকার একবারও বলেছে যে যান, গাদাগাদি ভিড়ে লাইন দিন?
আমরা দেব। করোনা বাড়বে। তখন আমাদের হাসপাতালে বেড চাই। ভেনটিলেটর চাই। তখন আমরা ছুটব। তখন পছন্দমতো হাসপাতালে বেড না পেলে বা বেড ফাঁকা না থাকলে আবার সরকারকে কটাক্ষ।
অধিকাংশ নাগরিক সমস্যাটা বোঝেন। তাই সতর্ক। কিন্তু একাংশ অনুভব করেন না।
আর একটি শকুন-প্রজাতির অংশ, বিরুদ্ধ রাজনৈতিক দলের সমর্থক, বসে আছেন কটূক্তি পোস্ট করার জন্য।
এমনকী, যে চ্যানেলটি বা কোনও মিডিয়া করোনা নিয়ে সরকারকে খোঁচা দিতে ব্যস্ত, তারাও দেখি এ-পুজো ও-পুজোকে প্রাইজ দিয়ে, কভারেজ দিয়ে, পুজোর হাইপ তুলে যাচ্ছে।

দীর্ঘকালের সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, ঠিক এই পরিস্থিতিতে যা করা উচিত, রাজ্য সরকার সেটাই করেছেন। কিন্তু আমাদের সকলের, যাঁরা সমাজে আছি, আরও একটু নিজেদের প্রতি দায়িত্বশীল সাবধানতা দেখানো উচিত ছিল।
দেখুন, করোনা মোকাবিলা প্রাথমিকভাবে ছিল কেন্দ্রের দায়িত্ব। তাঁরা মার্কিন রাষ্ট্রপতির সফর নিয়ে মেতে থাকতে গিয়ে প্রথমে জরুরি পরিস্থিতিতে সাড়া দিতেই দেরি করলেন। তারপর খেয়ালখুশিমতো নীতি চলল কিছুদিন। আচমকা লকডাউন ঘোষণা করে বিপদে ফেলেন তাঁরা লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিককে। কত প্রাণ গেল। পরে দেখা গেল টিকা নেই। টিকার সরবরাহ নেই। দেশবাসীকে টিকা দিতে দেরি, এখনও। নামে বিনামূল্যে, খরচ তুলছে জ্বালানি তেল, রান্নার গ্যাসের দাম বাড়িয়ে। রাজ্য সরকার নিজের উদ্যোগে যতটা সম্ভব গতি বাড়িয়ে টিকাকরণ করছে।
একটা কথা মনে রাখতেই হবে, সরকারটা সকলের। যিনি করোনা থেকে বাঁচতে দিনের পর দিন ঘরবন্ধ করে টিভি দেখে বাঁচতে পারেন, সরকার তাঁরও।
আর যে ব্যক্তি দিনের হাড়ভাঙা পরিশ্রমে যে আয় আনবে, সেই দিকে তাকিয়ে বসে তাঁর পরিবার, সরকার তাঁরও।

আর শুধু ঘরে বসে থাকলেই যদি বাঁচা যেত, তা হলে একাধিক ভিআইপি, নামকরা বিশিষ্ট মানুষ, ধনী মানুষ করোনায় মারা যেতেন না।
করোনা আছে, থাকছে।
এখনও স্কুল-কলেজ, লোকাল ট্রেন বন্ধ।
এখনও বিধিনিষেধ আছে।
অথচ সমাজ চালু রাখতে হবে।
অর্থনীতি চালু রাখতেই হবে।

আরও পড়ুন-উত্তরপ্রদেশের বিশ্রাখে প্রদীপহীন অরন্ধন, রামই চক্ষুশূল

এই অবস্থায় রাজ্য সরকার যা যা করার দরকার করেছেন, করছেন, করবেন।
কিন্তু সেই সঙ্গে দরকার আমাদের নিজেদের প্রতি নিজেদের একটু বাড়তি কাণ্ডজ্ঞান আর সতর্কতা। সরকারের কোনও কাজে ভুল থাকলে অবশ্যই বলুন। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে সব দায় সরকারের, আমাদের কাজ শুধু ভিড় করে শপিং আর লাইন দিয়ে দলে দলে ঠাকুর দেখা, এটা কি সমর্থনযোগ্য?
আমরা যদি একটু আত্মসংযম দেখাই তা হলে আস্তে আস্তে সব বিধিনিষেধ শিথিল হয়ে জীবনের সব শাখাগুলি চালু করা সম্ভব হবে।

Latest article