মণিপুর যখন রক্তাক্ত, চতুর্দিকে আগুন জ্বলছে, দেশের প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তখন কর্নাটকের ভোট-প্রচার নিয়েই ব্যস্ত। আগে মণিপুর না আগে ভোট— সেই প্রশ্নে সত্যিই এক বিসদৃশ অগ্রাধিকার-বোধ। দুই মহাশক্তিধরের কাছে ভোটই আগে। মানুষ মরে মরুক। জ্বলুক আগুন। অগ্রাধিকার নিয়ে ন্যায্য প্রশ্ন উঠলেও, তা গ্রাহ্য করারও প্রয়োজন বোধ করেননি দিল্লিশ্বরেরা। মণিপুরের ঘটনাবলির সময় তাঁদের এই আচরণ অত্যন্ত অস্বাভাবিক ভাবে প্রকট হয়েছে। তবে এ-কথাও বলার দরকার যে সরকারি রথী-মহারথীরা স্বাভাবিক সময়েও নির্বাচনী প্রচারের আতিশয্যে ভেসে যান। ভোট প্রচারের মাত্রাতিরিক্ত দৌড়ঝাঁপ দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। এক্ষেত্রে নরেন্দ্র মোদির জুড়ি মেলা ভার। কর্নাটকের ভোট প্রচারের দৃশ্যাবলি কোনও ভাবেই ব্যতিক্রমী নয়। বাস্তবে উত্তরপ্রদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গ— সর্বত্র ভোটের মরশুমে পাত্রমিত্র-সহ তিনি যেভাবে দাপিয়ে বেড়ান, তা দেখে মনে হয় আগের দিনের রাজা-বাদশাহদের রাজ্যজয়ের যুদ্ধ অভিযানের কথা। রাজ্য-শাসন অপেক্ষা যুদ্ধজয়ের জন্যই তাঁদের অধিক সময় ব্যয় করতে হত। ভোট-যুদ্ধও যেন অনেকটা সেই প্রকারের, অন্তত নরেন্দ্র মোদির কাছে।
আরও পড়ুন-বিজেপির ডাকাতদের ক্ষমতায় আনবেন না
ভোট প্রচারে গণতান্ত্রিক রীতি মেনে ভোটপ্রার্থীর পরিচয় এবং দলের নীতি ও কর্মসূচি ব্যাখ্যা করা এবং শাসক দলের ক্ষেত্রে নিজেদের সাফল্য ও ব্যর্থতার খতিয়ান পেশ করাই হল নির্বাচনী প্রচারের লক্ষ্য। এটাই তো হওয়া উচিত। সেই অনুসারেই মানুষ ভোট দেবেন। কিন্তু এখন ভোট মানেই হল রোডশো মহাসমারোহে সবথেকে ব্যস্ত নরেন্দ্র মোদি, তাই মণিপুর নিয়ে তিনি নীরব। কর্নাটকের অবস্থা খারাপ। তাই তাঁকেই বেশি দায়িত্ব নিতে হবে। অন্য কিছু নিয়ে ভাবার সময় নেই। উল্লেখ্য যে, মণিপুরের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল নানা সময়ে দেশের খবরের শিরোনামে চলে আসার বিশেষ ইতিহাস। বিদ্রোহ ও ক্ষোভ-বিক্ষোভের নানা ঘটনার ঐতিহ্য রয়েছে সে ইতিহাসে। আর এ-কথাও ঠিক দেশের উত্তর-পূর্ব প্রান্তের সমাজগুলির প্রতি জাতীয়স্তরে দীর্ঘ অবজ্ঞা ও অবহেলা এখনও বজায় আছে। সম্প্রতি মণিপুরের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ আবারও সে-কথাই বলে দিচ্ছে। ‘দেখামাত্র গুলির আদেশ’ দেওয়া হয়েছে। এটা স্পষ্ট বোঝা যায় মণিপুরে যে সংঘর্ষ চলছে, তা খুব সহজে সমাধান করে ফেলা যাবে— বিষয়টা এমনও নয়। এই সমস্যা হঠাৎ করে তৈরি হয়নি। সমস্যার জট অনেক গভীরে, তা না হলে এরকম উত্তাল ও রক্তাক্ত সংঘর্ষ ঘটতে পারত না। এ-কথাও বলা দরকার যে, রাজ্য ও কেন্দ্র উভয়কেই এর দায়িত্ব নিতে হবে। ঘটনার গতিপ্রকৃতি এ-কথাই বলে যে, সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করলে ঘটনা এরকম ভয়াবহ হত না।
আরও পড়ুন-অ্যাম্বুল্যান্স নিয়ে নোংরা রাজনীতি বিরোধীদের
বর্তমান সমস্যার শুরু মেইতেই জনগোষ্ঠীকে জনজাতি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টিকে কেন্দ্র করে মেইতেই মণিপুরের সংখ্যাগরিষ্ঠ গোষ্ঠী, প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষ তার অন্তর্ভুক্ত। এতদিন কুকি ও নাগারা জনজাতি হিসাবে গণ্য হলেও মেইতেই-রা ছিল তার বাইরে। এ-নিয়ে মেইতেইরা দীর্ঘকাল ধরে ক্ষুব্ধ ছিল। এখন তারা জনজাতির মর্যাদা পেল। ফলে বাকি জনগোষ্ঠীরা এতে প্রচণ্ড রুষ্ট হল। তারা ভাবতে শুরু করল, তাদের জন্য সংরক্ষিত জায়গায় এ-বার মেইতেই-রাও ভাগ বসাতে আসছে। আর জমি, চাকরি, শিক্ষা ও পারিপারিক নিরাপত্তা— ইত্যাদি সব কিছুই সংরক্ষণের আওতায় রয়েছে। সুতরাং, মণিপুরি সমাজের এক বড় অংশ প্রবল ভাবে বেঁকে বসেছে। তাদের বক্তব্য, কোনও মতেই মেইতেই-দের জনজাতি হিসাবে স্বীকৃতি সে-রাজ্যে তারা মানবে না। এরই ফলে শ’খানেক মানুষের মৃত্যু ও বহু মানুষের বিপন্নতা নেমে এসেছে মণিপুরে। এ-সমস্যা যথেষ্ট জটিল। সমস্যার প্রতি প্রশাসনিক ধারণা অতিসরল, যা ক্ষমার অযোগ্য। কারণ জনজাতি মর্যাদার বিষয়টিকে সংরক্ষণ নীতির সঙ্গে যুক্ত করে না দেখার কোনও উপায় নেই। যদি মেইতেই-দের জনজাতির স্বীকৃতি দেওয়া আবশ্যিক হয়, সেক্ষেত্রে অন্যান্য গোষ্ঠীর মতৈক্য তৈরি কারার উদ্যেগটি অত্যন্ত জরুরি ছিল। মতৈক্য গঠন প্রক্রিয়া সহজ না হতে পারে, কিন্তু তা বলে মতৈক্য তৈরির দিকে না এগোনো কোনও সমাধান হতে পারে না। উপর থেকে এভাবে চাপিয়ে দেওয়ার এই প্রশাসনিক প্রবণতার কারণেই এত বড় রক্তাক্তসংঘর্ষের পরিস্থিতি তৈরি হল। এর পরেও কেন্দ্রীয় সরকার এখন যে-ভাবে পরিস্থিতির মোকাবিলা করছে তার মধ্যেও দমন-পীড়নের প্রবণতাই স্পষ্টত লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এতে আপাতভাবে সঙ্কট কমানো গেলেও ভবিষ্যতে তা আবার মাথাচাড়া দেওয়ার সম্ভাবনা জিইয়ে রাখল, একটা কথা সোচ্চারে বলা দরকার যে, উত্তর-পূর্ব ভারত তথা মণিপুরের সঙ্গে যে বশ্যতার সম্পর্ক স্থাপন করতে চায়, সেটা কখনওই যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক হতে পারে না।
আরও পড়ুন-মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসায় নয়া ইউনিট
উত্তর দিল কর্নাটক
প্রসঙ্গত, কর্নাটক-নির্বাচনের ফলাফল এটা বুঝিয়ে দিল, কেন নরেন্দ্র মোদি কর্নাটক নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। অন্য কোথাও নজর না দিয়ে প্রধানমন্ত্রী কর্নাটক-কেন্দ্রিক হয়েছিলেন। মূলত কর্নাটকে বিজেপির বিপর্যেয়ের আগাম খবর আঁচ করেই তিনি নিজেকে সেখানে নিয়োজিত করেছিলেন।
আরও পড়ুন-ভবাপাগলার মেলায় জলে-স্থলে কড়া নজরদারি
কর্নাটক প্রমাণ করল মোদি-ম্যাজিক ফেল। প্রশ্ন উঠে গেল, তিনি কি একক শক্তিতে বিজেপিকে টানতে পারছেন না? ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গে পারেননি। এবার কর্নাটকে পারলেন না। তাহলে কি শুরু হয়ে গেল তাঁকে রাজধর্ম শেখানোর পালা? পশ্চিমবঙ্গে যার শুরু কর্নাটক তাকে কি আর এক ধাপ এগিয়ে দিল? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভবিষ্যৎ-বার্তার পালে হাওয়া লাগল। কর্নাটকের পরাজয়, নরেন্দ্র মোদির আস্ফালনের পরাজয়। পরাজয় তাঁর ও আরএসএস-বিজেপি-র দর্শনের। পশ্চিমবঙ্গের পর কর্নাটক। তারপর এগিয়ে আসছে আরও বিধানসভা নির্বাচন এবং ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচন। সরকার পরিবর্তনের লড়াই শুরু হয়ে গেছে। কী হবে অদূর ভবিষ্যৎ-ই বলবে।