২০২৪-এর লোকসভা ভোট নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ

স্বাধীন ভারতের রূপকাররা এই সনাতন পরম্পরা সূত্রেই চেয়েছিলেন আধুনিক ভারত হবে জাতি-বর্ণ-ধর্মের ঊর্ধ্বে, এক মিলনক্ষেত্র।

Must read

এবারের লোকসভা নির্বাচন শুধু কেন্দ্রের শাসক কোন পক্ষ হবে, সেটা ঠিক করার ভোট নয়। আরও বেশ কয়েকটি সমধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জড়িত এই নির্বাচনের সঙ্গে। এক এক করে আলোচনা করা যাক।
প্রথমেই ধর্মাধর্ম সংক্রান্ত বিষয়। ভোট রাজনীতিতে কতটা তীব্র মেরুকরণ করা যায়, এবার তার রসায়নাগার হয়ে উঠেছে এই দেশ, এই বাংলা। ইতিপূর্বে এমনটা দেখা যায়নি। ভারতীয় রাজনীতিতে সনাতন ধর্মের আগ্রাসী রূপ এর আগে কেউ দেখেনি। নরেন্দ্র মোদির সৌজন্যে ভারতবাসীর সেই ‘সৌভাগ্য’ও এবার হল। গত এক দশকে গেরুয়া শিবির বুঝে গিয়েছে, রাজনীতির জল ঘোলা করতে সত্যের মূল্য যৎকিঞ্চিৎ, সস্তা আবেগের দাম বহুগুণ বেশি। আর তাই রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দের মতো মনীষীরা যে আধুনিকতায় দেশকে দীক্ষিত করে গিয়েছেন, তাকে উপেক্ষা করে তথাকথিত সনাতনপন্থী রাজনীতিকরা ভিন্ন মতের মানুষকে ‘বিধর্মী ও বেজাত’ আখ্যা দিয়ে বিশুদ্ধতা রক্ষায় সচেষ্ট! স্বাধীন ভারতের রূপকাররা এই সনাতন পরম্পরা সূত্রেই চেয়েছিলেন আধুনিক ভারত হবে জাতি-বর্ণ-ধর্মের ঊর্ধ্বে, এক মিলনক্ষেত্র।

আরও পড়ুন-ভুয়ো উন্নয়ন দাবি প্রধান শিক্ষকের, পূর্ণ তদন্ত চাইল তৃণমূল, সাংসদ তহবিলের টাকা তছরুপ শান্তনুর

বহুত্বের মধ্যে একত্বই হল ভারতীয়ত্ব, বিবিধের মাঝে মিলনই হল তার সনাতন সুর। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ভারততীর্থ’ কবিতায় নানা দেশ জাতি সংস্কৃতি ও ধর্মের মানুষের এই ভূমিতে এসে একত্রবাসের কথা বলেছেন। অথচ, আজ সনাতন ধর্মের দোহাই দিয়ে একটি সঙ্কীর্ণ ধারণাকেই প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। মানুষের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের মর্যাদা দেওয়াটা যে সহবত, এই বোধ গত দশ বছরে ক্রমক্ষয়িষ্ণু। তাই বিভিন্ন রাজ্যে স্বঘোষিত হিন্দুত্ববাদী নেতাদের নিয়মিত তর্জনগর্জন শোনা যাচ্ছে। কেন্দ্রের শাসক দলের নৈতিক ও রাজনৈতিক ছত্রছায়াতেই এদের এই বাড়বাড়ন্ত।

আরও পড়ুন-আদালতের রায়ে বিপাকে ব্রিজভূষণ

‘আমার ধর্ম মহান’ কিংবা অন্য ধর্মের শাসনের পরাধীনতার স্মৃতি, আত্মত্যাগের গাথা, এক ধরনের অপমান ও জাতক্রোধ পুষে রাখা— এই সব মিলিয়ে ওই বাক্সবন্দি সমস্যা বা ছাইচাপা আগুন কোনও দিন প্রমাণিত হয়নি। যেসব জায়গায় হিন্দুত্বের গরিমা কিংবা পদদলিত গরিমার ইতিহাস উজ্জ্বল, সেসব জায়গায় ভোটারগণ যা বিশ্বাস করেন তা যত অবৈজ্ঞানিকই হোক না কেন, তাকে লালন করা আসলে গেরুয়া শিবিরের কোটি টাকার স্ট্র্যাটেজি। কোনও ভুল ভাঙানোর প্রয়োজন নেই। ভুলকে সত্যি বলার সুযোগ করে দিয়েছেন এ-দেশের সঙ্ঘ পরিবার পরিচালিত রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীরাই। ফলে আরও সঙ্ঘবদ্ধ সংখ্যাগুরু। তাঁরা বিপদে আছেন, এই বিশ্বাসটিকে যেনতেন ভাবে বাঁচিয়ে রাখা আজ গেরুয়া রাজনীতির কারবারিদের কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ফলে যা কিছু হিন্দুত্বের আওতায় পড়ে না, তা খাঁটি ভারতীয় নয়, এই কথাটা এত প্রকাশ্যে ও সাবলীলভাবে আগে কখনও প্রচারিত হয়নি।
তথাকথিত সনাতন ধর্মের প্রবক্তারা জাতপাতকে মহিমান্বিত করে, পুরাণ-মহাকাব্যকে ইতিহাসের মর্যাদা দিয়ে, ধর্মীয় রীতিনীতিকে অপরাবিদ্যার গরিমা প্রদান করে এবং প্রতিক্রিয়াশীল পিতৃতন্ত্রের বন্দনা গেয়ে সনাতন ভারতের পুনরুজ্জীবনে আগ্রহী। কিন্তু তাঁদের কল্পনার সনাতন ভারত বাঙালি মননে শুধু যন্ত্রণাই বাড়ায়। আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করে।

আরও পড়ুন-মুম্বইকে হারালেই প্লে অফে কলকাতা

এই রাজনীতিকদের কথা এই বাংলার, এই ভারতের মানুষ অত সহজে মেনে নেবে? এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর ঠিক হবে এবারের ভোটে।
আগে বাঙালির সাহিত্য, সংস্কৃতি, বইমেলা ইত্যাদি নিয়ে প্রবল মুগ্ধতা প্রকাশ পেত ভিন প্রদেশের মানুষজনের কথাবার্তায়। কিন্তু এখন বাংলার অবস্থা অতীতের চম্বলের মতো হয়ে গেছে। কলকাতা তো শ্মশান হয়ে গিয়েছে! এখন ওখানে শিক্ষিত বাঙালি থাকে না, সব পালাচ্ছে। বাঙ্গালে মেয়েদের কোনও সম্মান নেই। ওখানে নাকি অনুপ্রবেশকারীদের রাজত্ব চলে। তিন চারটে জেলা বাংলাদেশ হয়ে গিয়েছে। ওখানে ভারতের টাকাও চলে না। বাংলাদেশের টাকা। আর পরীক্ষাটরিক্ষা সব বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এখন আর বাংলায় কোনও আগের মতো টিচার, ডাক্তার, উকিল পাওয়া যায় না। সব ঘোটালা করে পাশ করে। সবাই দু নম্বরি। ভোটও তো নাকি হয় না। সব ভোট ছিনতাই করে নেয় ভোট লুটেরার দল। মানুষ ভোটই দিতে পারে না।
আসলে তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আক্রমণ করতে গিয়ে বিজেপির সর্বভারতীয় নেতৃত্ব সামগ্রিকভাবে বাংলা একটি অবাসযোগ্য স্থান, এখানে শিক্ষিত মানুষ থাকে না, এখানে নারীদের সামান্যতম সুরক্ষা নেই, এখানে আইনের শাসন নেই, এখানে একটি ধ্বংসের রাজত্ব চলছে, এটাই প্রতিষ্ঠা করার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। আর তাদের লেজুড়ের ভূমিকা পালন করছে বাম-কংগ্রেস। এসবের আসল লক্ষ্য কী? আর বিগত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন ইস্যুকে ধরে যেভাবে বাংলাকে কলঙ্কিত করা হয়েছে, সেই ধ্বংস হওয়া ইমেজের ক্ষতিপূরণ দুঃসাধ্য। সন্দেশখালিতে এখন মহিলারা বলছেন, সবটাই মিথ্যা, তাঁদের জোর করে সাদা কাগজে স্বাক্ষর করানো হয়েছিল, টাকা দেওয়া হয়েছিল। বলা হচ্ছিল, বাংলা একটি অগ্নিস্তূপের উপর বসে আছে। জেলায় জেলায় শহরে শহরে নাকি বারুদের কারখানা। বিস্ফোরকের রমরমা। জঙ্গিরাজ্য। বাংলায় কোনও বাজি কারখানায় বিস্ফোরণ হলে সেটাকে সন্ত্রাসবাদী ঘটনা বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়। চলে আসে জঙ্গি-যোগের সন্ধান করতে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা এনআইএ। জেলায় জেলায় শহরে শহরে নাকি বারুদের কারখানা। বিস্ফোরকের রমরমা। জঙ্গিরাজ্য।

আরও পড়ুন-৪৬০ পেয়ে রাজমিস্ত্রি বাবার মুখ রাখল সাবানা

আর এইসব ঝুটা ন্যারেটিভের সুবাদে গোটা দেশের মধ্যে একমাত্র বাংলার অবস্থা সবথেকে খারাপ, বাঙালি এখন বিচ্ছিন্ন এক অন্ধকার দ্বীপে বাস করছে— এরকম একটি ভাবমূর্তি নির্মাণ চলছে।
অবশ্যই আমাদের রাজ্যে অনেক উদ্বেগজনক, লজ্জাজনক, বিপজ্জনক ঘটনা ঘটছে। যার প্রতিবাদ সঙ্গত। হচ্ছেও। কিন্তু গোটা বাংলা এবং বাঙালিই খারাপ হয়ে গিয়েছে? এই প্রচারও মেনে নিতে হবে?
আপামর বঙ্গবাসী এইসব ঝুটা ন্যারেটিভ হজম করেন কি না, সেটা বোঝা যাবে এবারের ভোটের ফল প্রকাশিত হলে।
তাই বাংলার মাতৃশক্তি, যুবজনতা, শ্রমিক-কৃষক, সকল সচেতন নাগরিকের কাছে আমাদের আবেদন, আগামী চার দফার নির্বাচনে ছুঁড়ে ফেলুন বাংলা-বিরোধী নারী-বিদ্বেষী অপশক্তিকে।

Latest article