মুসলমান থেকে গণআন্দোলন সবকিছুই গুঁড়িয়ে দিতে বুলডোজার চালাচ্ছেন মোদি

ভারতে গণতন্ত্রের স্থানাভিষিক্ত হচ্ছে বুলডোজার তন্ত্র। সংখ্যালঘু থেকে প্রতিবাদী, সবাইকে ভয়ার্ত করে তুলতে বুলডোজারের জবাব নেই। মৌলিক অধিকার গুঁড়িয়ে দিতেও বুলডোজারের জুড়ি মেলা ভার। ন্যাচারাল জাস্টিস চুরমার করে দিতে বুলডোজার বিকল্পহীন। দমনমূলক সরকারের পীড়নমূলক হাতিয়ার বুলডোজার। লিখছেন রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু

Must read

ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও। ওরা বেআইনি বসতি স্থাপন করেছে। ওরা দাঙ্গা লাগানোর দোষে দোষী, ওদের দোকান, ঝুপড়ি, বাড়ি-ঘর ভেঙে মিশিয়ে দাও পথের ধুলোয়। লুট করো ওদের সবকিছু। কারণ ওরা মুসলিম। ওরা বিদেশি। ওরা পাকিস্তানি, ওরা দেশের শত্রু। ওরা বিদেশি।
হ্যাঁ, এভাবেই ২১ এপ্রিল ২০২২ উত্তর-পশ্চিম দিল্লির জাহাঙ্গিরপুরীতে পুলিশ বাহিনীর তত্ত্বাবধানে বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হল বাড়ি-ঘর, ছোট দোকান এবং মসজিদের প্রবেশদ্বার। ভাঙাভাঙি শুরু হওয়ার পরপরই সুপ্রিম কোর্ট এই অপকর্মে স্থগিতাদেশ জারি করে। এর পরেও প্রায় একঘণ্টা ধরে চলে এই ধ্বংস-অভিযান।

আরও পড়ুন-গেরুয়া সন্ত্রাসের আবহে ত্রিপুরার উপনির্বাচনের প্রস্তুতি তুঙ্গে

এরপর মধ্যপ্রদেশের খারগনে এবং গুজরাতের খাম্বাতে রামনবমীর মিছিলকে কেন্দ্র করে দাঙ্গার পরিস্থিতি তৈরি হলে রাষ্ট্রীয় আদেশে মুসলিমদের দাঙ্গাকারী আখ্যা দিয়ে শুরুহল বুলডোজার কাণ্ড। ২১ মে বুলডোজার গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে অসমের নওগাঁ জেলার বটদ্রব্য গ্রামের সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি। পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু হয় সাফিকুল ইসলামের। প্রতিবাদে আক্রান্ত হয় থানা। কোনওরকম আইনি পথ না নিয়েই অভিযুক্তদের বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। অভিযোগ প্রমাণের বালাই নেই। আইনের শাসন বলে কিছু নেই-এমন অবস্থা।
রাষ্ট্র ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে দাঙ্গা-বিধ্বস্ত অঞ্চলের মুসলিম বসতিকে লক্ষ্য করে বুলডোজার চালানোর ঘটনায় গুরুত্বপূর্ণ আইনি প্রশ্ন উঠতে থাকে। আইনি প্রক্রিয়াকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, চালু বিচারবিভাগীয় রায়গুলিকে অস্বীকার করে মধ্যযুগীয় মানসিকতায় জোর যার মুলুক তার জঙ্গল-নীতির বশবর্তী হয়ে যে বুলডোজার রাজনীতির আমদানি তা আইনের শাসন এবং সাংবিধানিক ন্যায়-নীতির বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষণা। যা সর্বৈব নিন্দনীয় তাই একথা স্পষ্ট ভাষায় বলা যায় যে, বুলডোজার এখন পাশব-রাষ্ট্রশক্তির এক নতুন প্রতীকে পরিণত হয়েছে। এর দ্বারা কেবল বাড়ি ও দোকানঘরগুলিই ভাঙা হচ্ছে না, ভাঙা হচ্ছে আইনের শাসন এবং সাংবিধানিক নির্দেশাবলিকেও। কায়েম হচ্ছে এক জঙ্গলের রাজত্ব। যার মূলে রয়েছে এক ধর্মান্ধ রাজনীতি। সভ্য সমাজে বহুকাল আগেই যা বাতিল হয়েছে।

আরও পড়ুন-পাউরুটিতে কম ওজন দিয়ে জনসাধারণকে ঠকানোর প্রতিবাদে কড়া পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানান মানস ভুঁইয়া

অথচ সংশোধিত নাগরিক আইনের বিরুদ্ধে যখন উত্তরপ্রদেশে কেন্দ্রীয় সরকার বিরোধী আন্দোলনকারীদের শায়েস্তা করতে তাঁদের বাড়িঘর ভেঙে দেওয়ার নিন্দনীয় কাজ শুরু করেন। তিনি নতুন আইন তৈরি করেন। তিনি নতুন আইন তৈরি করেন। গুন্ডা সমাজবিরোধীদের শাসন করার নামে মুম্বইয়ের কুখ্যাত ‘এনকাউন্টার’-কার্যক্রম গ্রহণ করে অভিযোগ প্রমাণের আগেই অভিযুক্তিদের হত্যা করার পথ নেন। এই মহান কীর্তিমান আইনের শাসনকে প্রহসনে পরিণত করেছেন। চলছে এক বাহুবলী রাজত্ব। আজ আক্রান্ত হচ্ছে ‘ন্যচারাল জাস্টিস’-এর নীতি। বাসস্থানের অধিকার, নাগরিকের মৌলিক অধিকার। উচ্ছেদের বিরুদ্ধে সুরক্ষার ব্যবস্থা দিয়েছে আইন এবং বিচারালয়। জবরদস্তিমূলক এবং অঘোষিত উচ্ছেদ বেআইনি একথা শাসকরা জানেন না, এমন হতে পারে না। তাঁরা আসলে আইন, সংবিধান, ন্যায়বিচারের তোয়াক্কা করেন না। তাঁরা যা মনে করবেন, সেটাই আইন। এ যেন প্রজাতন্ত্রের বদলে এক রাজতন্ত্রের করালগ্রাসে নষ্ট হচ্ছে গণতন্ত্র, নষ্ট হচ্ছে ভারত শাসনের সংবিধান। রাজার শাসনে যা সম্ভব, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তা যে সম্ভব নয়— নরেন্দ্র মোদির সরকার সেটাই অস্বীকার করছে।

আরও পড়ুন-তিলজলা ট্রাফিক গার্ডের তৎপরতায় মহিলার সঙ্গে কুরুচিকর ব্যবহারের পর পালানোর আগে জালে অভিযুক্ত

গণআন্দোলন, অত্যাচারী সরকারকে সংযত করে। সরকার বিরোধী আন্দোলন কখনও হিংসাশ্রয়ী হয়ে ওঠে। রাষ্ট্র ও দমন-পীড়নের মাধ্যমে হিংসা বন্ধ করার চেষ্টা করে। যুগ যুগ ধরে এ-রকমটাই চলে আসছে। তার মধ্যেই গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্ম। যা হিংসাকে প্রশ্রয় দেয় না। সে দিক থেকে রাষ্ট্রীয়-হিংসারও বিরোধিতা করে গণতান্ত্রিক শক্তি। একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কেউ আন্দোলন করতে পারবে না, জনবিরোধী সরকারি নীতির বিরুদ্ধে কিছু বলা যাবে না। এমনটা হতে পারে না। রাষ্ট্রীয় হিংসা কখনও কখনও গণহিংসার জন্ম দেয়। সেই গণহিংসা যাতে ভয়াল আকার না নেয়, রাষ্ট্রকে তার জন্য সংযত হয়ে হয়।
যতই বুলডোজার চালাও, যতই মারো—অগ্নিপথের অগ্নুৎপাত কি বন্ধ করতে পারছে মোদি-যোগীর সরকার। মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের উদগীরণ যখন হবে, তখন রাষ্ট্রশক্তি পালাবার পথ পায় না। রাজ্যে রাজ্যে যে আগুন জ্বলছে, তা থামাতে সরকারকে পিছু হটতে হচ্ছে। এখানে আর বুলডোজার কাজ করবে না। বুলডোজার আজ সংখ্যালঘুদের ভয় দেখানোর ক্ষেত্রে একটা প্রতীক হয়ে উঠছে। অভিযুক্তদের শায়েস্তা করার নাম করে একটা সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে চলছে এই ধ্বংসাতত্মক বুলডোজার অভিযান। এটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। স্বাভাবিক ন্যায়বিচারের দৃষ্টিতে এ-এক চরম অন্যায়। অমানবিক।

আরও পড়ুন-জলমগ্ন ত্রিপুরা, পরিস্থিতি ক্রমশ অসহায়তার দিকে যাচ্ছে, পাশে নেই কোন নেতা

আজ বুলডোজার-রাষ্ট্র তার ভয়ঙ্কর কর্মকাণ্ডে কিছু মানুষের সমর্থন পাচ্ছ। এটা উদ্বেগের বিষয়। রাষ্ট্র তার ক্ষমতা দেখাচ্ছে। জনশক্তির ক্ষমতা কী, আগামী দিনে বর্তমান রাষ্ট্র-নেতারা তা টের পাবেন। মোদির, ‘মোদিত্ব’ ঘুচে যাবে। আমরা বুলডোজার-রাষ্ট্র চাই না। কল্যাণকর রাষ্ট্র চাই। মানুষের খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের সুরক্ষা চাই। আমরা রাজতন্ত্র চাই না, চাই গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র।

Latest article