চলছে মোদিতন্ত্র ! আজব জমানার হাল হকিকত

জরুরি অবস্থার প্রসঙ্গ বাদ পড়ল ছাত্রপাঠ্য বিষয়সূচি থেকে। শ্রেণিকক্ষে অনালোচিত সেই প্রসঙ্গ বেমালুম উঠে এল বিদেশের মাটিতে প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতায়। দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়নি। কিন্তু তাতে কী! গ্রেপ্তার করা হল সেই সমাজকর্মীকে যিনি গুজরাত দাঙ্গায় সে-রাজ্যের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রীর ভূমিকা বেআব্রু করে ছেড়েছিলেন। সব মিলিয়ে স্বৈরশাসনের স্পষ্ট লক্ষণ এই জমানার আনাচে-কানাচে, একেবারে খুল্লাম খুল্লা। কোদালকে কোদাল বলতে কসুর করলেন না জয়ন্ত ঘোষাল

Must read

কোনটা যে আসল আর কোনটা যে নকল, সেটাই বোঝা কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সাধারণ মানুষের কাছে এটা বোঝা মুশকিল যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আসলে মানুষের কাছে কী জানতে চাইছেন! সাধারণত দেশের বাইরে গিয়ে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে কথা বলা সমীচীন নয়, এমনটাই আমরা বলে থাকি, এমনকী কয়েকদিন আগে রাহুল গান্ধী রাজনৈতিক সহিষ্ণুতার অভাব, গণতন্ত্রের অভাব দেশে পরিলক্ষিত হচ্ছে, একথা জানানোর ফলে রাহুল গান্ধীকে নিন্দার সম্মুখীন হতে হয়েছিল বিভিন্ন মহল থেকে। তাহলে নরেন্দ্র মোদি দেশের বাইরে গিয়ে হঠাৎ জরুরি অবস্থার কথা মনে করালেন কেন? ভারতবর্ষে জরুরি অবস্থা একবারই জারি হয়েছিল এবং সেটি কংগ্রেস জমানায় হয়েছিল, একথা তো এদেশের একটা বাচ্চা ছেলেও আজ জানে এবং কেউই তো এই জরুরি অবস্থাকে সমর্থন করে না। এই জরুরি অবস্থা যেদিন জারি হয়েছিল, সেদিন বিজেপি আনুষ্ঠানিকভাবে দেশের ভিতরেও বহু বছর ধরে নানারকমের অনুষ্ঠান করে মানুষকে মনে করিয়ে দেয় যে জরুরি অবস্থা কীভাবে গণতন্ত্রকে হত্যা করেছে এবং সেটা আজ নয়, সেই বাজপেয়ী, আদবানির আমল থেকেই দেখে আসছি। তাহলে? তাহলে কী এমন হল যে নরেন্দ্র মোদির আজকে হঠাৎ বিদেশে গিয়ে জরুরি অবস্থার কথা বলতে হচ্ছে!

আরও পড়ুন-মহারাষ্ট্রে স্পিকার নির্বাচনে প্রার্থী দিল ঠাকরে শিবিরও

এখানেই শেষ নয়, খটকা আরও অনেক। নরেন্দ্র মোদি জরুরি অবস্থা নিয়ে সোচ্চার হলেন দেশের বাইরে আর দেশের ভিতরে ইস্কুল-পাঠ্য সিলেবাসের থেকে আবার জরুরি অবস্থাকে বাদ দেওয়া হয়েছে। শুধু জরুরি অবস্থা নয়, তার সঙ্গে অবশ্য গোদরার দাঙ্গার কথাও বাদ দেওয়া হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে বিজেপি হঠাৎ ইস্কুল-পাঠ্য সিলেবাস থেকে জরুরি অবস্থা বাদ দিল কেন? তাহলে কি জরুরি অবস্থার প্রাসঙ্গিকতা, সেটি কী— এদেশের যারা নবীন প্রজন্ম, তাদেরকে নরেন্দ্র মোদি আর মনে করাতে চাইছেন না? কিন্তু কেন চাইবেন না? সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে কি এটা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে? কেউ কেউ বলছেন যে না তা নয়, আসলে গোদরার দাঙ্গাটা বাদ দেওয়া ছিল আসল কারণ কিন্তু শুধু তো গোদরার দাঙ্গাকে বাদ দেওয়া যায় না, তাই তার সঙ্গে এই জরুরি অবস্থাকেও বাদ দেওয়া হয়েছে। একটা ‘প্যাকেজ ডিল’। আনুষ্ঠানিকভাবে কেন্দ্রের শিক্ষা সংসদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে আসল কারণ তা নয়, কোভিডের অতিমারির জন্য এদেশে যখন একটি ভয়ঙ্কর দুর্যোগ চলছে এবং ছাত্রছাত্রীদের উপর প্রবল চাপ সৃষ্টি হয়েছে, তখন পরীক্ষাব্যবস্থা এবং পড়াশুনা নিয়ে অনেক সমস্যা দেখা দিয়েছে, তখন কিছুটা ভার লাঘব করাটা ছিল সিলেবাসের ক্ষেত্রে প্রয়োজন, আর তাই করোনা পরিস্থিতির জন্য সিলেবাসকে কমানো হয়েছে।

আরও পড়ুন-৬০-এ চৌরঙ্গী

যাই হোক যাঁরা সমালোচক, তাঁরা বলছেন নিন্দুকের ছলের অভাব হয় না আর নিন্দুকেরা বলছে এইসবই হল ছল, আসল কারণ নয়। যাই হোক, কিন্তু নরেন্দ্র মোদি যে কথাটা বিদেশে গিয়েও বলছেন না, দেশেও বলছেন না যে জরুরি অবস্থা জারি করার জন্য ইন্দিরা গান্ধী যে প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তার থেকে নরেন্দ্র মোদি অনেক কিছু শিখেছেন। কী শিখেছেন? তিনি শিখেছেন যে কীভাবে জরুরি অবস্থাটাকে জারি না করেও এদেশে জরুরি অবস্থা জারি করা সম্ভব। কীভাবে এই দেশের গণতান্ত্রিক যে-সমস্ত কাণ্ডকারখানা, সেগুলোর উপর অনায়াসে নিয়ন্ত্রণ রাখা যায় এবং স্বৈরতন্ত্রকে কায়েম করা যায় কিন্তু সেটা জরুরি অবস্থার মতন প্রশাসনিক কোনও ব্যবস্থা না নিয়ে, অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠের গণতন্ত্র কায়েম হয়েছে যেখানে, সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে, যাকে রজনী কোঠারি একদা বলেছিলেন যে ব্রুট মেজরিটি, তার একটা সমস্যা আছে। এই ব্রুট মেজরিটি কংগ্রেস তৈরি করেছিল ভারতের রাজনীতিতে, তা আজ বিজেপি সিস্টেম তৈরি করেছে, যে বিজেপি সিস্টেম অনায়াসে যেটা সংবিধান এবং যেটা বাস্তব, তার মধ্যে অনায়াসেই মুনশিয়ানার সঙ্গে ব্যবধান রেখেও শাসক দলের স্বার্থসিদ্ধি করতে সমর্থ হয়েছে।

আরও পড়ুন-লেখক নন, কবিও নন, অন্য রবীন্দ্র

একের পর এক গ্রেফতার বরণ করেছেন যাঁরা মোদি-সমালোচক। সেখানে তিস্তা শীতলবাদ আছেন, বিভিন্ন সাংবাদিক আছেন। অর্থাৎ কেউ প্রশ্ন কোরো না। কারণ, প্রশ্ন করলেই যে শুধু গ্রেফতার করা হবে তা নয়, তাকে ধনে-প্রাণে, বিপদে ফেলে এবং সবশেষে তো এজেন্সি নামক একটি শব্দ আজকে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, যাকে বলা হয় সিবিআই, এনফোর্সমেন্ট ইত্যাদি ইত্যাদি— এই সংস্থাগুলো দিয়ে যে কোনও মানুষকে এখন রাজনৈতিক ভাবে ব্ল্যাকমেল করা যায়, ভয় দেখানো যায় এবং এটাই হচ্ছে এখন সবচেয়ে আধুনিকতম উপায় গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির এবং সব মিলিয়ে নরেন্দ্র মোদির জরুরি অবস্থার সমালোচনা বিদেশে গিয়ে করলেও আসলে গণতন্ত্রের নামাবলি গায়ে দিয়ে অঘোষিত জরুরি অবস্থা কীভাবে কায়েম হয়েছে, সেটি নিয়ে বোধহয় ভারতের মধ্যেই অনেক গবেষণার প্রয়োজন আছে, সেটা যাঁরা বুঝতে পারছেন এবং যাঁরা বুঝতে পারছেন না, তাঁদের বোঝার সময় এবার চলে এসেছে।

Latest article