স্টার মেকার
দারুণ মেধাবী। বিজ্ঞানের কৃতী ছাত্র। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে স্নাতক। বায়োকেমিস্ট হতে চেয়েছিলেন। অর্থনীতিতে আগ্রহ জন্মানোয় বি কমও পড়েছেন। তবে পরীক্ষা দেওয়া হয়নি। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্রের স্নেহধন্য। সাহিত্যচেতনা পেয়েছেন তাঁর অধ্যাপক সাহিত্যিক মনোজ বসুর কাছে। কিছু দিন স্কুলে করেছেন অঙ্কের শিক্ষকতা। তবে ক্লাস রুমের মধ্যে নিজেকে আটকে রাখতে চাননি। মন চাইছিল অন্য কিছু করতে। এমন কিছু কাজ, যাতে নিজেকে প্রকাশ করা যায়। খুঁজতে খুঁজতে একদিন পেয়ে গেলেন নতুন পথের সন্ধান। স্কুলের চাকরি ছেড়ে দিয়ে যোগ দিলেন কলকাতার নিউ থিয়েটার্স স্টুডিওয়। ক্যামেরাম্যান হিসেবে। এইভাবেই সিনেমার মায়াবী জগতের সঙ্গে রচিত হয় সম্পর্ক। পরবর্তী সময়ে পাড়ি দেন বোম্বাই। প্রথমে সম্পাদক, পরে পরিচালক হিসেবে নিজেকে মেলে ধরেন হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায় (Hrishikesh Mukherjee)। বোম্বাইয়ের সিনেমায় তিনি ছিলেন ‘স্টার মেকার’।
নারীকেন্দ্রিক গল্পের প্রবর্তন
১৯২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর, বিজয়াদশমীর দিন কলকাতায় জন্ম। থাকতেন ভবানীপুরে রূপচাঁদ মুখার্জি লেনে। বিমল রায়ের হাত ধরে আরব সাগরের তীরে পা রাখেন। করেন বিমল রায়ের বিখ্যাত দুটি ছবি ‘দো-বিঘা জামিন’ ও ‘দেবদাস’-এর সম্পাদনা। চাইছিলেন ছবি পরিচালনা করতে। একদিন এসে গেল সুযোগ। ‘দেবদাস’ ছবিতে পার্বতীর ভূমিকায় অভিনয় করেন সুচিত্রা সেন। হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায় (Hrishikesh Mukherjee) তাঁর পরিচালিত প্রথম ছবি ‘মুসাফির’-এ সুচিত্রাকেই নিলেন। সঙ্গে কিশোর কুমার। বলা যায় হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের হাত ধরেই হিন্দি সিনেমায় নারীকেন্দ্রিক গল্পের প্রবর্তন ঘটে।
দারোয়ান বাড়িতে ঢুকতে দেয়নি
‘আনন্দ’-এর চিত্রনাট্য-সংলাপ লেখেন গুলজার। হৃষীকেশ (Hrishikesh Mukherjee) ভেবেছিলেন, রাজ কাপুরকে নেবেন। দুজনের মধ্যে দারুণ সম্পর্ক। রাজ কাপুর তাঁকে বাবুমশাই বলে ডাকতেন। বাতের ব্যথা বাড়লে নিজে হাতে ‘হৃষীদা’র পায়ে তেল মালিশ করে দিতেন। কিন্তু সেই সময় রাজ কাপুর গুরুতর অসুস্থ। প্রায় মর-মর অবস্থা। তখন শশী কাপুরের কথা ভাবেন হৃষীকেশ। কিন্তু তাঁর ছিল সময়ের অভাব। এর পর হৃষীকেশ ঠিক করেন কিশোর কুমারকে নিয়ে ‘আনন্দ’ করবেন। দুজনের মধ্যে প্রাথমিক কথাবার্তাও হয়। একদিন হৃষীকেশ গল্পটা শোনানোর জন্য কিশোরের বাড়িতে যান। কিন্তু কিশোরের দারোয়ান হৃষীকেশকে চিনতে না পেরে বাড়িতে ঢুকতে দেয়নি। কিশোরের নির্দেশ ছিল, অচেনা বাঙালিকে বাড়িতে ঢুকতে দেবে না। যদিও এর পিছনে ছিল অন্য কারণ। এই ঘটনায় অপমানিত বোধ করেন হৃষীকেশ। তিনি কিশোরকে বাদ দিয়ে ছবিতে রাজেশ খান্নাকে নেন। ছবিতে ছিল না কিশোরের কোনও গান। যদিও পরবর্তীতে মিটে যায় ভুল বোঝাবুঝি, দুজনের সম্পর্ক আবার আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে যায়। ‘আরাধনা’র সাফল্যের পর ‘আনন্দ’ রাজেশ খান্নার অভিনয় জীবনের একটি উল্লেখ্যযোগ্য মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যায়। রাজেশ খান্না এরপর হৃষীকেশের ‘বাবুর্চি’, ‘নমক হারাম’ প্রভৃতি ছবিতে অভিনয় করেন।
আরও পড়ুন- বিজ্ঞান লিখল ইতিহাস
প্রতিভাবানদের চিনতে পারতেন
রাজেশ খান্নার পাশাপাশি অমিতাভ বচ্চন, অমল পালেকর, জয়া ভাদুড়ীদের সিনেমায় প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন হৃষীকেশ। তাঁর সঙ্গে ন’টি ছবিতে কাজ করেছেন অমিতাভ বচ্চন। ছয় ফুট দুই ইঞ্চির মহাতারকা প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন, হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায় ছিলেন তাঁর গডফাদার। প্রতিটি ছবিতেই বিগ বিকে দেখা গেছে আটপৌরে ভূমিকায়। আসলে হৃষীকেশ প্রতিভাবানদের চিনতে পারতেন খুব সহজেই। তাঁর হাত ধরেই জয়া ভাদুড়ী বোম্বাই সিনেমা জগতে পা রাখেন। ‘গুড্ডি’ ছবির মধ্যে দিয়ে। এরপর ‘বাবুর্চি’, ‘অভিমান’, ‘মিলি’, ‘চুপকে চুপকে’, ‘অভিমান’ ছবিতে হৃষীকেশের সঙ্গে কাজ করেন জয়া। প্রত্যেকটি ছবিই জনপ্রিয় হয়। এরমধ্যে কয়েকটি ছবিতে জয়াকে দেখা যায় অমিতাভ বচ্চনের বিপরীতে। জয়া-অমিতাভের ব্যক্তিগত সম্পর্কের পিছনেও ছিলেন হৃষীকেশ। অমল পালেকর অভিনীত অন্যতম সেরা ছবি ‘গোলমাল’। হৃষীকেশের পরিচালনায়।
সেন্স অব হিউমার
হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে বেশ কয়েকটি ছবিতে অভিনয় করেছেন শর্মিলা ঠাকুর। তার মধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য ‘সত্যকাম’, ‘চুপকে চুপকে’। একটি সাক্ষাৎকারে শর্মিলা জানিয়েছেন, অসাধারণ সেন্স অব হিউমার ছিল হৃষীদার। ফ্লোরে মজা করতেন। হাসিয়ে মাতিয়ে রাখতেন। মস্তিষ্ক ছিল ক্ষুরধার। সেটে আসতেন আগাম-প্রস্তুতি নিয়ে। খুব চটপট শট নিতেন। অল্প সময়ে সিনেমা তৈরি করে ফেলতেন। ওঁর টিমটাও খুব ভাল ছিল। পিকনিকের মেজাজে হত শ্যুটিং। মাইক্রোফোনে বাংলা, হিন্দি মিশিয়ে সহকারীদের নির্দেশ দিতেন। বাঙালিদের নির্দেশ দিতেন বাংলায়।
বাংলা ছবি পরিচালনা করেননি
হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের ‘মিডল অব দ্য রোড’ সিনেমার অবস্থান ছিল আর্ট ফিল্ম এবং মশালাদার বাণিজ্যিক সিনেমার মাঝামাঝি। তাঁর চলচ্চিত্র সাহিত্যের ভাষা হয়ে উঠেছিল। পরিচালক হিসেবে দর্শকদের উপহার দিয়েছেন ৪২টি ছবি। বেশিরভাগই জনপ্রিয়। শেষ ছবি ‘ঝুট বোলে কাউয়া কাটে’। অনিল কাপুর এবং জুহি চাওলা অভিনীত। চলচ্চিত্রের পাশাপাশি পরিচালনা করেছেন টেলিভিশন ধারাবাহিক। ছিলেন খাঁটি বাঙালি। বম্বেতে কার্টার রোডে ‘অনুপমা’ নামে তাঁর বিশাল বাড়িটা ফিল্মমহলে ‘বেঙ্গল লজ’ বলে খ্যাত ছিল। সিনেমার কাজে কোনও বাঙালি বোম্বাই গেলে তাঁর বাড়িতেই উঠতেন। এটা ছিল তাঁর কড়া নির্দেশ। তাঁর প্রাসাদোপম বাড়িতে হয়েছে বহু ছবির শ্যুটিং। নিয়মিত যেতেন শচীন দেব বর্মন, ঋত্বিক ঘটক প্রমুখ। জমজমাট আড্ডা হত। নিখাদ বাঙালি হলেও, জীবনে একটিও বাংলা ছবি পরিচালনা করেননি হৃষীকেশ। যদিও কয়েকটি বাংলা ছবির হিন্দি রিমেক করেছেন। কাজ করেছেন বহু বাঙালি অভিনেতা-অভিনেত্রী, গায়ক-গায়িকা, সংগীত পরিচালকের সঙ্গে।
নির্ভেজাল আনন্দ
বিমল রায়ের পাশাপাশি, সত্যজিৎ রায়কেও গুরু মানতেন। একটা সময় সত্যজিৎকে অ্যাসিস্ট করতেও চেয়েছিলেন। যদিও সেটা হয়ে ওঠেনি। শ্রেষ্ঠ পরিচালক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন হৃষীকেশ। বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবেও পেয়েছেন বিশেষ সম্মান। এ ছাড়াও পেয়েছেন দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার, পদ্মবিভূষণ সম্মান। পাশাপাশি পেয়েছেন ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড। সামলেছেন সেন্সর বোর্ডের গুরুদায়িত্ব। পরিবার অন্ত-প্রাণ মানুষটি ছিলেন একজন পশুপ্রেমী। দীর্ঘদিন ভুগেছেন কিডনির সমস্যায়। ২০০৬-এর ২৭ অগাস্ট হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ৮৩ বছর বয়সে। পালিত হচ্ছে তাঁর জন্মশতবর্ষ। পরিচালক হিসেবে তিনি তৈরি করতেন পরিচ্ছন্ন, ভদ্র সিনেমা। পর্দায় তুলে ধরতেন সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের জীবন, দিনলিপি। তাঁর প্রতিটি ছবিতে সুমধুর গান ও রুচিসম্পন্ন সাহিত্যঘেঁষা গল্পের নান্দনিক মিশেল দেখা যেত। হিন্দি চলচ্চিত্রে তিনি বুনেছেন নিখুঁত বাঙালিয়ানা। আজও টেলিভিশনের পর্দায় তাঁর ছবি এলে দর্শকেরা বিপুল আগ্রহ নিয়ে বসে পড়েন। নির্ভেজাল আনন্দ পান। অমিতাভ বচ্চন বলেছেন, ‘হৃষীদা যে ধরনের ছবি বানাতেন, তেমন ছবি এখন আর কেউ করেন না। খুব মিস করি সেই সব ছবিগুলো।’