প্রবাদে বলে— ‘লক্ষ্মীছাড়া’। এ-পোড়া দেশে ‘লক্ষ্মীছাড়া’ অবস্থা! দেশের বেশির ভাগ অঞ্চলে খাদ্যশস্যের আকাল। চারদিকে অলক্ষ্মীর প্রকোপ। ‘বারো মাসে তেরো পার্বণ’ করেও সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা ঘুচছে না। না হলে এখনও একমুঠো অন্নের জন্য মানুষের মধ্যে হাহাকার হয়! প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ‘অচ্ছে দিনের’ মহাসময়েও হতদ্ররিদ্র মানুষের অনাহারে মৃত্যু হয়। এ-চিত্র প্রায় সারা দেশের। আমাদের রাজ্যে দু’টাকা কেজি দরের চালের বণ্টনের ফলে অনেক মানুষই আজ অনাহারের হাত থেকে বেঁচেছে। রাজ্য সরকারের ‘খাদ্যসাথী’ প্রকল্প হতদরিদ্র নাগরিকদের বাঁচার অবলম্বন হয়েছে। ‘কেন্দ্র’ ও ‘প্রান্তে’র সামঞ্জস্যহীন বণ্টন, অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, কাজের সুযোগের অভাব, সরকারি সুযোগ-সুবিধার ভারসাম্যহীনতা— ইত্যাদি নানা কারণে সাধারণ মানুষ নাজেহাল। দলিত, আদিবাসী ও অনেক সংখ্যালঘু মানুষও সাধারণভাবে খেয়ে-পরে বাঁচার ক্ষেত্রেও সংকটে পড়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের বিস্তর বঞ্চনার মাঝে আবারও সব বাধা কাটিয়ে বঙ্গরমণীদের জন্য পূর্ব প্রতিশ্রুতিমতো পশ্চিমবঙ্গ লক্ষ্মীর ভাণ্ডার যোজনা চালু করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মা-মাটি-মানুষের সরকার। লক্ষ্মীর ভাণ্ডার যোজনার মাধ্যমে লক্ষ্মীলাভ হল দেড় কোটিরও বেশি বঙ্গরমণীর। গতবছর লক্ষ্মীপুজো শেষ হতেই লক্ষ্মীবারে বঙ্গগৃহলক্ষ্মীদের মুখে হাসি ফুটিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গৃহলক্ষ্মীর কল্যাণে পরিবারেরও কল্যাণ হবে। এই সহজ তত্ত্বটি মুখ্যমন্ত্রী অনুধাবন করেছেন এবং যযার্থভাবেই তার প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। তিনি চিরায়ত পৌরাণিক ও লৌকিক ঐতিহ্যের ধারণার সঙ্গে মিশেল ঘটালেন অর্থনীতির ভাবনার। বিষয়টিকে একটু বিশদে বলার চেষ্টা করি।
আরও পড়ুন-রাজ্যসভায় আবার একশোর নিচে বিজেপি
হতদরিদ্র জনমজুর-খাটা মানুষও সারা বছরের অন্নের কামনায় দুটো পয়সা খরচ করে মা লক্ষ্মীর পুজো করে। তাতেও যে ‘বঙ্গলক্ষ্মী’ সব সময় সন্তুষ্ট হন তা নয়। প্রতিবারই ‘ধানে ধানে দেশ পূর্ণ’ হয় না। কোনও বছর ভাল, আবার কোনও বছরে মন্দা দেখা দেয়। আশায় বাঁচে চাষা। সকলেই চান তাঁর গৃহ খাদ্যশস্যে পরিপূর্ণ হোক। পরিবারে সুখ-সমৃদ্ধি বাড়ুক। হতদরিদ্র নিম্নবিত্ত নাগরিকের দৈবভরসা করে বেঁচে থাকার জন্য মা লক্ষ্মীর কাছে রসদ কামনা করা ছাড়া আর উপায় কী আছে? রমণীরা লক্ষ্মীব্রত পালন করেন। শস্যোৎসবের অনুষঙ্গে এই ব্রত পালিত হয়। লক্ষ্মী সমৃদ্ধি ও সৌভাগ্যের দেবীরূপে পূজিতা। সঙ্গে থাকে লক্ষ্মীর ঝাঁপি ও লক্ষ্মীর ভাণ্ডার। দেবী তুষ্ট হলে ভক্তদের ঘরে পর্যাপ্ত পরিমাণে ফসল ফলবে, আর ঘর ধনসম্পদে ভরে উঠবে। এ-কামনা শাশ্বত ও চিরকালীন। লক্ষ্মীর ঝাঁপি ও লক্ষ্মীর ভাণ্ডার পূর্ণ হলে ঘরে ঘরে দুশ্চিন্তাও কমবে। দিনে দিনে পরিবারে সুখ-সমৃদ্ধি বাড়বে। দীর্ঘমেয়াদে সুফল মিলবে।
আরও পড়ুন-ডেঙ্গু-আক্রান্ত এলাকায় তৃণমূল জেলা সভানেত্রী
পৌরাণিক ও লৌকিক অনুষঙ্গে লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের ধারণা, আর সমাজতাত্ত্বিক প্রেক্ষিতে তার বাস্তবায়ন। অর্থনীতির বিচারে মহিলাদের ক্ষমতায়নের আধারে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠা। মহিলারা গৃহকর্ত্রী হিসাবে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ঘর চালায়। মা, ঠাকুমা, দিদিমাদের দেখেছি নানান অসুবিধার মধ্যেও কিছু টাকা-পয়সা পরিবারের জন্য বাঁচিয়ে রাখেন। অসময়ে সংকটে কাজে লাগায়। এ এক ধরনের সঞ্চয়ের প্রক্রিয়া। স্বল্প সঞ্চয় হয় লক্ষ্মীর ঝাঁপি ও লক্ষ্মীর ভাঁড় বা ভাণ্ডতে। শৈশবে লক্ষ্মীর ভাঁড়ে খুচরো টাকা ও পয়সা জমা রাখতাম। সেইজন্য এই ভাঁড়গুলোকে ব্যাঙ্কও বলতাম। শুধু ছোটরা কেন, বড়রাও লক্ষ্মীর ভাঁড় ব্যবহার করে। মহিলারা লক্ষ্মীর ভাঁড় ছাড়া কুলুঙ্গি-সহ নানাভাবে স্বল্প সঞ্চয় করে। প্রয়োজনে এখানের সঞ্চয় দিয়ে মহিলারা সংসার পরিচালনায় সহায়তা করেন। ফলে উপার্জনহীন বঙ্গগৃহলক্ষ্মীদেরও পশ্চিমবঙ্গ লক্ষ্মীর ভাণ্ডার যোজনা থেকে প্রাপ্ত টাকা বেহিসেবি খরচ না করে স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্পের মতো মূলধন বাড়িয়ে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার সুযোগ থাকবে। ঘরে বসে ছোটখাটো ব্যবসাও করতে পারবে। মহিলারা লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের টাকা পেলেও এর সুবিধা পাবেন পরিবারের সব সদস্যই। কাজেই এই অর্থ-বণ্টনের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে নিঃসন্দেহে। সেই জন্যই এই প্রকল্প জনসমাজে বিশেষ সাড়া ফেলেছে। দুয়ারে সরকারের ক্যাম্পে ক্যাম্পে এই প্রকল্পে আবেদনের জন্য মহিলাদের উন্মাদনা খুব বেশিভাবে দেখা গিয়েছে।
আরও পড়ুন-বিভেদের রাজনীতি নয়, উন্নয়নের রাজনীতি করুন
২০২১ সালের রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্প চালু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সরকার গঠন করে সেই প্রতিশ্রুতি পালন করেছেন। এখানেই মূল তফাত নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। একজন প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন, আর একজন প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নারী ও শিশু এবং সমাজকল্যাণ দফতর লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্পে আবেদন করা আরও সরলীকরণ করছে। এখন থেকে স্বাস্থ্যসাথী কার্ড, আধার কার্ড, তফসিলি ও উপজাতির শংসাপত্র ছাড়াও এই প্রকল্পের সুবিধা মিলবে। রাজ্য সরকার প্রথম পর্যায়ে ২ কোটি ৪৮ লক্ষ টাকা এই খাতে বরাদ্দ করেছিল। ইতিমধ্যেই লক্ষ্মীর ভাণ্ডার খাতে ৩ হাজার ৪৫৬ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। এই প্রকল্প চালু করার উদ্দেশ্য অত্যন্ত বাস্তবসম্মত। পশ্চিমবঙ্গে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার যোজনার সুবাদে বঙ্গলক্ষ্মীদের বারোমাসে লক্ষ্মীলাভ হচ্ছে— এ কি কম কথা! সকলের সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে। এ-আর্তি শুধু আমার নয়— সকলের। এমনকী মুখ্যমন্ত্রীরও।