ভাঙড়, ক্যানিং, ডোমকল, চোপড়া, আমোদপুর, ইন্দাস। সুবিশাল পশ্চিমবঙ্গে বিচ্ছিন্ন কয়েকটা দ্বীপ। সাগরের বুকে ছ’টি বুদবুদ। তাই নিয়ে কত কথা। কী হইচই। কতই না গেল গেল রব। এবারের পঞ্চায়েত ভোটের (Panchayat Election 2023) মনোনয়ন ঘিরে যে হাঙ্গামার ছবি আমরা দেখছি তা রাজ্যের ৩৪২টি ব্লকের সর্বত্র নয়। সব জেলা অশান্ত হয়নি। সব মিলিয়ে পাঁচ-সাতটা জায়গায় হিংসার দাপাদাপি।
মনে পড়ে কমরেড, সিপিএম যখন ক্ষমতায় ছিল তখনও এই ডোমকল, ভাঙড়, ক্যানিং, কুলতলিতে কীরকম শান্তিতে ভোট হত? মনে পড়ে বুকনিসর্বস্ব মার্কসবাদী বন্ধুরা, প্রতিবার ভোটের বিকেলে আমহার্স্ট স্ট্রিট, বরানগর, কাশীপুর, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিস্তীর্ণ অংশ কীরকম বিরামহীন সন্ত্রাস ও বোমাবাজির সাক্ষী থাকত? মনে পড়ে জ্ঞানপাপীর দল, অনেক জায়গায় শরিক আরএসপি ও ফরওয়ার্ড ব্লকের সঙ্গেও রক্ত ঝরাতে কেমন ব্যস্ত হত ‘বড়দা’ সিপিএম?
সুদূর হিঙ্গলগঞ্জ। বাঘ-কুমিরের সঙ্গে মানুষের লড়াই। বাম আমলে কোনও উন্নয়ন পৌঁছত না। কিন্তু ভোট পড়ত প্রায় একশো শতাংশ। কোন ম্যাজিকে?
সত্তরের দশকে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের বিরুদ্ধে পুলিসি সন্ত্রাস ও ভোট লুটের অভিযোগ তুলেই বঙ্গ-রাজনীতিতে নিজেদের প্রাসঙ্গিক করে তুলেছিল বামেরা। তারপর প্রফুল্ল সেনদের ঘাড়ে চেপে এসে সাড়ে তিনদশক একটানা এই বাংলায় ভোট লুটকে শিল্পের স্তরে নিয়ে গিয়েছিল সিপিএম। তখন এত চ্যানেল এত ক্যামেরা ছিল না। তাই জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কালবৈশাখীর দমকা ঝড় হয়ে বাংলার রাজনীতিতে না এলে এতদিনে দশম বামফ্রন্ট সরকার একচ্ছত্র ক্ষমতা ভোগ করার খোয়াব দেখত আলিমুদ্দিন।
আজ থেকে দু’দশক আগে ২০০৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন শুরু থেকেই ছিল রক্তাক্ত। বহু জায়গায় বিরোধীদের মনোনয়ন পেশ করতে দেওয়া হয়নি। ভোটের দিন রক্তাক্ত হতে হয়েছে বিরোধী নেতা-কর্মীদের। সেই পঞ্চায়েত নির্বাচনে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছিলেন মোট ৭০ জন। শুধু মুর্শিদাবাদেই ৪৫ জন। আর ভোটের দিন প্রাণ হারান ২০ জন। মনে পড়ে সেসব কথা?
আরও পড়ুন- পরিবেশ রক্ষা করে মেট্রো চলবে সৌরবিদ্যুতে
পশ্চিমবঙ্গে কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে পঞ্চায়েত ভোটও কিন্তু চমকে দেওয়ার মতো কোনও ঘটনা নয়। বাম আমলে না-হলেও, মা মাটি মানুষের শাসনকালে ২০১৩-র পঞ্চায়েত ভোট রাজ্য নির্বাচন কমিশনার মীরা পান্ডে কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়েই করিয়েছিলেন। সেই নির্বাচন হয়েছিল একাধিক দফায়। সেবার কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন থাকা সত্ত্বেও ভোটের দিনই ২৫ জন প্রাণ হারান। আর গোটা নির্বাচন পর্বে প্রাণ গিয়েছিল ৩৯ জনের। ফলাফলে খুঁজে পাওয়া যায়নি বিরোধীদের।
বিগত বিধানসভা ভোটে রেকর্ড সংখ্যক কেন্দ্রীয় বাহিনী পাঠানো হয়েছিল বাংলায়। কয়েক দফা মিলিয়ে প্রায় হাজার কোম্পানি। অত আধাসেনা আজ মণিপুরেও মোতায়েন করা হয়নি। ভোটও হয়েছিল অভূতপূর্ব আট দফায়। সকাল-বিকেল দেখেছি প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী-সহ কেন্দ্রীয় ক্যাবিনেটের মন্ত্রীসান্ত্রীদের ছুটোছুটি। দলবদল মেলা! সকাল-বিকেল চার্টার্ড বিমানের আসা- যাওয়া, পাঁচতারা হোটেলে কৈলাস বিজয়বর্গীয়দের প্রমোদ, কিছুই বাদ যায়নি।
আজ সিপিএম সঙ্গত কারণেই অতীতের কথা মনে করতে এবং রাখতে চায় না। সিপিএম আমলের পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৩ সালের পঞ্চায়েত ভোটে (Panchayat Election 2023) ৬৮০০ আসনে শাসক দল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছিল। তা ছিল মোট আসনের প্রায় ১১ শতাংশ। ২০০৮ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়-পরাজয়ের নিষ্পত্তি হয় ২৮৪৫টি আসনে। শতকরা হিসেবে তা ছিল ৫.৬। সেসব কথা মনে পড়ে কমরেড?
কংগ্রেস ও বিজেপির অবস্থা আরও খারাপ। সর্বত্র মনোনয়ন দেওয়ার লোকই নেই তাদের হাতে। তাই এবারও গ্রামবাংলার ভোটযুদ্ধে তাদের ‘অস্ত্র’ তৃণমূল কংগ্রেসের বাতিল অংশ। শাসক দল যাঁদের টিকিট দেয়নি কিংবা সাসপেন্ড করেছে, তাদেরকে সামনে রেখেই পঞ্চায়েত ভোটের বৈতরণী পেরতে চাইছেন তাঁরা। নির্দল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়া তৃণমূলীদের পদ্ম প্রতীক দিয়ে মুখ রক্ষায় তৎপর লোডশেডিং অধিকারীর নন্দীভৃঙ্গী বাহিনী। পাশের রাজ্য ত্রিপুরায় গণতন্ত্রের পূজারী বিজেপি কোন ছবি, কোন আদর্শ দেখাল? সেখানে সর্বশেষ পঞ্চায়েত ভোটে ৬,৬৪৬টি আসনের মধ্যে ৫,৬৫২টি আসনেই জয়-পরাজয়ের মীমাংসা হয়েছে বিনা লড়াইয়ে। অর্থাৎ প্রায় ৮৫ শতাংশ আসনে কোনও ভোটই হয়নি। ভোট হয়েছে ৬,৬৪৬টি আসনের মধ্যে মাত্র ৯৯৪টিতে। এরাই আবার ‘বাংলার মাটিতে দাঁড়িয়ে গণতন্ত্র বিপন্ন’ বলে মড়াকান্না জুড়ে দেয়। নব্বইয়ের দশকে কম্পিউটার বিরোধীতার আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত, ইংরেজি তুলে দেওয়ার প্রহসনের মধ্যে দিয়ে এ-রাজ্যের যুবসমাজকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছিল কোন রাজনৈতিক দল? বি টি রোডের দু’ধারে ছোট ছোট কলকারখানা বন্ধ হয়েছে কাদের জঙ্গি ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের সৌজন্যে? সেই বামেরা যখন উপদেশ দিতে আসেন, তখন মানুষ স্বভাবতই তা প্রত্যাখ্যান করে। সেই অত্যাচারী সিপিএম আবার ন্যায় আর গণতন্ত্রের নামাবলি গায়ে ময়দানে সুযোগের অপেক্ষায়। কংগ্রেস- বিরোধিতার শপথ থেকেই এদেশে বামেদের পথচলা শুরু। কেরলে কংগ্রেসের সঙ্গেই এখনও মূল লড়াই। আর এ-রাজ্যে অদ্ভুত অনৈতিক দোস্তি!
অন্য দিকে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, কন্যাশ্রী, যুবশ্রী-সহ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের এক গুচ্ছ জনমুখী কর্মসূচির সুফল রাজ্যের শাসক দলকে এবারও বেশ কয়েক যোজন এগিয়ে রাখছে। সঙ্গে রয়েছে সেনাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেনাপতিত্বে নবজোয়ারে জনজোয়ারের স্পর্শ। আর এসবের সুবাদেই এবারও গ্রামবাংলায় এগিয়ে জোড়া ফুল। তাই লড়াইয়ের চেনা ময়দান থেকে প্ররোচনা দূরে থাক, মানুষ নির্ভয়ে ভোট দিন, উৎসবের আমেজে সাঙ্গ হোক নির্বাচনপর্ব— সেটাই কাম্য। আমরা তারই প্রতীক্ষায়।