মিনাখাঁ ব্লকের রিয়া খাতুন(নাম পরিবর্তিত) দরিদ্র কাঠের মিস্ত্রির মেয়ে বাড়ির সামনে দোকানে বেরিয়ে নিখোঁজ হয়ে যান। পরে তাঁকে হাওড়ার একটি নিষিদ্ধ পল্লি থেকে উদ্ধার করে রাজ্য পুলিশের স্পেশাল টাস্ক ফোর্স।
আরও পড়ুন-‘ডাকলে সবাইকে পাব তো’ দুর্গাপুজোর অনুদান বাড়িয়ে ৭০ হাজার করলেন মুখ্যমন্ত্রী
সন্দেশখালি ব্লকের নবম শ্রেণির পড়ুয়া বছর ১৩-র সান্ত্বনা হালদারের (নাম পরিবর্তিত) ঘটনাও একইরকম। বিকেলে পাড়ায় বেরিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায় সান্ত্বনা। কয়েকমাস বাদে বিহারের একটি নাচের দল থেকে তাকে উদ্ধার করে রাজ্য পুলিশ। কোভিড কালে অর্থাৎ ২০২০-এর এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে এরাজ্যের প্রায় ১,১২৭ জন নাবালিকা মেয়েকে উদ্ধার করে রাজ্য পুলিশ, যাদের পাচার করা হয়েছিল ভিন রাজ্যে৷ গ্রেফতার হয় ৮৬ জন পাচারকারী। নিশ্চিতভাবে, কোভিড পরবর্তী গত তিন বছরে এই উদ্ধারের গতি বেড়েছে। গ্রেফতারও হয়েছে প্রচুর পাচারকারী। হঠাৎ করে এই ঘটনাগুলো মনে পড়ে গেল, কারণ সম্প্রতি রাজ চক্রবর্তী পরিচালিত ‘আবার প্রলয়’ ওয়েব সিরিজটি এই নির্মম বাস্তব সত্যিটাকেই তুলে ধরেছে। কীভাবে দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে জল-জঙ্গলে ঘেরা সুন্দরবনের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে নাবালিকা মেয়েদের প্রেম বা বিবাহের প্রস্তাব দিয়ে ভিন রাজ্যে পাচার করছে পাচারকারীরা, তার বাস্তব দলিল তুলে ধরেছেন পরিচালক। আর এই পাচারকারীদের কারনামা বন্ধ করার লক্ষ্য নিয়ে জঙ্গলের গরিব নাচার মানুষগুলোর ‘মসীহা’ হয়ে আসছেন স্পেশাল টাস্ক ফোর্সের অফিসার অনিমেষ দত্ত।
বাণিজ্যিক সিরিজের শর্ত মেনে, শেষ অবধি অনিমেষ দত্ত সেই ‘মিশনে’ সফল হবেন কি না সেটা না হয় সিরিজেই দেখবেন। বা হয়তো ইতিমধ্যে দেখেও নিয়েছেন। আসলে বিশ্বের বৃহত্তম ব-দ্বীপ অঞ্চলে, যেখানে জলে কুমির-ডাঙায় বাঘ আর প্রকৃতির খামখেয়ালিপনায় ফি বছরের ঘূর্ণিঝড় বা ভরা কোটালের আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটানো পরিবারগুলোর কাছে আরও এক বিভীষিকা নারী পাচার। যা এই সিরিজে আমাদের দেখালেন রাজ চক্রবর্তী। বাণিজ্যিক সিরিজে যেমন গরম গরম সংলাপ থাকে, অনিমেষের মুখে তেমন সংলাপ রয়েছে, কিন্তু আরেকটা বিষয় যা গুরুত্বপূর্ণ তা হল, এই অনিমেষ যেমন একদিকে ‘দাবাং’ অফিসার, আর একদিকে তিনি একজন আবেগী রক্ত মাংসের মানুষ। যিনি পাচারকারীদের বিরুদ্ধে এই লড়াইটাকে স্রেফ তাঁর পুলিশি চাকরির একটা ‘দায়’ মনে করে দায় সারেন না। বরং চোখের সামনে একের পর এক নাবালিকা কন্যার পাচার বন্ধ করাটাকে তাঁর ব্যক্তিগত পর্যায়ের লড়াইয়ে নিয়ে যান। এবং শুরু করেন জীবনপণ লড়াই।
আরও পড়ুন-ফের অতিভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস হিমাচল-উত্তরাখণ্ডে, জারি কমলা সতর্কতা
প্রসঙ্গত বলা দরকার, পুলিশ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি ‘বন্ধু’। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হওয়া ইস্তক নির্দেশ দিয়েছিলেন, পুলিশকে দেখে যেন মানুষ ভয় না পায়, বরং পুলিশ যেন হয়ে ওঠে সাধারণ মানুষের আশ্রয়স্থল। তাই বোধহয়, একটা সময় যে সুন্দরবনে একের পর এক নারী পাচারের ঘটনা ঘটলেও, সেই অভিযোগ স্থানীয় থানায় জমাই পড়ত না, সেখানে আজ এহেন কোনও ঘটনা ঘটলেই পুলিশ শুধু অভিযোগই গ্রহণ করছে তা নয়, বরং সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থাও গ্রহণ করছে। গতবছরই দক্ষিণ ২৪ পরগনার জীবনতলা থানা ২০১২ সালের একটি নাবালিকা মেয়ের পাচারের অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্তে নেমে দিল্লি থেকে গ্রেফতার করে সুন্দরবন এলাকায় পাচারের অন্যতম কিংপিন শেখ হাসান আলি-সহ তিনজনকে। তদন্তকারী অফিসার নিজে দিল্লি গিয়ে গ্রেফতার করেন এই গ্যাং’কে।
আরও পড়ুন-কংগ্রেস-সিপিএম যেখানে বিজেপির সঙ্গে হাত মেলাবে, সেখানে তাদের একটা ভোটও নয়
গত এক দশক ধরে প্রায় ২০০০ এর ওপর নারী ও নাবালিকা পাচারের সঙ্গে যুক্ত ছিল এই গ্যাং। পর্দার অনিমেষরা এভাবেই বাস্তবেও আমাদের চারপাশে রয়েছেন। দক্ষিণ ২৪ পরগনারই একটি থানার আইসি খবর পান বাংলা থেকে পাচার হয়ে যাওয়া দুটি মেয়ে রাজস্থানে একটি জায়গায় রয়েছে৷ সেই অফিসার নিজে যান তাদের উদ্ধার করতে। কিন্তু সরকারি পরিচয় পেয়েও তাদের ছাড়তে নারাজ থাকে সেখানকার কর্তৃপক্ষ। অবশেষে নিজের উদ্যোগে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে তাদের ফিরিয়ে আনেন সেই অফিসার। ‘আবার প্রলয়’ সিরিজে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিকে আলোকপাত করেছেন নির্দেশক। বহুক্ষেত্রেই পাচার থেকে উদ্ধার হওয়া মেয়েরা আর সমাজের মূল স্রোতে ফিরতে পারে না। বিভিন্ন কারণে, তাদের পরিবারও তাদের আর ফিরিয়ে নেয় না। এটা এক ভয়ানক সামাজিক ব্যাধি। বাধ্য হয়েই এই মেয়েদের আশ্রয় নিতে হয় বিভিন্ন হোমে। ঠিক এরকমই একটি আবাসিকস্থল বানিয়েছিলেন এই সিরিজের ‘মিস্টার বচ্চন’ ওরফে পরান বন্দ্যোপাধ্যায়।
আরও পড়ুন-ওদের হাতে জাতীয় পতাকা মানায় না
বাস্তবেও কিন্তু এমন বহু মানুষ রয়েছেন। যেমন নামখানা থানার এক পদস্থ পুলিশকর্তা পাচারকারীদের থেকে উদ্ধার হওয়া দুটি মেয়ে, যাদের পরিবার তাদের আর ফিরিয়ে নেয়নি, তাদের সম্পূর্ণ ভরণপোষণ-সহ লেখাপড়া, হাতের কাজ ইত্যাদি শেখানোর দায়িত্ব নিয়েছেন। এছাড়াও রাজ্য সরকারের উদ্যোগেও পাচারকারীদের থেকে উদ্ধার হওয়া মেয়েদের জন্য নানা সামাজিক প্রকল্পের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এই মেয়েগুলিকে সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনতে বদ্ধপরিকর রাজ্য সরকার। সেখানে নিয়মিত হাতের কাজ, ভোকেশনাল ট্রেনিং, নার্সিং শেখানো হচ্ছে। বসিরহাটের মেয়ে বছর ১৬’র অঞ্জলি বেরাকে পাচারকারীদের থেকে উদ্ধার করে রাজ্য পুলিশ। তাকে যারা পাচার করছিল, তাদেরও গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গত বছর অঞ্জলিকে ‘বীরাঙ্গনা’ সম্মানে সম্মানিত করেছে পশ্চিমবঙ্গ শিশু সুরক্ষা কমিশন৷ এরকম অসংখ্য অঞ্জলিদের আজ অন্ধকার থেকে আলোর দিশা দেখাচ্ছেন বাস্তবের অনিমেষরা।
আরও পড়ুন-মণিপুর নিয়ে মিত্তাল কমিটির সুপারিশ কোর্টে
সার্বিকভাবে অশিক্ষা এবং দারিদ্র একটা মূল সমস্যা। আর ঠিক এইখানেই প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দূরদর্শিতাকে আবারও কুর্নিশ জানাতে হয়৷ এই সমস্যাগুলি তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন বলেই, নারীশিক্ষার অগ্রগতিতে তাঁর একের পর এক প্রকল্প আজ অনেকাংশে এই জটিল সামাজিক সমস্যার একটা মুক্তির দিশা হয়ে দেখা দিচ্ছে। কন্যাশ্রীর স্কলারশিপ, সংখ্যালঘু পড়ুয়াদের জন্য ঐক্যশ্রী স্কলারশিপ রাজ্যের প্রান্তিক এলাকাতেও পড়ুয়াদের মধ্যে স্কুলছুটের সংখ্যা ব্যাপক হারে কমিয়েছে। শেষ কয়েকবছরে মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিকে পরীক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্রীদের সংখ্যা দেখলেই চিত্রটা পরিষ্কার হয়।
আরও পড়ুন-বিধানসভায় হঠাৎই অসুস্থ মলয় ঘটক, কী হয়েছে তাঁর?
পাশাপাশি, সুন্দরবনকে কেন্দ্র করে পর্যটন শিল্পে বাড়তি নজর দেওয়া হচ্ছে। বিশ্বের বৃহত্তম ‘ম্যানগ্রোভ’ অরণ্যকে পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গড়ে তুলছে রাজ্য পর্যটন দফতর। পর্যটকদের যাতায়াতের সুবিধার জন্য অত্যাধুনিক ভেসেল বা লঞ্চের ব্যবস্থা করছে রাজ্য পরিবহণ দফতর। উদ্দেশ্য স্পষ্ট, পর্যটন শিল্প যত বিকশিত হবে, তত চাঙ্গা হবে সুন্দরবনের স্থানীয় অর্থনীতি। দূর হবে দারিদ্র। একটা পর্যটন কেন্দ্রকে ঘিরে গড়ে উঠবে বহু ছোট ছোট দোকানপাট। কর্মসংস্থান হবে স্থানীয় মানুষদের।
আরও পড়ুন-‘আমাদের বাড়িতে রোজই অত্যাচার করছে’ কেন্দ্রীয় এজেন্সিকে নিশানা মুখ্যমন্ত্রীর
আসলে ‘রিল’ আর ‘রিয়াল’ কখনও কখনও মিলে যায়। ‘রিল’ যা রূপক অর্থে দেখায়, ‘রিয়াল’ অর্থাৎ বাস্তব তারচেয়েও অনেক বেশি নির্মম। কঠিন। অনেক রুক্ষ। তাই, পর্দার অনিমেষের লড়াই দেখে আমরা বাহবা দিই। তাঁর মুখের সংলাপ আমাদের মুখে মুখে ঘোরে। ভাইরাল হয় ফেসবুক ইনস্টাগ্রামে। কিন্তু পর্দার নেপথ্যে আমাদের চারপাশে যে অনিমেষরা লড়ে চলে চলেছেন অনবরত, তাঁদের লড়াইটা আমাদের অগোচরেই থেকে যায়।