দুই সংগ্রামী মহিলা চিকিৎসক

মহিলা চিকিৎসক হিসেবে কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের কথা সবাই জানি। কিন্তু আরও দুই মহিলা চিকিৎসক আনন্দীবাই এবং রুকমাবাই খুব বেশি আলোচিত হন না। গতকাল ছিল ১ জুলাই, চিকিৎসকদিবস। দিনটিকে মনে রেখে এই দুই মহিলা চিকিৎসকের জীবনসংগ্রামের কথা তুলে ধরলেন অংশুমান চক্রবর্তী

Must read

আনন্দীবাই
মাত্র ৯ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল যমুনার। ১৪ বছর বয়সে মা। কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারেননি নবজাতককে। চোখের সামনে সন্তানের মৃত্যু দেখে জেদ চেপে যায় যমুনার…
যদিও তখন আর তিনি যমুনা নন, আনন্দী, আনন্দীবাই গোপাল রাও জোশি। বিয়ের পরেই তাঁর এই নামকরণ। জন্মেছিলেন মহারাষ্ট্রের ঠানে জেলার কল্যাণে। ১৮৬৫ সালের ৩১ মার্চ।
কী জেদ চেপে যায় তাঁর? ডাক্তারি পড়বেন। সেবা করবেন সাধারণ মানুষের। যাতে কোনও মায়ের কোল আর শূন্য হয়ে না যায়।
আনন্দীর পাশে দাঁড়ালেন স্বামী গোপাল রাও। তিনি ছিলেন ডাক বিভাগের কর্মী। দুজনের বয়সের ব্যবধান অনেকটাই। ছিল পারস্পরিক ভালবাসার সম্পর্ক।

আরও পড়ুন-রথযাত্রা

সামান্য মরাঠি পড়তে পারতেন আনন্দী। শুরু হল তাঁর সংস্কৃত শিক্ষা। গোপাল রাও স্ত্রীর পড়াশোনার খুঁটিনাটি খেয়াল রাখতেন। পড়াশোনায় ফাঁকি দিলে মেজাজ হারিয়ে ফেলতেন। কখনও কখনও তুলতেন গায়ে হাত। এই সব দেখে বাইরের লোকেরা নানারকম কথা বলতেন। গোপাল রাও বিন্দুমাত্র পাত্তা দিতেন না। তাঁর ছিল একটাই লক্ষ্য, স্ত্রীকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে।
বেশ কয়েক বছর পর একদিন গোপাল রাও মার্কিন মিশনারি ওয়াইল্ডারকে চিঠি লিখে বসলেন। সাহায্য চাইলেন আনন্দীর পড়াশোনার জন্য। প্রায় দুই বছর পরে ১৮৭৮ সালের ১৪ জুন রেভারেন্ড ওয়াইল্ডারকে লেখা গোপাল রাওয়ের চিঠি ক্রিশ্চিয়ান রিভিউ পত্রিকায় ছাপা হল। সেই চিঠি নজরে আসে নিউ জার্সির থিয়ো কার্পেন্টার নামে এক মার্কিন মহিলার। শিক্ষালাভের ব্যাপারে আনন্দীর আগ্রহ এবং স্ত্রীকে গোপাল রাওয়ের উৎসাহ দান তাঁকে মুগ্ধ করে। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন থিয়ো কার্পেন্টার। এরপর নারী স্বাধীনতা, বাল্যবিবাহের কুফল ইত্যাদি বিষয়ে তাঁর সঙ্গে আনন্দীর চিঠিপত্র আদানপ্রদান হতে থাকে।

আরও পড়ুন-উদয়পুর হত্যাকাণ্ড: একসঙ্গে বদলি ৩২ জন পুলিশ আধিকারিক

স্ত্রীর সঙ্গে আমেরিকা যেতে চাইলেন গোপাল রাও। যখন প্রায় সমস্তকিছু চূড়ান্ত, সেইসময় গোপাল রাওকে শ্রীরামপুরে বদলি করা হয়। তখন কলকাতা থেকে একাই আমেরিকা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন আনন্দী।
জানা যায়, তখনকার রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ আনন্দীর বিদেশযাত্রার বিরোধিতা করেছিল। শ্রীরামপুরের একটি সভায় আনন্দী জানিয়েছিলেন, কেন তিনি আমেরিকায় চিকিৎসা-বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করতে চান।
সমস্ত বিরোধিতা দু-পাশে সরিয়ে তিনি ১৮৮৩ সালের ৭ এপ্রিল চিকিৎসা-বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য কলকাতা থেকে নিউ ইয়র্ক শহরের উদ্দেশ্যে রওনা হন। ভাসতে শুরু করে জাহাজ। একবুক স্বপ্ন তখন আনন্দীর বুকে।

আরও পড়ুন-দু’বছর পর মহাসমারোহে মাহেশের ঐতিহাসিক রথযাত্রা পালন

১৮৮৩ সালের জুন মাসে আনন্দী নিউ ইয়র্ক পৌঁছন। আমেরিকা দুহাত বাড়িয়ে আনন্দীকে স্বাগত জানায়। সব রকমের সাহায্য করেছিলেন থিয়ো কার্পেন্টার। তাঁর ব্যবস্থাপনায় আনন্দী ভর্তি হতে পেরেছিলেন উইমেন’স মেডিক্যাল কলেজ অব পেনসিলভ্যানিয়ায়। কলেজের অধ্যক্ষা র‍্যাচেল বডলের সাহায্যে পেয়ে যান একটি বৃত্তি।
পড়াশোনার ফাঁকে আনন্দী আক্রান্ত হয়েছিলেন যক্ষ্মায়। কিন্তু কোনও কিছুই দমাতে পারেনি তাঁকে। ১৮৮৬ সালের ১১ মার্চ উত্তীর্ণ হলেন ডাক্তারি পরীক্ষায়। ভারতের প্রথম মহিলা হিসেবে। ইংল্যান্ডের রানি ভিক্টোরিয়া তাঁকে জানালেন অভিনন্দন।
দেশে ফিরে কোলহাপুরের অ্যালবার্ট এডওয়ার্ড হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে যোগদান করেন। সেখানে এক বছর চাকরি। তারপর আবার যক্ষ্মায় আক্রান্ত হন। কালাপানি পেরিয়ে আসার জন্য আনন্দীকে তাঁর সহকর্মী এবং অন্যন্য চিকিৎসকেরা চিকিৎসা করতে অস্বীকার করেন।
বিনা চিকিৎসায় ১৮৮৭ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি রাত দশটায় আনন্দীর মৃত্যু হয়।

আরও পড়ুন-মণিপুরে ধসে মৃত্যু দার্জিলিংয়ের ৯ জওয়ানের, শোকপ্রকাশ মুখ্যমন্ত্রীর

অল্প সময়ের মধ্যে তিনি চিকিৎসায় যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছিলেন। বাল গঙ্গাধর তিলকের মতো ব্যক্তিত্ব তাঁর ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন।
তিনি আজ নেই। তবে দেশের অগণিত মহিলার কাছে আজ তিনি আদর্শ। আজও বহু মানুষ তাঁর জীবনসংগ্রামের কথা বিনম্রচিত্তে স্মরণ করেন।
রুকমাবাই
বিয়ের পর মেয়েরা শ্বশুরবাড়ি যাবে, এটাই রেওয়াজ। যুগযুগ ধরে চলে আসছে এই প্রথা। তবে কেউ কেউ অস্বীকার করেন এই প্রথাকে। তাঁরা বাপের বাড়ি ছেড়ে শ্বশুরবাড়ি যেতে চান না। ফলে রাখতে হয় ঘরজামাই।
এমনটাই ঘটিয়েছিলেন রুকমাবাই। ৯ বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয়। বিয়ের আগে তিনি শর্ত দিয়েছিলেন, শ্বশুর বাড়ি যাব না। নিজের বাড়িতে থাকব। স্বামী থাকবেন ঘরজামাই। স্বামী দাদাজি ভিকাজি বাধ্য হয়ে রাজি হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন রুকমাবাইয়ের সৎ বাবা ডাক্তার সখারাম অর্জুনের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। রুকমাবাইয়ের বাবা জনার্দন পান্ডুরং খুব কম বয়সে মারা যান। বাধ্য হয়ে রুকমাবাইয়ের মা জয়ন্তীবাই দ্বিতীয় বিয়ে করেন।

আরও পড়ুন-বিধানসভায় বিধান রায়ের জন্মদিবস পালন: গরহাজির বিজেপি, কটাক্ষ অধ্যক্ষের

সখারাম অর্জুনের বিশেষ স্নেহ করতেন রুকমাবাইকে। স্ত্রীশিক্ষায় পক্ষপাত ছিল তাঁর। বিশ্বাস করতেন নারীস্বাধীনতায়। মেয়েকে শিখিয়েছিলেন লেখাপড়া। ফ্রি মিশনারি চার্চের সহযোগিতায়।
দাদাজি ভিকাজি একবছর ঘরজামাই ছিলেন। তারপর চলে যান নিজের ঘরে। একটা সময় রুকমাবাইকে শ্বশুরবাড়ি আসার জন্য জোরাজুরি করতে থাকেন।
বেঁকে বসেন রুকমাবাই। তখন তাঁর বয়স ১১। তিনি বলেন, শর্ত লঙ্ঘিত হয়েছে। শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
মেয়ের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন মা। কিন্তু বাবা ডাক্তার অর্জুন মেয়ের পাশে দাঁড়ান। তৈরি হয় আইনি জটিলতা।
তিন বছর শুনানি চলে বম্বে হাইকোর্টে। ১৮৮৮ সাল। হিন্দু আইন অনুসারেই শোনানো হয় ফয়সালা— রুকমাবাইকে স্বামীর কাছে যেতে হবে। নয়তো ৬ মাসের কারাদণ্ড।

আরও পড়ুন-রথযাত্রা উপলক্ষ্যে শুভেচ্ছা মুখ্যমন্ত্রীর

হাসিমুখে কারাদণ্ড মেনে নেন রুকমাবাই। যাননি শ্বশুরবাড়ি। তাঁর এই লড়াইয়ে শেষপর্যন্ত পাশে ছিলেন বাবা এবং কয়েকজন। তারপর?
১৮৮৯ সালে জেল থেকে মুক্তি পান রুকমাবাই। শুরু করেন নতুন জীবন। স্বপ্ন দেখেন ডাক্তার হবেন। সেই বছরই ডাক্তারি পড়ার জন্য করেন বিলেতযাত্রা। সেখানে সসম্মানে ডাক্তারি পরীক্ষায় পাশ করে দেশে ফিরে আসেন। যোগ দেন ব্রিটিশ ইন্ডিয়া মেডিক্যাল সার্ভিসে। ১৯২৯ সাল পর্যন্ত মহিলা চিকিৎসক হিসেবে রাজকোট অঞ্চলে মানুষের সেবার কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন।
১৮৬৪-র ২২ নভেম্বর মারাঠি পরিবারে জন্মগ্রহণ। ১৯৫৫-র ২৫ সেপ্টেম্বর ৯০ বছর বয়সে প্রয়াত। চিকিৎসক এবং নারীবাদী হিসেবে রুকমাবাইয়ের সংগ্রাম কারও পক্ষেই ভোলা সম্ভব নয়।

Latest article