মাতৃত্ব অবাঞ্ছিত নয়, হোক গর্বের

জন্ম নিয়ন্ত্রণ এবং অবাঞ্ছিত গর্ভধারণ এড়াতে গর্ভনিরোধই একমাত্র সুরক্ষিত উপায়। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলোয় ২২২ মিলিয়নের বেশি মহিলা অবাঞ্ছিত মাতৃত্ব এড়াতে কোনও জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করেন না। হয় অপরিকল্পিতভাবে সন্তানের জন্ম দিয়ে ফেলেন, না হয় গর্ভপাত করান। দুই-ই ক্ষতিকর। তাই গর্ভনিরোধক সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে ২০০৭ সাল থেকে প্রতি বছর ২৬ সেপ্টেম্বর বিশ্ব গর্ভনিরোধ দিবস পালিত হয়ে আসছে। সেই লক্ষ্যে কতটা সফল আমরা, এ নিয়ে ফ্যামিলি প্ল্যানিং অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়ার কলকাতা শাখার হেড সুপ্রতীপ মজুমদার-এর সঙ্গে কথা বললেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

বিশ্ব জুড়ে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণের হার খুব আশাব্যাঞ্জক নয়। উন্নয়নশীল দেশে প্রায় ২২২ মিলিয়নের বেশি মহিলা অবাঞ্ছিত গর্ভধারণ এড়াতে কোনও আধুনিক জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করেন না। বিশেষত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে। ভারতবর্ষ জুড়ে প্রায় পাঁচশোর বেশি যুবতী এবং মহিলা অল্প বয়সে গর্ভধারণের ফলে মারা যায়। অনেক সময় অবাঞ্ছিত গর্ভধারণের ফলে একজন নারী বাধ্য হয়ে গর্ভপাত করান যার ফলে তাঁর প্রাণসংশয়ের সম্ভাবনাও থাকে।
কন্ট্রাসেপশন বা গর্ভনিরোধ মেয়েদের একটি মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে। মাতৃত্ব গ্রহণের সিদ্ধান্ত একটি নারীর হওয়া উচিত, কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষেরাই এতদিন পর্যন্ত এই সিদ্ধান্ত নিতেন। মেয়েদের সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র মনে করতেন তাঁরা।
জন্ম নিয়ন্ত্রণ পরিবার পরিকল্পনারই একটি দিক। শুধুমাত্র অপ্রয়োজনীয় গর্ভধারণ রোধে নয়, গর্ভনিরোধক ব্যবহারে নানা অসুখ যেমন এইচআইভি ইত্যাদি প্রতিরোধ করা সম্ভব। বর্তমানে কন্ট্রাসেপশনের নানান বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি এসে গিয়েছে এবং পুরনো পদ্ধতিগুলো আরও উন্নত হয়েছে। বহু নারী নিজে সিদ্ধান্ত নিলেও অনেকেই এখনও অন্ধকারে। এই সচেতনতা আরও বাড়াতে জরুরি গর্ভনিরোধের পদ্ধতিগুলি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা এবং কাউন্সেলিং।

আরও পড়ুন-পরচুলা কথা

বিভিন্ন গর্ভনিরোধক
পুরুষের ক্ষেত্রে কন্ডোম এবং ভ্যাসেকটমি পদ্ধতি বাদে বাকি সবই মেয়েদের জন্য। এই মুহূর্তে সরকারি এবং বেসরকারি দু’ক্ষেত্রেই কন্ট্রাসেপশন বা গর্ভনিরোধের তিনটে ধরন হয় পার্মানেন্ট, সেমি পার্মানেন্ট, টেম্পরারি।
পার্মানেন্ট কনট্রাসেপশন হল টিউবল লাইগেশন বা সাধারণ কথায় লাইগেশন অর্থাৎ মহিলাদের বন্ধ্যাত্বকরণ। পুরুষদের হল পুরুষ নির্বীজকরণ বা এনএসভি নন স্ক্যাল্পেল ভ্যাসেকটমি।
সেমিপার্মানেন্ট কন্ট্রাসেপশন হল কপার্টি। এখন তিনবছর, পাঁচবছর, দশবছর এই তিনধরনের কপার্টি এসে গেছে। রিপ্রোডাক্টিভ এজ বা যে সময় একটি মেয়ে সন্তানধারণের জন্য ঊর্বর সেই সময় দশবছরের গ্যাপেও দুটো কপার্টি লাগিয়ে নিলে পুরো লাইফস্প্যানটা অর্থাৎ কুড়ি বছর সে নিজেকে অবাঞ্ছিত গর্ভধারণ থেকে সুরক্ষিত রাখতে সক্ষম থাকবে।
অপর একটি কমন কন্ট্রাসেপশন হল ওরাল পিল। তার মধ্যে একটি সাধারণ ওরাল পিল এবং অপরটি এমার্জেন্সি ওরাল পিল। যদি ওরাল পিল খেতে খেতে কোনও একটা মিস করে যায় অথবা ভুলবশত অসুরক্ষিত যৌনসংসর্গ হয়ে যায় তাহলে বাহাত্তর ঘণ্টার মধ্যে সেই এমার্জেন্সি পিল খেলে বিপত্তি এড়ানো যাবে।

আরও পড়ুন-পকসো আইনে সম্মতির বয়স কমানোর বিরুদ্ধে আইন কমিশন 

আর একটি হল প্রোজেস্টেরন অনলি পিল বা পিওপি। এটি মা যখন ল্যাকটেশন পিরিয়ডে রয়েছে অর্থাৎ বাচ্চা ব্রেস্ট ফিড করছে সেই সময়কার গর্ভনিরোধক ট্যাবলেট। কারণ নর্মাল ওরাল পিল তখন চলে না
কমন ওরাল পিলের মতোই আরও একটি ট্যাবলেট লঞ্চ করা হয়েছে যেটা প্রথমে সপ্তাহে দু’দিন খেতে হয় তারপর সপ্তাহে একদিন করে খেতে হয়। এর নাম ছায়া। এটি সরকারি।
একটি কন্ট্রাসেপশন ইনজেকশন এসেছে নতুন। এই ইঞ্জেকশনটি একবার নিলে আগামী তিনমাস গর্ভনিরোধক নিতে হয় না।
একটি অত্যাধুনিক গর্ভনিরোধক রয়েছে যেটা ভারতীয় বাজারের জন্য বেশ দামি তবে সেটিও এখন সাধারণের জন্য আনার চেষ্টা চলছে। হয়তো আর কয়েকমাসের মধ্যে চলে আসবে। একে বলা হয় সিঙ্গল রড ইমপ্ল্যান্টস। একটা ছোট্ট দেশলাই কাঠির মতো সরু পাইপ। যেটা মহিলাদের হাতের বাই-সেপসের চামড়ার ঠিক নিচে ছোট্ট নিডলের মাধ্যমে বসিয়ে দেওয়া হয়। এই ব্যবস্থায় এক বছর কোনও গর্ভনিরোধক নিতে হয় না। এটা বসানোর সময় লোকাল অ্যানাস্থেশিয়া করতে হয়।

আরও পড়ুন-পকসো আইনে সম্মতির বয়স কমানোর বিরুদ্ধে আইন কমিশন 

ইনফর্মড চয়েজ
একজন মহিলা যিনি গর্ভনিরোধক নেবেন তিনি বেছে নিতে পারবেন তাঁর পছন্দের কন্ট্রাসেপশন। একে বলা হয় ইনফর্মড চয়েস। অর্থাৎ যিনি গর্ভনিরোধক নেবেন তিনি কাউন্সেলিং সেন্টারে এলে তাঁকে সবধরনের অপশনগুলো বলে দেওয়া হবে। এবার সেই মহিলা তাঁর দিনলিপি, ব্যস্ততা, কেমন পদ্ধতি চাইছেন তার উপর ভিত্তি করে বেছে নেবেন।
জন্ম নিয়ন্ত্রণ এবং আনওয়ান্টেড প্রেগনেন্সি বা অবাঞ্ছিত মাতৃত্ব রোধে প্রতিটা গর্ভনিরোধকই পরীক্ষিত এবং সুরক্ষিত। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই বললেই চলে। যা নারীজীবনে দিগন্ত এনেছে। মেয়েরা নিজেরা চাইলে তবেই তারা যে কোনও সময় মাতৃত্বের দায়িত্ব এবং সুখ নেবে আবার না চাইলে তাঁদের জন্য রয়েছে গর্ভনিরোধের সুরক্ষা কবচ।
অ্যাবরশনের ফলে মেয়েদের ইউটেরাসের ওপর একটা চাপ পড়ে। একটা শারীরিক ক্ষয় হয়। পরবর্তীতে নানারকম সমস্যা আসতে পারে। তাই আগেই যদি গর্ভনিরোধকের মাধ্যমে জন্মনিয়ন্ত্রণ করা যায় অনেক অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব।

আরও পড়ুন-লাইভ-শো’তেই তুমুল হাতাহাতি পাক নেতাদের!

কাউন্সেলিং জরুরি
ক্লিনিকাল সাইকোলজি নিয়ে পড়েছেন এমন বিশেষজ্ঞরাই কনট্রাসেপশন নিয়ে কাউন্সেলিং করান। ফ্যামিলি প্ল্যানিং হাসপাতালে বা যেখানেই হোক, মেয়েরা যখন চিকিৎসকের কাছে আসেন, ফ্যামিলি প্ল্যানিং নিয়ে চিন্তাভাবনা করছেন, তাঁদের কাউন্সেলিং করা হয়। কাউন্সেলিং-এ কন্ট্রাসেপশন পিল নিয়ে একটা সম্যক ধারণা দেওয়া হয়। কোন গর্ভনিরোধক কোন লাইফ স্টাইলের জন্য বেশি প্রযোজ্য বা কোনটা কতটা দীর্ঘস্থায়ী, কোনটার কী সুবিধা তাঁর জন্য সুইটেবল হবে সেটার একটা সম্পূর্ণ গাইডলাইন করে দেওয়া হয়। কাউন্সেলররা মানসিকভাবে প্রস্তুত করেন একজন মহিলাকে।
গর্ভনিরোধ নিয়ে আরও অনেক কর্মসূচি আগামী দিনে নেওয়া হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। যদিও অনেকটাই সমস্যা রয়েছে। কারণ এদেশ বহুধর্মের, তাই সবধর্মের মানুষ গর্ভনিরোধকে বিশ্বাসী নন। তাঁদের মধ্যে সচেতনতা কর্মসূচি ফলপ্রসূ হওয়া কঠিন তথাপি চেষ্টার কোনও ত্রুটি রাখছে না সরকার। বর্তমানে টোটাল ফার্টিলি রেট ১.২। অর্থাৎ একজন দম্পতিপিছু দুটো বাচ্চাও নয়। কাজেই এই কঠিন কাজে সাফল্য এসেছে বলাই চলে।

Latest article