কথামুখ
বাঙালি সমাজজীবনে বৈষ্ণবীয় জীবনযাত্রা যেন রোম্যান্সের শেষ আশ্রয়স্থল। বৈষ্ণবের স্বচ্ছন্দ প্রণয়লীলা, ললিতকলায় অনুরাগ, স্বভাবগত ঔদার্য ও মহাপ্রভুর ধর্মের অনুপ্রেরণায় সত্যিকারের চরিত্র গৌরব— হিন্দু সমাজের বৈচিত্র্যহীন গতানুগতিকতার মধ্যে খানিক স্বাতন্ত্রের হেতু হয়েছে। তাই তো দেখি বয়সের বিস্তর ফারাক থাকা সত্ত্বেও রসিকদাসের সঙ্গে রাইকমলের মালাবদল হয়েছে। যদিও গানে আর মাধুকরীতে দীর্ঘদিন কাটানোর পর আসক্তিও বৈরাগ্য, পার্থিব ও ঐশীপ্রেমের অবিশ্রান্ত অন্তর্দ্বন্দ্বে রসিক ও কমল দুজনেই শ্রান্ত হয়ে পড়েছে। আত্মগ্লানি রসিক দাসেরই বেশি, বন্ধন ছিন্ন করার প্রথম প্রেরণা তাঁর দিক থেকে এসেছে। রাইকমলের জীবনে এবার এসেছে রঞ্জন। এই প্রতীক্ষিত মিলনের ফলে কমলের জীবনে এক নতুন পরিণতি নিয়ে আস। তবু ঝুলন রাস-দোলের মধুর স্মৃতি সুরভিত উচ্ছ্বাসে অনিবার্যভাবে ভাটার টান এসে পড়েছে। যে উপন্যাস নিয়ে প্রস্তাবনা, সেটি তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘রাইকমল’। পরিচালক সুবোধ মিত্র ছবি নির্মাণের সময় নতুন একটি মুখ খুজঁছিলেন রাইকমল চরিত্রে অভিনয় করানোর জন্য। কারণ চরিত্রটি দুরূহ। প্রখ্যাত অভিনেতা পাহাড়ী সান্যাল ছিলেন যাদবেন্দ্র বসুর বাড়ির পারিবারিক বন্ধু। তিনি যাদবেন্দ্রবাবুর মেয়ে কাবেরীর সঙ্গে যোগাযোগ করালেন পরিচালক সুবোধ মিত্রের। পরিচালক নবাগতা নায়িকা কাবেরী বসুকেই রাইকমল চরিত্রে নির্বাচন করলেন। পাশে দুই বিখ্যাত নট। রসিকদাসের চরিত্রে নীতীশ মুখোপাধ্যায়, রঞ্জনের চরিত্রে উত্তমকুমার। দর্শক-সমালোচকেরা কাবেরীর অভিনয় দেখে মুগ্ধ হলেন। কমলের লিপের গানগুলি গাইলেন গীতশ্রী ছবি বন্দ্যোপাধ্যায় ।
আরও পড়ুন-আর একা নও তুমি
জন্মকথা
কাবেরী বসুর জন্ম ১৯৩৮ সালের ২৮ মার্চ কলকাতায়। তাঁর বাবা যাদবেন্দ্র বসু। মা প্রীতিময়ী দেবী। চিত্রনির্মাতা সাহিত্যিক গৌরাঙ্গপ্রসাদ বসু ছিলেন কাবেরীর দাদা। কাবেরী ১৯৫৪ সালে বেলতলা গার্লস স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। কাবেরীর ছবিতে কাজ করতে করতেই বিয়ে হয় অজিত চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। স্বামীর সঙ্গে কর্মস্থলে চলে যান বিহারের মুঙ্গেরে। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিকে বাই-বাই করলেন। আবার ফিরলেন সত্যজিৎ রায়ের ডাকে। ১৯৭০ সালের ১২ জুন দার্জিলিং থেকে ফেরার পথে ৮৫০ ফুট নিচে পড়ে যায় তাঁদের জিপগাড়ি। এই ঘটনায় মারা যান তাঁর স্বামী অজিত চট্টোপাধ্যায় ও ছোট মেয়ে টিনা। তিনি গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী ছিলেন।
আরও পড়ুন-শৈলবালা ঘোষজায়া, এক বিস্মৃত কলম-বিপ্লবী
চলচ্চিত্রকর্ম
কাবেরী বসুর অসাধারণ অভিনয় নৈপুণ্য রয়েছে সত্যজিৎ রায় পরিচালিত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাহিনি অবলম্বনে নির্মিত ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ ছবিতে। প্রবাসী বাঙালির (পাহাড়ি সান্যাল) বিধবা পুত্রবধূ জয়ার অতৃপ্ত যৌনতৃষ্ণাকে বাঙ্ময় করে তুলেছিলেন কাবেরী। গল্পের চার বন্ধু অসীম (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়), সঞ্জয় (শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়), শেখর (রবি ঘোষ), শমিত ভঞ্জ (হরি)। এঁদের মধ্যে একজনকে কাবেরীর মনে ধরে যায়। প্রকাশের পথ নেই। তিনি সঞ্জয়। দুচোখ ভরে দেখার মতো অভিনয়। আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের কাহিনি অবলম্বনে নির্মিত মঙ্গল চক্রবর্তী পরিচালিত ‘আমি সে ও সখা’ ছবিতে কাবেরী হলেন চন্দ্রাণী। বিপরীতে সুধীর চরিত্রে রয়েছেন উত্তমকুমার। স্বামী হিসেবে অনিল চট্টোপাধ্যায়। অভিনয় দেখানোর সুযোগ হাতছাড়া করেননি কাবেরী। হৈমন্তী শুক্লার গাওয়া ‘এমন স্বপ্ন কখনো দেখিনি আমি’ গানটি শ্রোতাদের বিহ্বল করে তোলে। দুরন্ত অভিনয় করলেন কাবেরী ‘নগর দর্পণে’ ছবিতে। কাহিনিকার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। পরিচালক যাত্রিক। অনুপমের (উত্তমকুমার) স্ত্রীর চরিত্রে তিনি। স্ত্রীর নাম শ্রীলেখা। মানসিক ভারসাম্যহীন স্বামীকে দেখেই কাবেরীর অভিব্যক্তি শিল্পীর জাত চিনিয়ে দেয়। এ ছবিতে প্রচুর শিল্পী (সুপ্রিয়া, দিলীপ মুখোপাধ্যায়, নন্দিতা বসু, ছায়াদেবী, হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায়)। তবু উত্তম-কাবেরী জুটি দর্শকদের টানল।
আরও পড়ুন-দুই সংগ্রামী মহিলা চিকিৎসক
অগ্রগামী পরিচালিত ‘যে যেখানে দাঁড়িয়ে’ ছবির কাহিনিকার রমাপদ চৌধুরি। নায়িকা কাবেরী বসু। সঙ্গে ছিলেন দীপঙ্কর দে, মহুয়া রায়চৌধুরি, এন বিশ্বনাথন প্রমুখ শিল্পী। জনপ্রিয় ‘শ্যামলী’ নাটকের কাহিনি অনুরূপা দেবীর। চলচ্চিত্রে শুধু চোখের ভাষায় যে অভিনয় দেখালেন কাবেরী সেটি মনে রাখার মতো। বিপরীতে তাঁর স্বামী অনিলের চরিত্রে উত্তমকুমার। পরিচালক নীরেন লাহিড়ীর একাধিক ছবিতে কাবেরী নায়িকা। প্রথমটি হল দেবীমালিনী। নামভূমিকাতেই তিনি। বিপরীতে বসন্ত চৌধুরি। ‘শঙ্করনারায়ণ ব্যাংক’ সেখানে নায়ক গৌতমের চরিত্রে উত্তমকুমার, মীনার চরিত্রে কাবেরী বসু। ‘মধুমালতী’ ছবিতে কাবেরীর বিপরীতে বসন্ত চৌধুরি। মধু বসু পরিচালিত ‘পরাধীন’ ছবিতে তাঁর বিপরীতে নির্মলকুমার। চিত্ত বসু পরিচালিত ‘দৃষ্টিতে’ও কাবেরীর বিপরীতে নায়ক নির্মলকুমার। গানগুলির শিল্পী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। রতন বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত ছবিটি গানে গানে ভরা। পাঁচজন সুরকার এ ছবিতে (নচিকেতা ঘোষ, ভূপেন হাজারিকা, অনুপম ঘটক, দুর্গা সেন, অনিল বাগচী)। বিপরীতে নায়ক হলেন প্রবীরকুমার।
আরও পড়ুন-রথযাত্রা
পরপারে যাত্রা
পাকস্থলীতে ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হলেন কাবেরী বসু। দীর্ঘদিন ভুগলেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। ১৯৭৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি কাবেরী বসু পরলোক গমন করলেন। তখন তাঁর বয়স চল্লিশও স্পর্শ করেনি। কাবেরী বসু বিরতি-সহ মাত্র বারোটি ছবিতে নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করে, দর্শকচিত্তে চিরদিনের জন্য স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন।