ভারতের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে সংগ্রামী জাতীয়তাবাদ একটি অবিস্মরণীয় অধ্যায় যার তিন প্রধান নায়ক ছিলেন যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, রাসবিহারী বসু এবং স্বল্প সময়ের জন্য হলেও নিঃসন্দেহে অরবিন্দ ঘোষ। বাংলা তথা ভারতের সহিংস বিপ্লবের প্রতিভূ বা বোমা-পিস্তলের বিপ্লবীদের সম্পর্কে এক শ্রেণির ঐতিহাসিক আজও তাচ্ছিল্যকর মন্তব্য ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অনৃতভাষণ করে থাকেন। তাঁদের মতে, এই বিপ্লবীরা ছিলেন ভাবালুতায় আচ্ছন্ন বাস্তববোধবর্জিত এবং সর্বোপরি জনসমর্থনহীন একদল রোমান্টিক স্বাধীনতা সৈনিক, যাঁদের দেশপ্রেম প্রশ্নাতীত হলেও তাঁদের কর্মপ্রয়াস হল নিদারুণ ব্যর্থতার ইতিহাস। এখানে মনে রাখতে হবে যে ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকী, কানাইলাল দত্ত, সত্যেন বসু, বিনয়-বাদল-দীনেশ প্রমুখের বিচ্ছিন্ন গুপ্তহত্যা ও রাজপুরুষ নিধনের প্রচেষ্টার ব্যাপ্তি ও তাৎপর্য তেমন সুদূরপ্রসারী ছিল না।
আরও পড়ুন-রেলের তুঘলকি কাণ্ড একগুচ্ছ ট্রেন বাতিল
পক্ষান্তরে, যতীন্দ্রনাথ (বাঘাযতীন), রাসবিহারী ও অরবিন্দর বৈপ্লবিক পরিকল্পনা ছিল বিচ্ছিন্ন সন্ত্রাসের চেয়ে অনেক বৃহৎ এবং ব্যাপক। সশস্ত্র গণ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মাতৃভূমির শৃঙ্খলমোচন ছিল তাঁদের লক্ষ্য। এর জন্য প্রয়োজন ব্যাপক গণ আন্দোলনের, বিদেশ থেকে অস্ত্র আমদানি ও সর্বোপরি মটিশ ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর মধ্যে বিদ্রোহের আগুন প্রজ্বলিত করে তা সারা ভারতে ছড়িয়ে দেওয়া। রাসবিহারী বসু এখানে যে ভূমিকা পালন করেছিলেন তা ছিল বাঘাযতীন ও অরবিন্দের সমধর্মী। বাঘাযতীনের সঙ্গে তাঁর বিশেষ অন্তরঙ্গতা ছিল। এ প্রসঙ্গে সশস্ত্র বিপ্লবের প্রবক্তা পাঞ্জাবের লালা হরদয়ালের নামও উল্লেখযোগ্য, যিনি ১৯০৮ সালে অক্সফোর্ডে লেখাপড়া শিকেয় তুলে পাঞ্জাবে ফিরে আসেন ব্রিটিশ শাসনের প্রতি তীব্র ঘৃণা নিয়ে। তারপরেই দেশান্তরী হয়ে আমেরিকায় পুরনো গদর দলের মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করেন।
আরও পড়ুন-পাহাড়ে গণতন্ত্র ধ্বংস চায় পদ্ম
হরদয়ালের শূন্যস্থান পূরণ করেন রাসবিহারী। লাহোরে এসে হরদয়ালের দুই শিষ্য দীননাথ ও আমির চাঁদের সঙ্গে মিলিত হলেন। আমির চাঁদকে দিল্লি ও দীননাথ ও আরও দু’জন পাঞ্জাবী যুবককে দেওয়া হল লাহোরের দায়িত্ব। রাসবিহারীর বিশ্বস্ত অনুচর বসন্ত বিশ্বাস লাহোরে এক ডাক্তারখানায় কম্পাউন্ডারের কাজ নিলেন। এই সময় উত্তর ভারতে চাঁদা তুলে বাংলা থেকে বােমা, পিস্তল আনা হত, যা আসত চন্দননগর ও কলকাতার রাজাবাজার থেকে। এরপর ঘটল ২৩ ডিসেম্বর ১৯১২-র সেই ঐতিহাসিক ঘটনা। দিল্লির লালকেল্লায় দরবার করতে হাতির পিঠে চেপে আসছিলেন বড়লাট হার্ডিঞ্জ। হঠাৎ কী একটা এসে পড়ল হাতির উপর এবং প্রচণ্ড কর্ণবিদারক বিস্ফোরণে কেঁপে উঠল পৃথিবী। হার্ডিঞ্জ আহত হয়েও বেঁচে গেলেন কিন্তু হাওদার পিছনে দাঁড়ানো লাটসাহেবের অনুচর ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলেন। যতদূর জানা যায়, বোমা নিক্ষেপ করেছিলেন বসন্ত বিশ্বাস। যদিও সমগ্র পরিকল্পনা ছিল রাসবিহারীর। বসন্ত বিশ্বাস তখন ধরা না পড়লেও দু’বছর পর অন্য একটি ঘটনায় ধরা পড়ে ফাঁসির মঞ্চে জীবন উৎসর্গ করেন। রাসবিহারী কাশীবাসী হন এবং শত চেষ্টাতেও পুলিশ তাঁকে ধরতে পারেনি।
আরও পড়ুন-কলেজ খুলে হচ্ছে ক্লাস, নানান সাংস্কৃতিক উৎসব, কী উদ্দেশ্যে অনলাইন পরীক্ষা
আর একবার রাসবিহারীর খবর পেয়ে পুলিশ একটি বাড়ি ঘিরে ফেলে। দরজা খুলে হাতা-খুন্তি হাতে বেরিয়ে এল এক উড়িয়া ঠাকুর। পুলিশ তাকে ঠেলে বাড়িতে ঢুকে তল্লাশি করে কাউকে পেল না। কিন্তু পরে দেখল উড়িয়া ঠাকুরটি আর এ তল্লাটে নেই। আর একবার পায়খানার হাঁড়ি মাথায় নিয়ে এক মেথর পুলিশ ইন্সপেক্টরকে সেলাম করতে থাকে। দুর্গন্ধে অতিষ্ঠ হয়ে তিনি বলেন, ‘দূর হও’। পরে বুঝেছিলেন মেথরটি আসলে কে। আর একবার মরার খাটিয়ায় শুয়ে তিনি পুলিশের চোখে ধুলো দিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন-বিজেপিতে আফটার শক
১৯১৫ সালে জানুয়ারিতে রাসবিহারী বেনারসে নিভৃত বিপ্লবের পরিকল্পনা করেন। সেসময় প্রথম বিশ্ব মহাযুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে আর গোরা সেনাদের অধিকাংশই তখন ভারতের বাইরে লড়াইয়ে ব্যস্ত। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত থেকে বাংলা পর্যন্ত অভ্যুত্থানের স্বপ্ন দেখেন রাসবিহারী। ভারতীয় সেনাদের গ্রামীণ আত্মীয়স্বজনকে নিয়ে সিভিল রিভলিউশনের চিন্তা রাসবিহারীর ছিল। পাঞ্জাব ও যুক্তপ্রদেশের যেসব গ্রামাঞ্চল থেকে সরাসরি উদ্যোগে সেনা ভর্তি করা হত সেসব জায়গায় তাঁর দূতেরা গেলেন এবং পতাকা ও গদর দলের ইস্তাহার বিলি করলেন গ্রামবাসীদের মধ্যে। মহাযুদ্ধের সুযোগ নিয়ে সামারিক ও অসামারিক সমাজের যৌথ প্রয়াসে বিদ্রোহের আগুন জ্বালাবার চেষ্টা করলেন তিনি। ১৯১৫-র জানুয়ারির শেষ থেকে ফেব্রুয়ারির শুরু পর্যন্ত পাঞ্জাবে রাজনৈতিক ডাকাতির ঝড় বয়ে গেল, বাংলাতেও একই জিনিস ঘটল।
আরও পড়ুন-শিয়ালদহ-ফুলবাগান মেট্রো মঙ্গলবার
১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯১৫, রাসবিহারী আবার তাঁর সহচরদের নিয়ে বৈঠকে বসে ২১ ফেব্রুয়ারি, অভ্যুথানের জন্য তৈরি থাকতে বললেন। পুলিশ এবারে প্রস্তুত ছিল এবং কৃপাল সিং নামে এক গুপ্তচরকে কাজে লাগিয়ে বিদ্রোহ অঙ্কুরে বিনষ্ট হয়ে যায় এবং এরপরেই রাসবিহারী লাহোর থেকে বেনারস, সেখান থেকে কলকাতা এবং শেষ পর্যন্ত পি এন টেগোর ছদ্মনামে জাপানে চলে যান। এরপর ভারতে সংগ্রামী জাতীয়তাবাদের ইতিহাসে এক বিরাট শূন্যস্থান সৃষ্টি হয়। বাঘাযতীন বুড়ি বালামের যুদ্ধে আত্মবলিদান করেন, রাসবিহারী ও মানবেন্দ্রনাথ রায় দেশান্তরে চলে যান এবং সশস্র আন্দোলনের প্রয়াসে সামরিক ছেদ পড়ে। দেশত্যাগের পর ১৯২৪ সালে টোকিওতে ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লিগ স্থাপন করেন এরপর এর অঙ্গ হিসেবে ইস্ট ইন্ডিয়ান ন্যাশানাল আর্মি প্রতিষ্ঠিত হয় ডিসেম্বর ১৯৮১-তে। এ সময় ক্যাপটেন মোহন সিংয়ের সঙ্গে রাসবিহারীর তীব্র মতবিরোধ হয় কারণ মোহন সিং নিজের একক নেতৃত্বে এই বাহিনীকে পরিচালনা করতে চেয়েছিলেন।
আরও পড়ুন-বাংলায় শূন্য, এবার দলের মধ্যেও শূন্য
রাসবিহারী তখন মোহন সিংকে বিতাড়িত করেন এবং ব্যাংকক কনফারেন্স গৃহীত সংবিধান অনুসারে এই বাহিনীকে জাপানের সঙ্গে সমমর্যদাসম্পন্ন যে স্বীকৃতি দেওয়া হয় তার জন্য পুনরায় সরকারের কাছে আবেদন রাখেন। ইতিমধ্যে তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি হয়ছিল এবং ভারত থেকে সুভাষচন্দ্রকে তিনি জাপানে নিয়ে আসার বিষয়ে আগ্রহী হন। সুভাষের সংগ্রামী নেতৃত্বকে তিনি ১৯৩৪-তেই স্বাগত জানান। সুভাষ ১৯৩০ সালে কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত হলে রাসবিহারী ২৫ জানুয়ারি ১৯৩৮-এ এক চিঠিতে তাঁকে সমর্থন ও অভিনন্দন জানান। ১৯৪০-এর ৪ জুলাই এক বিবৃতিতে তিনি গান্ধীকে অতীতাশ্রয়ী আর সুভাষকে বর্তমানের প্রতিভূ বলে চিত্রায়িত করেন। জাপান সরকারের সঙ্গে ধারাবাহিক টানাপোড়েনের জন্য ১৯৪৩ সালের আগে রাসবিহারী সুভাষকে জাপানে নিয়ে আসতে পারেননি।
আরও পড়ুন-পেট কেটে বের হল ৮ কেজি টিউমার
একবছর আগে যদি সুভাষকে নিয়ে আসা যেত যখন যুদ্ধে ব্রিটেনের অবস্থা আরও খারাপ ছিল এবং যদি সুভাষের নেতৃত্বে আজাদহিন্দ ফৌজের ভারত আক্রমণ ১৯৪২ -এর ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের মিলন ঘটত তাহলে ভারতের স্বাধীনতা ত্বরান্বিত হত কি না তা জল্পনার বিষয় কিন্তু তার সম্ভাবনা নিঃসন্দেহে আরও উজ্জ্বল হত।
৪ জুলাই ১৯৪৩ সিঙ্গাপুরের ক্যাথে হলে রাসবিহারী সুভাষের হাতে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির সব দায়িত্ব তুলে দেন। বাকিটা আজ ইতিহাস। ১৯৪৪-এর নভেম্বরে সুভাষ যখন নেতাজি, তখন তিনি রাসবিহারীকে দেখতে যান। রাসবিহারী তাঁকে উপদেশ দেন শত্রুর সংখ্যা না বাড়াতে এবং আমেরিকার বিরুদ্ধে রেডিও প্রচার বন্ধ করতে।
আরও পড়ুন-বাংলায় শূন্য, এবার দলের মধ্যেও শূন্য
সুভাষ তা শিরোধার্য করেন। সুভাষের আজাদ হিন্দ ফৌজের ভারত আক্রমণ পরোক্ষভাবে ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তিকে ত্বরান্বিত করে ব্রিটিশ ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর মধ্যে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে। রাসবিহারী, বাঘাযতীন ও অরবিন্দের বেঙ্গল লাইনের শেষ প্রবক্তা ছিলেন সুভাষ এবং দীর্ঘকাল পর বেঙ্গল লাইনের যে পুনরুত্থান তাঁর নেতৃত্বে ঘটেছিল তা ছিল রাসবিহারীর প্রতি তাঁর শ্রেষ্ঠ শ্রদ্ধাঞ্জলি। সুভাষ ও রাসবিহারী হলেন সংগ্রামী জাতীয়তার মালায় দুটি অগ্নিকুসুম। ‘এ তো মালা নয় গো! এ যে তোমার তরবারি। জ্বলে ওঠে আগুন যেন বজ্রহেন ভারী। এ যে তোমার তরবারি।’