চাঁদমামা ফের ডাকছে

চাঁদে যাওয়ার পথে ভীষণ ব্যস্ততা এখন। ৫২ বছর পর আবার চন্দ্রপৃষ্ঠে আমেরিকা, চিন, জাপান, ভারতের পাশাপাশি ইজরায়েলও চন্দ্রাভিযানের প্রতিযোগিতায় উঠে-পড়ে লেগেছে। কেবল পাঁচটি দেশ আজ অবধি চাঁদের বুকে নরম অবতরণে সাফল্য পেয়েছে। এবার কী হতে চলেছে? খতিয়ে দেখলেন দেবাশিস পাঠক

Must read

চাঁদের বুকে টুকুস করে নেমে পড়বে, ব্যাপারটা মোটেই অত সোজা নয়। আর সে কথাটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়ে গেছে নাসা। জানুয়ারি মাসেই তাদের বাণিজ্যিক প্রকল্পের অংশীদার অ্যাট্রোবোটিকের পেরেগরাইন মিশন মুখ থুবড়ে পড়ার পর এটা তারা বেশ বুঝেছে। কিন্তু মুষড়ে পড়ার পাত্র নয় নাসা তাই কয়েক সপ্তাহ যেতে না যেতেই গত শুক্রবার নাসার আর এক বাণিজ্যিক অংশীদার ইনটিউটিভ মেশিনস অর্ধ-শতাব্দী পর চাঁদের বুকে আমেরিকান চন্দ্রযানের সফল অবতরণ সম্ভবায়িত করেছে। সেই সুবাদে ইনটিউটিভ মেশিনস হল প্রথম বেসরকারি সংস্থা যারা চন্দ্রভিযানে সাফল্য অর্জন করল। কিছুক্ষণের জন্য সংকট, সংশয়, অনিশ্চয়তা, উত্তেজনা। তারপর নোভা-সির ল্যান্ডার ও ডিসিয়া খাড়া হয়ে নেমে পড়েছে চন্দ্রপৃষ্ঠে। শুরু করে দিয়েছে তথ্যাদি প্রেরণ।

আরও পড়ুন-আন্তর্জাতিক কেক উৎসব

ওডিসিয়াস, সংক্ষেপে ওডি ভূপৃষ্ঠ ছেড়েছিল গত ১৫ ফেব্রুয়ারি স্পেস এক্স ফ্যালকন ৯-তে চেপে। চাঁদের কক্ষপথে ঢোকার পরদিনই অর্থাৎ ২২ ফেব্রুয়ারি চাঁদের মাটিতে নেমে পড় ওডিসিয়াস, সংক্ষেপে ওডি। ইনটিউটিভ মেশিনস-এর প্রথম চন্দ্রাভিযানে নাসা ছ’টি পে-লোড পাঠিয়েছিল। প্রকল্পটির নাম দেওয়া হয়েছিল কমারশিয়াল পো লোড সার্ভিসেস, সংক্ষেপে সিএলপিএস। এ বাবদ ১১৮ মিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ ভারতীয় মুদ্রায় কমপক্ষে ৯৭৮০৯,১৯,৭০০ টাকার একটা চুক্তি করেছে তারা। তবে উৎক্ষেপণ-সহ গোটা চন্দ্রাভিযানে খরচ হবে আনুমানিক ২০০ মিলিয়ন ডলার, ভারতীয় মুদ্রায় ১৬৫৭৮,৩০,০০০ টাকা।
গত বছর উৎক্ষেপণ থেকে চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণের জন্য ভারতের চন্দ্রাভিযানে ৪০ দিন লেগেছিল। ভারত উৎক্ষেপণের জন্য যে রকেটটি ব্যবহার করেছিল সেটি এই নাসার ব্যবহৃত রকেটের তুলনায় অনেক কম ক্ষমতাসম্পন্ন। তাতেই প্রকল্পটিতে ব্যয়ের অঙ্ক দাঁড়িয়েছিল ৭২ মিলিয়ন ডলার, মানে ৫৯৬, ৮০,১৮,৮০০ টাকা। ভারতের বিক্রম ল্যান্ডারের ওজন ছিল ১,৭৫২ কেজি। সেখানে ফোনের সাইজের ওডির ওজন মোটে ৬৭৫ কেজি, তবে ওডি কোনও রোভারের বাহক ছিল না।

আরও পড়ুন-এক শহর দুই প্রদর্শনী

১৯৭২-এ মানুষের চন্দ্রাভিযানের দরজা খুলে দিয়েছিল অ্যাপোলে ১৭ মিশন। সেই চন্দ্রাভিযানের স্মৃতি ফিরিয়ে দিল ওডির সাফল্য। খুলে দিল চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অভিযানের দ্বার।
১৯৬০-এর দশকে মহাকাশ অভিযানের দৌড়ে শামিল ছিল সোভিয়েত রাশিয়ার লুনা ৯ ও লুনা ১০। প্রথমটি চাঁদের মাটিতে নামে ১৯৬৬-র ফেব্রুয়ারিতে, দ্বিতীয়টির অবতরণকাল মার্চ, ১৯৬৬। আমেরিকার প্রথম সফল চন্দ্রযান সার্ভেয়র-১ সে বছরই মে মাসে চাঁদে পৌঁছায়। এরপরই শুরু হয় সেই ঐতিহাসিক অ্যাপোলো প্রকল্প, যার সুবাদে অদ্যবধি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই একমেবাদ্বিতীয়ম দেশ যারা চাঁদের বুকে মানুষ নামাতে সমর্থ হয়েছে।
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ব্যতীত তিনটি দেশ— চিন, ভারত ও জাপান—চন্দ্রপৃষ্ঠে সফল অবতরণের গৌরব অর্জন করে। প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত বিষয়ে চাঁদের গুরুত্বের কথা প্রথম শ্রুত হয়েছিল আমেরিকার বজ্রনির্ঘোষেই। সেই দিকে লক্ষ্য রেখেই নাসা অব্যাহত রেখেছে তাদের চাঁদে যাওয়ার পরম্পরা, নিরবিচ্ছিন্নভাবে।

আরও পড়ুন-হাওড়া-শিয়ালদহ শাখায় বাতিল একাধিক লোকাল

ইনটিউটিভ মেশিনস-১ এই পারম্পর্য বহন করেই বাণিজ্যিক ভাবে চাঁদে যাত্রার দ্বার উন্মোচন করে ফেলল। একক ঐতিহাসিক সাফল্য, কারণ এই পথ ধরেই চন্দ্র পরিধিতে মনুষ্যের উপস্থিতি ও অবস্থিতি অচিরেই সম্ভবায়িত হবে। চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে রাত নামার আগে সাত দিনের মধ্যে ওডির পেলোডগুলো কাজ শুরু করে দেবে বলে মনে করা হচ্ছে। ওডিতে নাসা যে পেলোডগুলো চাপিয়েছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে একটা ন্যাভিগেশন ডপলার লাইডার, একটা ন্যাভিগেশন বেকন, ট্যাংকে কত জ্বালানি আছে তা মাপার জন্য একটা রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি সম্পন্ন যন্ত্র, একটা ক্যামেরা যেটাতে ধরা পড়বে ল্যান্ডারের ইঞ্জিন চাঁদের বুকে কতটা ‘ধুলো’ ওডাল তার ছবি, একটা লেজার রেট্রোরিফ্লেক্টর এবং একটা রেডিও অ্যাস্ট্রোনমির যন্ত্র যেটা প্রযুক্তিগত প্রদর্শনে সহায়ক হবে। নাসার পেলোডগুলো ছাড়াও আরও ছটি পেলোড আছে ওডিতে।
২০১২তেই নীল নকশাটা ছকে দিয়েছিলেন স্টিভ অ্যালটেমাস। ক্যাম ঘ্যাকারিয়ানের সঙ্গে নৈশভোজে গিয়েছিলেন। সেখানেই একটা ন্যাপকিনে লিখে ফেলেন ইনটিউটিভ মেশিনস তৈরির ছকটা। পরবর্তীকালে ক্যাম আর স্টিভ মিলেই প্রতিষ্ঠা করেন ইনটিউটিভ মেশিনস। বর্তমানে স্টিভ ওই সংস্থার সিইও।
ইনটিউটিভ মেশিনস তাদের ১৩০ কেজি ক্ষমতাসম্পন্ন পেলোডটির নাম রেখেছিল নোভা-সি, ‘নোভা’ মানে ‘নয়া’ আর ‘সি’ বোঝাচ্ছে ‘সেঞ্চুরি’ বা ১০০কে, শেষ পর্যন্ত যে নামটা বাছা হয়, অর্থাৎ ওডিসিয়াস, সেটি গৃহীত হয় একটি তালিকা থেকে, ওই তালিকায় অন্য নামগুলোর মধ্যে ছিল আর্কিমিডিস, জিরাল্ডিন কোব ইত্যাদি। সংস্থার কর্মীরাই এই নামগুলির প্রস্তাব দিয়েছিল।

আরও পড়ুন-লকেট যেখানে দাঁড়াবেন সেখানে হারবেন : কল্যাণ

ম্যালাপার্ট এ কে অবতরণ স্থল হিসাবে বেছে নেওয়া হয়েছে। একেবারে অ্যাপোলো ১৬-এর অবতরণ স্থলের মতো জায়গা। চাঁদের পাহাড়ের উপকরণ দিয়ে তৈরি। কাছেই ম্যালাপার্ট-ম্যাসিক নাসার আর্টেমিস ৩ মিশনের জন্য বাছাই করা ১৩টি স্থানের অন্যতম। এবারের চন্দ্রাভিযান থেকে লব্ধ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা আগামী দিনের চন্দ্রাভিযানের জন্য সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের চন্দ্রাভিযান ৩, এমনকী চিন-জাপানের সাম্প্রতিক চন্দ্রাভিযানও এদিক থেকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ সন্দেহ নেই।
রাশিয়ার লুনা-২৫ ব্যর্থ। ভারতের চন্দ্রযান-৩ এগোচ্ছে চাঁদের দিকে, সফলভাবে এসবের মধ্যেই আরও ১০ দেশ চন্দ্রাভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ২০২৫-এর মধ্যে এগুলি বাস্তবায়িত হওয়ার কথা। ২০২৩ দেখেছে ভারত, চিন, জাপান, এবং ইজরায়েলের চন্দ্রাভিযান, এ-বছর ২০২৪-এ একাধিক চন্দ্রাভিযান করবে আমেরিকা। ২০২৪-২৫-এ ভারত-জাপান যৌথভাবে একটি চন্দ্রাভিযান চালানোর কথা ভেবেছিল, এখন শোনা যাচ্ছে সেটি বাতিল করা হতে পারে।
সব মিলিয়ে এখন চাঁদে যাওয়ার ধুম পড়ে গেছে মহাকাশে। চাঁদমামার হাতছানি আগ্রাহ্য করার সামর্থ্য বোধহয় কারও নেই।

Latest article