তিনি বীর, দেশনায়ক, পরাধীন ভারতের দেশবাসীকে স্বাধীনতার স্বাদ চেনাতে চেয়েছিলেন। তবু তিনি মাটির পৃথিবীর রক্ত-মাংসের মানুষ। তাঁর জীবনেও এক সময় ক্ষণকালের জন্য প্রেম এসেছিল। স্বদেশ-ব্রতধারী সন্ন্যাসীটিও প্রেমিকার জন্য যে কোনও সাধারণ মানুষের মতো ব্যাকুল হয়েছিলেন। সেই স্বল্প আলোচিত অধ্যায়ের কিছু কথা লিপিবদ্ধ করলেন কৃষ্ণা রায়
আরও পড়ুন-রাজনৈতিক গুরুর দেখানো পথেই তাঁর কদম বাড়ানো
তিনি জননায়ক, বীরযোদ্ধা সুভাষচন্দ্র বোস। পরাধীন স্বদেশের মুক্তি এবং কল্যাণ ছিল তাঁর জীবনের একমাত্র অন্বিষ্ট, যার জন্য উপেক্ষা করেছেন উচ্চপদের, প্রভাবশালী আইসিএস হয়ে দিন কাটানোর অভিজাত জীবন। কিন্তু তা বলে কি রক্ত-মাংসের মানুষের জীবনে বসন্তদিনে প্রেম এসে হৃদয়ের সদর-দরজা থেকে ফিরে যাবে? সে-ডাক ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা বড় সহজ নয়। সুভাষচন্দ্রও ফেরাতে পারেননি। আর পারেননি বলেই তিনি মানুষ, কোনও অমর্ত্য-লোকের দেবতা নন। আমাদের বাঙালি জনমানসে কেউ একবার ‘আইডল’ হয়ে উঠলে তাঁর সাধারণ মানবিক আচরণগুলো হয় অবিশ্বাস্য লাগে অথবা সুনজরে দেখা হয় না। এ-নিবন্ধের উদ্দেশ্য এক অসামান্য মানুষের জীবনে স্বল্প-সময়ে নিভৃত ভালবাসার অধ্যায়ের উন্মোচন এবং অবশ্যই তাঁর পারিবারিক উদ্যোগে প্রকাশিত তথ্য-সমৃদ্ধ গ্রন্থের আধারে ।
আরও পড়ুন-নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর জন্মদিবসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্রদ্ধার্ঘ্য
ভিয়েনার এক অসচ্ছল পরিবারের চব্বিশ বছরের তরুণী এমিলি শেঙ্কেল, পেশার তাগিদে এসেছিলেন ভারতীয় জননেতা সুভাষচন্দ্রের জীবনে, ১৯৩৪-এর জুন মাসে। সুভাষচন্দ্র তখন ইউরোপে নির্বাসিত অবস্থায় বই লিখছেন, ‘The Indian struggle’। সে-কাজে সেক্রেটারি হয়ে এলেন এমিলি ওরফে মিলি। জার্মান ভাষায় দক্ষ মেয়েটি কাজ চালানোর মতো ইংরেজি জানেন, আর শিখছেন ফ্রেঞ্চ। প্রাণ-চঞ্চল, ঈষৎ রুগ্ণ স্বাস্থ্যের মেয়েটি কোন মন্ত্রে এই অসাধারণ মানুষের মনে জায়গা করে নিলেন তার ইতিহাস পাওয়া যায় না। শুধু পাওয়া যায় এমিলিকে লেখা সুভাষচন্দ্রের ১৬২টি চিঠি যা নাকি এমিলি বুক দিয়ে আগলে রেখেছিলেন বহু বছর। আর এমিলির লেখা মাত্র ১৮টি চিঠি উদ্ধার হয় ১৯৮০ সালে কলকাতায় বসুবাড়ির এক গোপন সিগার-কেস থেকে। ১৯৩৪ সালের ২৯ নভেম্বরে উল্লিখিত বইটির প্রকাশকালে ভূমিকা-পর্বে সুভাষচন্দ্র লেখায় সহযোগিতার জন্য এমিলিকে বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানালেন। পরের দিনই, বাবার অসুস্থতার খবর পেয়ে কলকাতার উদ্দেশে পাড়ি দিতে হল।
আরও পড়ুন-Netaji Birthday: নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর জন্মদিবসে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সশ্রদ্ধ প্রণাম
পারস্পরিক দেখাশোনায় ছেদ পড়ল, কিন্তু সেই বিরহের পথ ধরে শুরু হল নিবিড় পত্র-সংযোগ। ব্যস্ত স্বদেশপ্রেমীর রোজনামচায় যোগ হল, তেরো বছরের ছোট এমিলিকে নিজের জীবনের খুঁটিনাটি জানানোর কাজ। একই সঙ্গে অনভিজ্ঞ বিদেশি তরুণীটিকে ইংরেজি ভাষা-জ্ঞান মার্জনা, অথবা দক্ষ সাংবাদিক হয়ে ওঠার বাস্তব পাঠের দীক্ষা দিতে লাগলেন। হাসপাতালে, কারাগারে, গৃহে অন্তরীণ অবস্থায়, দার্জিলিংয়ের নিভৃত শৈলাবাসে, বিদেশের স্যানাটরিয়ামে, আকাশ-যাত্রায়, ট্রেন-যাত্রায়, নৌকা-যাত্রায়, রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্তে, কোনও অবস্থাতেই পত্রসংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়নি তাঁর জীবনের দামি আটটি বছরে। নিখাদ স্বাধীনতা-কাঙ্ক্ষীটি তাঁর সদা-ব্যস্ত জীবনে অফুরান কাজের মাঝে নিজের জন্মদিন ভুলে গেছেন, ভোলেননি এমিলির ফোন-নম্বর। ১৯৩৪-এর ৩০ নভেম্বর রোম থেকে এমিলিকে লেখা সুভাষচন্দ্রের চিঠিটি সূচনা পর্বেই জানিয়ে দিচ্ছে, এমিলির লেখা চিঠি তিনি আনন্দ সহকারে পড়েছেন। সেই দিনটি থেকে ১৯৪২-এর ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়কালে লেখা সুভাষচন্দ্রের এইসব চিঠি চিনিয়ে দেয় এক প্রেমিক-হৃদয়ের নিজস্ব বার্তা। সাধে কি সুভাষচন্দ্রের ঘনিষ্ঠ সহযোগী এ সি এন নাম্বিয়ার তাঁর সম্পর্কে একদা লিখেছিলেন, ‘a one sided man— singly for the independence of India— I think the only departure, if one might use the word departure, was his love for Miss Shenkel, otherwise he was completely absorbed— He was deeply in love with her—’
দু’জনের এই ঘনিষ্ঠতা সমাজ-স্বীকৃত বিবাহ-বন্ধনে পরিণতি পেয়েছিল কি না সে-বিতর্কে যেতে এই আলোচক অনাগ্রহী। কিন্তু কে অস্বীকার করবেন, শুদ্ধ-প্রেমের ব্যাপ্তি, বিবাহ নামক প্রাতিষ্ঠানিক শর্তের সীমিত গণ্ডি ছাড়িয়ে দূর দিগন্তরেখায় নিত্য উদ্ভাসিত। দেখা যাক ১৯৩৪-এর ৩০ নভেম্বরের চিঠির কিছু কথা—
‘কাউকে যেন বোলো না, আমি তোমায় এয়ার-মেলে চিঠি লিখছি। কারণ অন্যদের এভাবে লিখি না তো, তাঁরা জানলে দুঃখ পাবেন।’
সেই একই চিঠিতেই এমিলিকে টাকা পাঠাচ্ছেন নতুন টাইপ-রাইটার কেনার জন্য। তারপর একে একে ভেনিস, এথেন্স, ইজিপ্ট, ইরাক প্রভৃতি যাত্রাপথের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে চিঠি লিখছেন, কখনও এক দিনেই একাধিকবার। ১৯৩৪-এর ৩০ নভেম্বর থেকে ১৯৩৫-এর ২৬ জানুয়ারি, মাত্র দু-মাসের কম সময়ে লিখেছেন ১৪টি চিঠি। কলকাতায় ফিরেও সদ্য পিতৃহারা, শোকগ্রস্ত সুভাষচন্দ্র কিছুতেই ভুলতে পারেন না এমিলিকে। কখনও তাঁকে জানাচ্ছেন পারিবারিক অভিজ্ঞতার ইতিবৃত্ত, কখনও লিখছেন সদ্য বিদেশ থেকে ফেরার পথে বিভিন্ন দেশের খুঁটিনাটি বর্ণনা।
আরও পড়ুন-পাড়ায় সমাধানের সাফল্য দক্ষিণ হাওড়ায়
কেননা, সে-মেয়ে এসব জানতে বড়ই আগ্রহী। তাঁকে বড় চিঠি লেখার সময় ব্যস্ত মানুষটি ঠিক করে নিচ্ছেন, পরামর্শ দিচ্ছেন অজস্র ভাল বই পড়তে। এরই মধ্যে বৈদেশিক কূটনীতি-সংযোগের স্বার্থে কিছুদিনের জন্য ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে যেতে হল। সে নিয়ে গোপনীয় তথ্য যথেষ্ট সতর্কতার সঙ্গেই এমিলিকে জানাচ্ছেন, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, ব্যবহার্য জিনিসের বিষয়ে নির্দেশ দিচ্ছেন! কিন্তু এমিলি কি শুধুই তাঁর সেক্রেটারি? প্রতিনিয়ত তাঁর স্বাস্থ্যের সামান্যতম ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে এই তথাকথিত সংসারবিমুখ মানুষটি কেন এত ব্যস্ত? এমিলির জ্বর, ঠান্ডালাগা, কাশি, পেট-ব্যথা, গল-ব্লাডারের সমস্যা, ফুসফুসের সমস্যা সব ধরনের অসুস্থতায় তাঁর প্রখর নজর, সমবেদনা। কখনও নিজেই প্রয়োজনীয় ওষুধের নাম বাতলে দেন, কখনও ডাক্তার দেখানোর জন্য জোর করেন, মাপা ডায়েট অনুসরণ করার পরামর্শ দেন, ধূমপান করার জন্য নিষেধ করেন অথবা বকুনি লাগান। কখনও তাঁকে বলেন সেলাই শেখো, বাজনা শেখো, জিমন্যাস্টিক, ঘর-গৃহস্থালি সামলানোর তামিল নাও, আবার কখনও জোর করেন মনোযোগ দিয়ে বিভিন্ন ধরনের বই পড়তে।
আরও পড়ুন-স্মৃতি রক্ষায় লাল-হলুদের উদ্যোগ সুভাষের মূর্তি সংগ্রশালায়
পেশাগত দক্ষতাকে আর উন্নত করার জন্য ভারতবর্ষের নামীদামি সংবাদপত্রে সাংবাদিকতা করার কৃৎকৌশল শিখিয়ে দেন তন্নিষ্ঠ শিক্ষকের নিষ্ঠায়। কখনও তাঁকে উপহার দিচ্ছেন নিজের পছন্দের বই, হাতির দাঁতের নেকলেস, সুগন্ধী-ধূপ, হাত-ঘড়ি, জুতো, ব্রোচ, হাতির দাঁত আর চন্দন কাঠের বাক্স, আবার কখনও এমিলির আবদার মতো পাঠাচ্ছেন রঙিন কাচের চুড়ি, দেশ-বিদেশের স্ট্যাম্প। কখনও বলছেন জার্মান অনুবাদে গীতা পড়ো আবার কখনও অধৈর্য কিশোরের মতো জানতে চাইছেন তোমার শরীরের ওজন এখন কত? কিংবা সাদা-কোটটায় তোমায় খুব মানিয়েছে, এর দাম কত? সুভাষচন্দ্রের কাছে এই তরুণী নেহাতই ছেলেমানুষ। সাংসারিক হিসেব কিচ্ছু বোঝে না, বারবার তাঁকে টাকাকড়ি খরচের ব্যাপারে হুঁশিয়ার করেন। ভারতবর্ষের কাগজে নিবন্ধ লিখে টাকা আদায় করেছেন কি না জানতে চান। বাচ্চা-দেখাশোনার অথবা পোস্ট-অফিসে এমিলির সাময়িক চাকরি, আগামী দিনে তাঁর স্থায়ী কেরিয়র তৈরির ব্যবস্থাপনা— সব ব্যাপারে এই আন্তর্জাতিক মানের মানুষটি প্রতিনিয়ত উদ্বিগ্ন। হবেন নাই বা কেন? ষাট বছর পেরোতেই মেয়েটির বাবার আকস্মিক মৃত্যু হয়েছে, টাকার অভাবে ছোটবোনের স্কুলের পড়া বন্ধ, তার নিজেরও ফ্রেঞ্চ শেখা মুলতুবি। নিজের বলতে সংসারে আছে তার মা আর ছোট বোন। এই অসহায় দুঃস্থ মেয়েটির কাছে সুভাষচন্দ্রের অনেক দাবি। মাত্র এক-দু’ সপ্তাহ তাঁর চিঠি না পেলে অস্থির হয়েছেন। অস্ট্রিয়ার এই কন্যাটিকে তিনি কি নিজের পছন্দে আমূল গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন? মানসিক সাহায্য, মেধাবী সাহচর্য এবং জীবন-যাপনের অনিবার্য প্রয়োজনে অর্থ সাহায্য, সবই তাঁকে অকৃপণভাবে দিতে চেয়েছেন। ১৯৩৭ সালের ৩০ মে, এমিলিকে লেখা চিঠিতে সুভাষচন্দ্র উন্মুক্ত করেছেন তাঁর নিভৃত অনুভব : ‘Not a single day passes that I do not think of you. You are with me all the time. I can not possibly think of anybody else in this world. I am anxious to know about your thoughts. Please write to me soon in your own language (simple style) by air mail, so that I may know. Everytime I hear that you are not well, I feel so unhappy.’
আরও পড়ুন-জন্ম ও মৃত্যু সার্টিফিকেটে সরলীকরণ
এ যদি ভালবাসার ভাষা না হয়, তা হলে রাষ্ট্রবিপ্লবীর অগ্নিময় জীবন স্পর্শ করে, উত্তাল সময়ে, নিয়মিত পত্রালাপে এত অক্ষর-শ্রম কেন? কোন প্রাণের টানে, আন্তর্জাতিক নজরদারি এড়িয়ে সে-মেয়েকে Orlando Martozza ছদ্মনামে একাধিক চিঠি লিখে যান? কেন শুনতে চাইবেন এমিলির মাতৃভাষাতে নিজস্ব অনুভূতি, শুধু তারই জন্য? প্রেমকে প্রকাশ্যে স্বীকৃতি দিতে না পারার কষ্ট বুঝি তাঁর ছিল না?
দেশনায়কের হৃদয় কি এতই কঠিন? যা জীবনে একবার হলেও ভালবাসার পাঠ দেওয়া-নেওয়ায় অক্ষম?
কেন যে আমরা সে কথা ভুলে যাই!
তথ্য ঋণ :
Letters to Emily Schenkel, 1934-1942. By Subhas Chandra Bose.
Edited by Sisir Kumar Bose and Sugata Bose. Netaji Research Bureau, Kolkata & Permanent Black, Ranikhet, Second impression 2016.