ইডেন গার্ডেন্সের ঠিক উল্টোদিকে ময়দানের বটতলা। আর সেদিকে তাকালেই চোখে পড়বে মূর্তিটা। দৃপ্ত ভঙ্গিমায় বল পায়ে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। যাঁর বুকের ছাতি, পায়ের পেশি দেখে চমকে যেত বিপক্ষ দলের ফুটবলাররা। খালি পায়ে যিনি লড়ে গিয়েছিলেন বুটপরা শ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে। সবুজ ঘাসে জ্বালিয়েছিলেন দেশাত্মবোধের রংমশাল।
আরও পড়ুন-সময়ের অনুসারী ছিলেন উৎপল দত্ত
তিনি গোষ্ঠ পাল। ময়দানের মহীরুহ। যাঁকে ফুটবল মাঠে টপকাতে না পেরে ব্রিটিশরা নাম দিয়েছিল ‘দ্য চাইনিজ ওয়াল’! কথিত আছে, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তাঁকে প্রথম আলাপে বলেছিলেন— ‘‘তুমিই সেই চিনের প্রাচীর গোষ্ঠ পাল?’’ এত বছর পরেও এই ঘটনার কথা বলতে গিয়ে গলা কাঁপছিল গোষ্ঠবাবুর ছেলে নীরাংশু পালের। তিনি অনর্গল বলেই চলেছেন, ‘‘ভাবতে পারেন, গুরুদেবের মতো ব্যক্তিত্বও বাবাকে চিনতেন!’’
এখানেই না থেমে নীরাংশুবাবু আরও বলে চলেন, ‘‘জানেন ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদও বাবার খেলার ভক্ত ছিলেন। উনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বাবার খেলা দেখতে নিয়মিত মোহনবাগান মাঠে যেতেন। উনি পরে বলেও ছিলেন, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে খালি পায়ে বাবার লড়াই ওঁকে প্রেরণা জোগাত। প্রয়াত অতুল্য ঘোষ একবার বাবা সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘জেল না খাটা বিপ্লবী’! এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে বাবা শুধু একজন বিখ্যাত ফুটবলারই ছিলেন না। ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম সৈনিকও। মোহনবাগান ক্লাবের আরেক বিখ্যাত নক্ষত্র করুণা ভট্টাচার্য বাবাকে বলতেন ‘মাঠের দেবতা’।’’
আরও পড়ুন-কোন অধিকারে তদন্ত? ইডি নিরুত্তর বিচারপতির প্রশ্নে
জন্ম ১৮৯৬ সালের ২০ অগাস্ট। ফরিদপুরের ভোজেশ্বরে। জন্মের মাত্র ১৬ দিন পরেই পিতৃহীন হয়েছিলেন। ফলে লড়াইটা শুরু হয় তখন থেকেই। ছেলে জন্মানোর পরেই বাবার মৃত্যু ভাল চোখে নেননি আত্মীয়দের অনেকেই। ‘অপয়া’ তকমাটা ক্রমশ এঁটে বসছিল! মা নবীন কিশোরী দেবী ছেলেকে নিয়ে নিয়ে চলে যান বাপের বাড়ি। গোষ্ঠবাবুর মামার বাড়ি ছিল বর্তমান বাংলাদেশের ভাগ্যকুলে। যদিও ফরিদপুরের বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ এবং যাতায়াত ছিল। গোষ্ঠবাবুর বয়স যখন বছর দশেক, তখন এক কাকার পরামর্শে মায়ের সঙ্গে শোভাবাজারের কুমোরটুলিতে চলে আসেন। সেখানে তাঁদের একটি পৈতৃক ভিটে ছিল। মা ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দের ভক্ত। চাইতেন ছেলেও স্বামীজির বাণী শুনুক। শোভাবাজারের এক ঠাকুরবাড়িতে ছেলেকে নিয়ে যেতেন মা। সেখানেই প্রথমবার স্বামীজির বাণী শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল বছর দশেকের ছেলেটার। ফুটবল মানুষের চরিত্র গঠন করে। ব্যস, সেদিন থেকেই গোষ্ঠবাবুর ফুটবল-প্রেম শুরু। কুমোরটুলির পার্কে চুটিয়ে শুরু করলেন ফুটবল খেলা। কখনও মাকে লুকিয়ে বগলে হাফপ্যান্ট নিয়ে বেরোতেন। আবার কোনও দিন সেটা সম্ভব না হলে, ধুতি পরেই চলত ফুটবলে লাথি। শেষ পর্যন্ত কুমোরটুলি ক্লাবে সই।
আরও পড়ুন-এবার পরমাণু যুদ্ধের হুমকি লুকাশেঙ্কোর
১৯১২ সাল। আগের বছরেই ইস্ট ইয়র্কশায়ারকে হারিয়ে আইএফএ শিল্ড জিতেছে মোহনবাগান। ফুটবল ও জাতীয়তাবোধ সেই সময় মিলেমিশে একাকার। গোটা দেশে নায়কের সম্মান পাচ্ছেন শিবদাস ভাদুড়ীরা। ভাগ্যকুলে একটি প্রতিযোগিতা খেলতে গিয়েছিল মোহনবাগান। গোষ্ঠবাবুও তখন সেখানে। স্থানীয় একটি দলের হয়ে মোহনবাগানের বিরুদ্ধে মাঠেও নেমে পড়েছিলেন। ওই ম্যাচেই তিনি নজরে পড়ে যান শিল্ডজয়ী মোহনবাগান দলের অন্যতম নায়ক রাজেন সেনগুপ্তর। ম্যাচের পর সরাসরি রাজেনবাবুর কাছ থেকে প্রস্তাব পান— ‘‘তুমি মোহনবাগানে খেলবে?’’
পরের বছরেই মোহনবাগানে যোগ দেন গোষ্ঠবাবু। তবে পথটা মসৃণ ছিল না। নীরাংশুবাবু বলছিলেন, ‘‘ঠাকুমার প্রবল আপত্তি ছিল। উনি চাইতেন বাবা ফুটবল খেলে সময় নষ্ট না করে স্বামীজির আদর্শে নিজেকে যেন গড়ে তোলেন। কিন্তু বাবার এক কাকা মাকে বুঝিয়ে মোহনবাগানে খেলার রাস্তা খুলে দেন।’’
আরও পড়ুন-বিশ্বকাপের পর ফের ব্রাজিল দলে নেইমার
তবে সবুজ-মেরুন জার্সিতে অভিষেক ম্যাচটা ভাল হয়নি বছর ষোলোর গোষ্ঠ পালের। সেটা ছিল তৎকালীন ময়দানের নামী ব্রিটিশ ক্লাব ডালহৌসির বিরুদ্ধে প্রীতি ম্যাচ। একে তো বৃষ্টি ভেজা মাঠ। তার উপরে প্রথমবার মোহনবাগানের মতো ক্লাবের জার্সিতে প্রথম ম্যাচ। স্নায়ুচাপে নিজের সহজাত খেলাটাই খেলতে পারেননি গোষ্ঠ পাল। দু’গোলে জিতে যায় ডালহৌসি। মাথা নিচু করে সেদিন মাঠ ছেড়েছিলেন। ভেবেছিলেন এটাই শেষ। আর মোহনবাগানে খেলার ডাক পাবেন না। কিন্তু সেই ভুল তাঁর ভেঙে যায় দ্রুত। কয়েকদিনের মধ্যেই আরেক শক্তিশালী দল ব্ল্যাক ওয়াচ ক্লাবের সঙ্গে খেলা ছিল মোহনবাগানের। ডাক পড়ে গোষ্ঠবাবুর। মনটা খুশিতে ভরে উঠলেও মাঠে নামার সুযোগ পাবেন না ধরেই নিয়েছিলেন। কিন্তু প্রথম দলেই নাম ছিল তাঁর। শুধু তাই নয়, পছন্দের জায়গা রাইট ব্যাকে খেলার সুযোগও পান।
আরও পড়ুন-ভিনরাজ্যে পড়তে গিয়ে রহস্যমৃত্যু ছাত্রীর, আদালতের দ্বারস্থ পরিবার
আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। সেই ম্যাচে গোষ্ঠ পাল অসাধারণ ফুটবল খেলেছিলেন। প্রতিপক্ষের একের পর এক আক্রমণ ধাক্কা খেয়েছিল সবুজ-মেরুন রক্ষণে পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকা বছর ষোলোর ছেলেটার সামনে। বাকিটা ইতিহাস। এরপর দীর্ঘ ২৩ বছর সবুজ-মেরুন জার্সিতে ময়দান দাপিয়েছেন। মা ততদিনে দেশে ফিরে গিয়েছেন। ছেলে কলকাতায় ফুটবল পিটিয়ে বেড়াচ্ছে, এই খবরে তিনি মোটেই খুশি ছিলেন না। তাই কিছুটা জোর করেই বছর দেড়েকের মধ্যে ছেলের বিয়ে দিয়ে দেন। লজ্জায় ক্লাবে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন গোষ্ঠবাবু। কিন্তু বিয়ের খবর পেয়ে তাঁকে ডেকে পাঠান মোহনবাগান ক্লাবের তৎকালীন অন্যতম শীর্ষ কর্তা শৈলেনবাবু। শুধু তাই নয়, বিয়ের উপহার হিসেবে একটি বিশেষ ব্যাজ তুলে দেন গোষ্ঠবাবুর হাতে। যা তৈরি করা হয়েছিল ১৯১১ আইএফএ শিল্ডজয়ী মোহনবাগান দলের ১১ জন ফুটবলারের জন্য। একটা ব্যাজ বাড়তি ছিল। সেটাই শৈলেনবাবু উপহার দিয়েছিলেন তরুণ গোষ্ঠ পালকে।
আরও পড়ুন-ভারতীয় বংশোদ্ভূত ডাক্তারের সাহায্যে ব্রিটিশ পুলিশের জালে নবজাতক খুনি নার্স
নীরাংশুবাবুর স্মৃতিচারণ, ‘‘বাবার মুখে শুনেছি, শৈলেনবাবু সেদিন একটা প্রতিজ্ঞাও করিয়ে নিয়েছিলেন। বাবাকে কথা দিতে হয়েছিল, কোনওদিন মোহনবাগান ক্লাব ছাড়বেন না। বাবা সেই কথা রেখেছিলেন। তবে মজার ব্যাপার কী জানেন, বাবা কিন্তু ইস্টবেঙ্গলের হয়েও খেলেছেন!’’
কীভাবে? নীরাংশু বাবুর কথায়, ‘‘বাবা ততদিনে ময়দানে সাড়া ফেলে দিয়েছেন। ফুটবলে গোল-ই শেষ কথা। অথচ একজন ডিফেন্ডারের খেলা দেখতে মাঠ ভরিয়ে দিচ্ছেন দর্শকরা। মোহনবাগান ক্লাবও কলকাতা লিগের দ্বিতীয় ডিভিশন থেকে প্রথম ডিভিশনে উঠে এসেছে। দাপটের সঙ্গে খেলছে। বাবার নেতৃত্বে ডুরান্ড কাপ, রোভার্স কাপও খেলছে। কিন্তু বাবার এক মামা ছিলেন ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের কর্তা। তিনি বাবাকে প্রস্তাব দেন লাল-হলুদ জার্সি গায়ে চাপানোর। শুধু তাই নয়, বাড়ি এবং বিশাল অঙ্কের অর্থের প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছিল বাবাকে। কিন্তু বাবা পত্রপাঠ না করে দেন।’’ নীরাংশুবাবু বলে চলেন, ‘‘ইস্টবেঙ্গল ক্লাব তখনও ভারতীয় ফুটবল সংস্থার নথিভুক্ত ক্লাব নয়। কুমোরটুলি, শ্যামপার্কের ছোট ছোট টুর্নামেন্ট খেলত। মামার অনুরোধে তেমনই কয়েকটা পাড়ার টুর্নামেন্টে বাবা খেলেছিলেন। তবে সেগুলো কোনওটাই স্বীকৃত টুর্নামেন্ট ছিল না। তাই বাবাকে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের ফুটবলার সেই অর্থ বলা যাবে না। তবে জন্মসূত্রে পূর্ব বাংলার হলেও, বাবা আজন্ম নিজেকে মোহনবাগানী বলেই পরিচয় দিতে ভালবাসতেন।’’
আরও পড়ুন-প্রশাসনে স্বচ্ছতার লক্ষ্যে বিজয়ীদের অঙ্গীকারপত্রে স্বাক্ষর করাচ্ছে তৃণমূল
এদিকে, গোষ্ঠবাবু যোগ দেওয়ার দু’বছরের মধ্যেই দ্বিতীয় ডিভিশন চ্যাম্পিয়ন হয়ে কলকাতা লিগের প্রথম ডিভিশনে খেলার ছাড়পত্র আদায় করে নিয়েছিল মোহনবাগান। ১৯১৫ সালে লিগে চতুর্থ স্থান অধিকার করে সবুজ-মেরুন বাহিনী। পরের বছরেই রানার্স-আপ। ১৯২১ সালে প্রথমবার মোহনবাগানের অধিনায়ক নির্বাচিত হন গোষ্ঠবাবু। টানা পাঁচ-পাঁচটা বছর সেই দায়িত্ব সামলেছেন। তাঁর নেতৃত্বে ১৯২৩ সালে আইএফএ শিল্ডের ফাইনালে উঠেছিল মোহনবাগান। কিন্তু ক্যালকাটা এফসির কাছে হেরে রানার্স হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়।
সেদিন প্রবল বৃষ্টিতে মাঠ খেলার অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছিল। তবুও ব্রিটিশ রেফারি সেই কাদা মাঠেই গোষ্ঠবাবুদের খেলতে বাধ্য করেছিলেন। খালি পায়ে খেলা বঙ্গসন্তানরা বুট পরা শ্বেতাঙ্গদের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারেননি। পরের বছর, ১৯২৪ সালে ভারতীয় দলের অধিনায়ক হন গোষ্ঠ পাল। তাঁর নেতৃত্বে কলম্বো সফরে গিয়েছিল দল।
আরও পড়ুন-মোদি সরকারের দ্বিচারিতা, বিপন্ন বাংলার শিক্ষিত যৌবন
কীভাবে গোষ্ঠ পালের নাম ‘চিনের প্রাচীর’ হল? নীরাংশুবাবুর কথায়, ‘‘রোভার্স কাপে বাবার খেলা দেখে মুগ্ধ হন এক ইংরেজ সাংবাদিক। শুনেছি, তিনিই প্রথম বাবাকে ‘দ্য চাইনিজ ওয়াল’ বলে চিহ্নিত করেছিলেন। পরে সংবাদপত্রেও বাবাকে ‘দ্য গ্রেট ওয়াল অফ চায়না’ বলে প্রতিবেদন লেখা হয়।’’
১৯৬২ সাল। প্রথম ভারতীয় ফুটবলার হিসেবে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত হন গোষ্ঠ পাল। কাট টু— ১৯৭৬ সালের ৮ এপ্রিল। চিরঘুমের দেশে পাড়ি দিলেন দুর্ভেদ্য ‘চিনের প্রাচীর’! মোহনবাগানের জার্সি এবং পতাকায় মোড়া তাঁর মরদেহ যখন শ্মশানে নিয়ে আসা হয়, তখন ‘ফুটবল দেবতা’কে শেষ দেখা দেখতে সেখানে ভিড় জমিয়েছিলেন অগণিত মানুষ।
আরও পড়ুন-ওয়ার্ক ফ্রম হোম বনাম অফিস সঙ্কটে মহিলা কর্মী
তাঁর নামে ডাকটিকিট বেরিয়েছে। নামকরণ হয়েছে শহরের রাস্তারও। আজও ময়দানের বটতলায় পা রাখলেই তাঁর মূর্তির সামনে থমকে দাঁড়াতে হয়। বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন তিনি। ‘দ্য গ্রেট চাইনিজ ওয়াল’— গোষ্ঠ পাল।