মোদি সরকারের দ্বিচারিতা, বিপন্ন বাংলার শিক্ষিত যৌবন

কেন্দ্রীয় সরকারের দু’মুখো নীতির জন্য কালোয় ঢেকেছে ভারতের লক্ষাধিক বি-এড ডিগ্রিধারীর জীবন। কেন? কীভাবে? লিখছেন তৃণমূল কংগ্রেসের মুখপাত্র কামাল হোসেন

Must read

২০১৮ সালের জুন মাস নাগাদ খুব ঘটা করে NCTE গেজেট পাশ করে বলে দিলেন, প্রাইমারি শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় এবার থেকে DLED-এর সঙ্গে পরীক্ষায় বসবে B-ED-রাও। ঠিক যেমন নোটবন্দি ও দু’হাজার টাকার নোট চালু ও তুলে নেওয়ার মতো আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল সারা ভারতের সমস্ত নাগরিকদের মধ্যে, এই নতুন নিয়ম চালু হওয়ার ফলে তেমনটাই হল। তারপর থেকে ভারতবর্ষের সমস্ত রাজ্যের এবং আমাদের পশ্চিমবঙ্গেও বহু যুবক-যুবতী প্রাইমারি স্কুলে চাকরি পাওয়ার জন্য ডিএলএডের বদলে বি-এডে ভর্তি হতে শুরু করে দিল। কারণ তারা জানত ডিএলএড করলে কেবল প্রাইমারি ও আপার প্রাইমারিতে বসা যাবে কিন্তু এই বি-এড করলে একেবারে প্রাইমারি থেকে একাদশ-দ্বাদশ বিদ্যালয়ের নিয়োগ পরীক্ষায় বসার সুযোগ মিলবে। তাই আশায় বুক বেঁধে সারা ভারতের বহু যুবক-যুবতী কষ্ট করে টাকা জোগাড় করে কলেজে কলেজে বি-এডে ভর্তি হতে লাগল।

আরও পড়ুন-‘‌পশ্চিমবঙ্গ দিবস’ পালন নিয়ে কমিটি গড়লেন অধ্যক্ষ

আমাদের পশ্চিমবঙ্গেরও প্রায় দেড় লাখের বেশি যুবক-যুবতী ২০১৮ সাল থেকে বি-এড ডিগ্রি কমপ্লিট করে নিল। সারা ভারতের প্রায় সমস্ত রাজ্যের পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় যে ২০১৮-এর পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত প্রায় কোটিখানেক ছেলে-মেয়ে বিএড পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে এবং বি-এড পাশ করার পরে বা চলাকালীন তারা সংশ্লিষ্ট রাজ্যের প্রাইমারি শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। প্রায় ১০ লাখের মতো পরীক্ষার্থী টেট কোয়ালিফাইড করে। এমনকী বছরে দুটো কেন্দ্রীয় সরকারের যে সেন্ট্রাল টেট হয় সেখানেও অনেকে এই বি-এড ডিগ্রির জন্য অংশগ্রহণ করতে পেরেছিল এবং সফল হয়েছে। আমাদের পশ্চিমবঙ্গে ২০১৮-’১৯ সাল নাগাদ বেশ কিছু বি-এড ডিগ্রিধারীরা প্রাইমারিতে চাকরি করছে। এবং বর্তমানে ২০১৪ সালের প্রাইমারি নিয়োগ প্রক্রিয়ার জন্য পশ্চিমবঙ্গে পার্সোনালিটি টেস্ট কমপ্লিট হয়ে গেছে এবং সেখানে প্রায় চোদ্দো হাজার শূন্যপদের মধ্যে সাড়ে আট হাজার বি-এড ডিগ্রিধারীরা আছেন এবং ২০১৭ সালের টেট পরীক্ষার ফলাফল বার হল ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে তখন সেখানেও দেখা গেল প্রায় দশ হাজার শূন্যপদের জন্য সফল পরীক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় নয় হাজারের মতো।

আরও পড়ুন-কলকাতা মেট্রোয় নয়া পরিকল্পনা, আর খুলবে না উল্টো দিকের দরজা

সবার দিন বেশ ভালই যাচ্ছিল এবং আনন্দে আত্মহারা হয়েছিল সারা ভারতবর্ষ তথা পশ্চিমবঙ্গের এই প্রাইমারি শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগ পরীক্ষার টেট-উত্তীর্ণ যুবক-যুবতীরা এবং তাদের টেট সার্টিফিকেট দেওয়া হয়েছিল যা বৈধ থাকবে সারাজীবন। কিন্তু কয়েকদিন আগে সুপ্রিম কোর্ট-এর মাননীয় বিচারপতি অনিরুদ্ধ বসুর ডিভিশন বেঞ্চ জানিয়ে দিল যে রাজস্থান হাইকোর্টের রায় বহাল থাকবে এবং কেবল ডিএলএডরা প্রাইমারি পরীক্ষায় বসতে পারবেন। কারণ, শিশুদের শিক্ষার জন্য একমাত্র যোগ্য মাপকাঠি তাদেরই আছে। কিন্তু বি-এডদের যে যোগ্যতা সেই যোগ্যতার জন্য তারা প্রধানত কিশোর-কিশোরীদের জন্য উপযুক্ত অর্থাৎ ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগ পরীক্ষায় বসতে পারবে বি-এডরা। আর এই খবর বিদ্যুৎ-গতিতে ছড়িয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে ভারতের সমস্ত বি-এড ডিগ্রিধারীদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। ভেঙে পড়েছেন ভারতের লক্ষ লক্ষ বি-এড ডিগ্রিধারীরা। আরও বেশি শোকে ভারাক্রান্ত হয়েছে সেই সমস্ত বি-এড ডিগ্রিধারীরা যারা বিভিন্ন রাজ্য তথা পশ্চিমবঙ্গের প্রাইমারি শিক্ষক-নিয়োগ পরীক্ষায় টেট কোয়ালিফায়েড করেছে।

আরও পড়ুন-বিজেপি সাংসদ আলুওয়ালিয়ার বিরুদ্ধে বর্ধমান থানায় অভিযোগ দায়ের করলেন খোদ পদ্ম নেতা

পশ্চিমবঙ্গে প্রাইমারি টেটের ২০১৪ সালের রেজাল্ট একেবারে কিছুদিনের মধ্যে বার হওয়ার সম্ভাবনা ছিল কিন্তু তা হতে আরও কিছুদিন সময় লাগবে কারণ সমস্ত বি-এডকে বাদ দিতে হবে ইন্টারভিউ-এর পরে আপাতত তৈরি করা প্যানেল থেকে এবং সমস্ত ডিএলএফ ডিগ্রিধারীদের ডেকে তাদের আবার পার্সোনাল টেস্ট নিতে হবে। এবং একই ঘটনা ঘটবে ২০১৭ সালে যারা পাশ করে বসে আছে ইন্টারভিউয়ের অপেক্ষায়। তবে অনেকে খুব আশায় বুক বেঁধেছিল যে, যেহেতু কেন্দ্রীয় সরকারের ভুলনীতির জন্য এই লক্ষ লক্ষ বেকার যুবক-যুবতীর ভবিষ্যৎ নষ্টের দিকে গিয়েছে তাই কেন্দ্রীয় সরকার বা এনসিটি সুপ্রিম কোর্টে নতুনভাবে রিভিউ করাতে পারে অথবা অধ্যাদেশ প্রণয়ন করে এই রায়টিকে খারিজ করে দিতে পারে। কিন্তু ক’দিন আগে এনসিটির বিশেষজ্ঞরা একটি মিটিং-এর মাধ্যমে পরিষ্কার করে জানিয়ে দিয়েছে যে তাঁরা ভারতের সংবিধান মেনে চলেন এবং সুপ্রিম কোর্টের এই রায়কে স্বাগত জানাবেন। তাই কোনও রকমের হস্তক্ষেপ করবেন না। মাননীয় বিচারপতিদের পর্যবেক্ষণে দেখা যায় কোথাও তাঁরা লেখেননি যে এই রায় বেরবার আগে যে-সমস্ত বি-এড ডিগ্রিধারী ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে চাকরি করছেন তাঁদের চাকরি চলে যাবে। এরকম কোনও উল্লেখ সেখানে নেই। তাই নিশ্চিত ভাবে যাঁরা বি-এড ডিগ্রি নিয়ে প্রাথমিক শিক্ষক-শিক্ষিকা পরীক্ষায় বহাল তবিয়তে আছেন তাঁদের চিন্তার কোনও কারণ নেই।

আরও পড়ুন-কলকাতায় বন দফতরের অভিযানে উদ্ধার হাজারটি হরিণের শিং

এখানেই শিক্ষক হিসাবে আমার একটি প্রশ্ন আপামর ভারতবাসীর কাছে এবং প্রধানত বিজেপির কাছে আর পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি নেতৃত্বের কাছে। আমি জানতে চাই যে, এই নিয়ে তাদের মধ্যে কোনও আন্দোলন নেই কেন বা এই নিয়ে তাদের কোনও কথা নেই কেন? আসলে সারা ভারতের লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ের জীবন নিয়ে ছেলেখেলা করল বিজেপি-শাসিত কেন্দ্রীয় সরকারের NCTE। অথচ রাজ্যে কেন নিয়োগ হচ্ছে না বা রাজ্য নাকি নিয়োগের দুর্নীতিতে একেবারে ফেঁসে গেছে, এই নিয়ে তাঁরা বেশ গলা ফাটাচ্ছিলেন তাঁরা। পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই দুই প্রাইমারি পরীক্ষার ফল দুটো বার করার জন্য উদগ্রীব হয়ে বসে আছে, কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের ২০১৮ সালের নীতির জন্য আজকের চাকরির পরীক্ষার্থীদের চাকরি পাওয়ার দিনক্ষণ বেশ কিছুদিন পিছিয়ে গেল। রাজ্যের বিজেপি নেতৃত্বরা এই নিয়ে কেন মুখ খুলছেন না?

আরও পড়ুন-জরিমানার হয়রানি, ঠেকাতে নয়া নির্দেশিকা আরবিআইএর

সেই সঙ্গে জানতে চাই, রাজ্যের অপর বিরোধী দলগুলো কেন এখন বিজেপির সুরে সুর মিলিয়ে চুপ হয়ে আছেন এবং চাকরি হচ্ছে না বা চাকরিতে নাকি দুর্নীতির গন্ধ আছে এই ভেবে যাঁরা রাস্তায় বসে আছেন? দীর্ঘদিন ধরে তাঁদের খুব সহানুভূতির সঙ্গে এই অনুরোধ করা হচ্ছে যে, তাঁরা যেন এটার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। যাঁরা বা যে লক্ষাধিক পরীক্ষার্থী বি-এড ডিগ্রি লাভ করে প্রাইমারি শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় কোয়ালিফায়েড করে বসে আছেন তাঁরা কেন কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামছেন না বা তাঁরা কেন প্রতিবাদে মুখর হচ্ছেন না? এই প্রশ্নগুলো কিন্তু সমাজের বুকে রয়েই গেল।

Latest article