বসন্তে রং লেগেছে পুরুলিয়ার আনাচেকানাচে। ফুটেছে পলাশ। ফুটেছে শিমুল। রঙিন হয়ে উঠেছে অযোধ্যা পাহাড়ও। এই মন মাতাল করা সময়ে দু’-একদিনের জন্য পুরুলিয়ায় ঘুরে এলে ভালই লাগবে। দূর হয়ে যাবে শরীর ও মনের ক্লান্তি। শুধুমাত্র প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নয়, এখানকার লোকজ সংস্কৃতি যথেষ্ট উন্নত। ছৌ নাচের সূতিকাগার এই জেলা। স্থানীয় মানুষজনের বড় প্রিয় এই নাচ। পরিবেশিত হয় পুরুলিয়ার বিভিন্ন উৎসবে, অনুষ্ঠানে। এই নাচ বাঁধা হয় মূলত পৌরাণিক কাহিনিকে কেন্দ্র করে। মুখে মুখোশ এঁটে বিচিত্র সাজে পরিবেশন করেন শিল্পীরা। থাকেন বাদ্যযন্ত্রশিল্পীরাও। মূল বাদ্যযন্ত্র সানাই, সঙ্গে ঢোল, ধামসা, খারকা, মহুরি। মূলত গ্রামগঞ্জে বসে এই নাচের আসর। তবে ছৌ নাচ আজ পুরুলিয়ার সীমা ছাড়িয়ে বিশ্বের দরবারে বিশেষভাবে জায়গা করে নিয়েছে।
আরও পড়ুন-বায়ুদূষণ রোধে উদ্যোগ
ছৌ মুখোশ তৈরি হয় বেশকিছু জায়গায়। তারমধ্যে অন্যতম পুরুলিয়ার চড়িদা। বাঘমুণ্ডি ব্লকে অযোধ্যা পাহাড়ের কোলে অবস্থিত গ্রামটি। পুরুলিয়া জেলা সদর থেকে দূরত্ব ৭২ কিলোমিটার। এই গ্রামে কয়েকশো শিল্পী ছৌ মুখোশ তৈরি করেন। পাশাপাশি আছেন কয়েকজন ছৌ নৃত্য শিল্পী। অনেকেই তাঁদের বায়না করে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিয়ে যান। সারাবছর এই গ্রামে দেখা যায় পর্যটকদের ভিড়। কেউ আসেন পুরুলিয়া বেড়িয়ে। কেউ সরাসরি। তাঁরা গ্রামটি ঘুরে দেখেন। পছন্দের মুখোশ কিনে নিয়ে যান। শীত এবং বসন্তদিনে পর্যটকের সংখ্যাটা অনেকটাই বেড়ে যায়। আপনিও বেরিয়ে পড়তে পারেন। ঘুরে দেখতে পারেন চড়িদা। বসন্তে এই গ্রাম রঙিন হয়ে উঠেছে।
চড়িদায় পা রাখার আগে থেকেই উৎফুল্ল হয়ে উঠবে মন। প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে। একটা সময় ছিল বালি-কাঁকর বিছানো লালমাটির মায়াবী পথ। এখন সেজে উঠেছে নীল-কালো পিচ রাস্তায়। দু’পাশে ফুলের শোভা দেখতে দেখতে কখন যে সময় কেটে যাবে, সেটা বোঝার উপায় থাকবে না। বসন্তে আগুন-রঙা পলাশ ও আচ্ছন্ন করে রাখার মতো মহুয়া ফুলের মাদক গন্ধ মনকে বিমোহিত করে রাখবে। পথেই পড়ে পাখি পাহাড়, মাঠা রেঞ্জ ফরেস্ট, উঁচু-নিচু টিলা ও টাড় ভূমি। মুখোশ-শিল্পীদের কাছে রঙের কদর চিরকাল। রকমারি ফুল থেকেই শিল্পীরা শিখে নেয় রং চেনার প্রাথমিক পাঠ।
আরও পড়ুন-আজ আদালতে নথি পেশ করতে চলেছেন মমতাবালা
চড়িদা পৌঁছনোর ঠিক দেড় কিলোমিটার আগে রয়েছে বাঘমুণ্ডি। এর প্রান্তসীমায় বইছে হিকিমডি নদী। যেন অনুপম সৌন্দর্য আলুথালু ছড়িয়ে রয়েছে কিনারে। প্রায় বুজে আসা, সামান্য এই অনিত্যবাহী নদীটির কাছে চিরঋণী হয়ে থাকতে হয় শিল্পীদের। কারণ এখান থেকেই তাঁরা মাটি নিয়ে যান। এই মাটি দিয়েই তৈরি হয় প্রতিমার ছাঁচ। তারপর সেই ছাঁচ ভেঙে উঠে আসে ঐতিহ্যবাহী আন্তর্জাতিক মানের মুখোশ।
বাঘমুণ্ডির রাজা মদনমোহন সিংহ দেব-এর বাড়ি থেকে চড়িদার দূরত্ব মাত্র দুই মাইল। জানা যায়, প্রায় ১৫০ বছর আগে, রাজা মদন মোহন-এর আমলে ছৌ শিল্পের সূচনা হয়। প্রায় দেড় শতাব্দী ধরে পুরুলিয়ার সঙ্গে মিশে গিয়েছে ছৌ নাচ। বাঘমুণ্ডি রাজপরিবারের দুর্গাপুজোর প্রতিমা গড়তে এসেছিলেন বর্ধমানের সূত্রধরেরা। তাঁদের মাধ্যমেই মুখোশের প্রচলন শুরু হয়েছিল।
আরও পড়ুন-চ্যালেঞ্জ নেওয়ার সাহস হল না! লেজ গুটিয়ে মুখ লুকাল ওরা?
চড়িদা গ্রামে ঢুকলে চোখের সামনে দেখতে পাওয়া যায় ছৌ মুখোশ তৈরির বহু দোকান। সাজিয়ে রাখা আছে রকমারি মুখোশ। বহু ছৌ শিল্পী একমনে তৈরি করছেন। কেউ সেই মুখোশে রং লাগাচ্ছেন। কেউ আবার মুখোশ বিক্রি করছেন নানা দামে। বিভিন্ন দেবদেবী, অসুর, রাক্ষসের মুখোশ এবং বিভিন্ন প্রাণীর মুখোশ এখানে পাওয়া যায়। ছৌ নাচের জনপ্রিয়তা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মুখোশের চাহিদাও বেড়েছে। নানাভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে রাজ্য সরকার। শুধুমাত্র ছৌ মুখোশ নয়, এখানে ঘর সাজানোর মুখোশও পাওয়া যায়। সেগুলো ছৌ মুখোশ থেকে অনেক ছোট এবং কমদামি। বিভিন্ন রকমের দাম। ৪০-৫০ টাকার মুখোশ যেমন আছে, তেমন আছে ২-৩ হাজার টাকার মুখোশ। প্রায় প্রত্যেেকটি দোকানে রয়েছে অনলাইন পেমেন্টের ব্যবস্থা।
এখানে আছে একটি সংগ্রহশালা। গেলে দেখতে পাওয়া যাবে ছৌ নাচ তথা মুখোশের ইতিহাস এবং বিভিন্ন ধরনের নামীদামি ছৌ মুখোশ। মুখোশ গ্রাম চড়িদার আশপাশে আছে বেশকিছু বেড়ানোর জায়গা। সেগুলোও ঘুরে নেওয়া যায়। সবমিলিয়ে রং খেলার দিনে পলাশের রং মেখে মুখোশ গ্রামে ঘুরতে মন্দ লাগবে না।
কীভাবে যাবেন?
পুরুলিয়ার বরাভূম স্টেশন থেকে ৩৬ কিলোমিটার দূরে চড়িদা গ্রাম। স্টেশন থেকে পাওয়া যায় গাড়ি। কলকাতা থেকে সরকারি গাড়ি নিয়েও যাওয়া যায়। পুরুলিয়ার অযোধ্যা সার্কিট ঘুরতে গেলে অতি অবশ্যই যেতে হবে এই গ্রামে।
কোথায় থাকবেন?
চড়িদা গ্রামে তেমন কোনও থাকার জায়গা নেই। তবে আশপাশে আছে কিছু হোটেল ও অতিথিশালা। এছাড়াও আছে কিছু হোম স্টে। থাকা খাওয়ার কোনও অসুবিধা হবে না।