যাঁরা একটু খবরের কাগজ পড়েন বা দেশের খবর রাখার চেষ্টা করেন তাঁদের কারও আর একথা জানতে বাকি নেই যে ‘এনসিইআরটি’ তাদের বারো ক্লাসের ইতিহাসের নতুন পাঠ্যসূচি থেকে মুঘল যুগের ইতিহাস বাদ দিয়ে দিয়েছে! খবরটা পড়ে নিশ্চয়ই আপনিও বেজায় অবাক হয়েছেন! ভেবেছেন, এভাবে ইতিহাসের পাঠ্যসূচি থেকে গুরুত্বপূর্ণ অংশ বাদ দিয়ে দেওয়া যায় নাকি? আসলে শাসকের যদি লক্ষ্য হয়, ভারতের ইতিহাসের মধ্যযুগের সব কিছুর সঙ্গে মুসলমান-অনুষঙ্গ যুক্ত করা তাহলে যা যা করা সম্ভব সবই করা যায়! যদি চারদিকে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলির দিকে একটু নজর রাখেন তাহলে একথা খুব ভাল করে বুঝতে পারবেন।
প্রথমেই বলি, মুঘল ইতিহাসকে উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাসের পাঠ্যসূচি থেকে বাদ দেওয়ার সুপারিশ যারা করল সেই ‘ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ এডুকেশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং’ কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ একটি ‘স্বশাসিত’ সংস্থা। কাজেই এই বিষয়টি কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা ঠিক হবে না। নিশ্চয়ই মনে আছে, জনমানস থেকে মুঘল নাম মুছে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বেশ কিছুদিন আগে থেকে। ট্রেনে করে উত্তর ভারতে যাওয়ার পথে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্টেশন ‘মুঘলসরাই’ আর নেই। তার নাম বদলে দেওয়া হয়েছে। নতুন নামকরণ এক হিন্দুত্ববাদী নেতার নামে— যার নাম দীনদয়াল উপাধ্যায় যিনি সঙ্ঘ পরিবারের রাজনৈতিক আদর্শের এক প্রধান প্রবক্তা। এই আদর্শ হল, দেশকে হিন্দু হিসেবে দেখানো। যে শাসকেরা ধর্মসূত্রে হিন্দু শুধু তাদেরই কীর্তিকাহিনি তুলে ধরাই এই আদর্শের মূল কথা। আর লক্ষ্য ভারতের ইতিহাসে তথাকথিত ‘অ-হিন্দু’ উপাদানকে চিহ্নিত করে তাকে বহিরাগত হিসেবে আখ্যায়িত করা। কিন্তু মজা হল পুরো ব্যাপারটাই দাঁড়িয়ে আছে মিথ্যের ওপর। ভারত এমন একটা দেশ যেখানে কখনওই শাসকের ধর্ম, সারা দেশের ধর্ম হয়ে ওঠেনি। শাসক ভিন্নধর্মে বিশ্বাসী হওয়া সত্ত্বেও রাজকাজে অন্য ধর্মাবলম্বীকে তাঁর যোগ্যতা অনুযায়ী গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এমন ঘটনা ভারত-ইতিহাসের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে। আর তার বিস্তর উদাহরণ মেলে মুঘল ইতিহাসে।
আরও পড়ুন-গিরিরাজকে বিস্ফোরক চিঠি তৃণমূল কংগ্রেসের
মুঘল শাসকেরা যোগ্য ব্যক্তিদের উপযুক্ত মর্যাদা দিয়েছিলেন। সেখানে সেই ব্যক্তির ধর্মীয় পরিচয় কখনও বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। মুঘলযুগে আকবরের আমলে যে ব্যক্তি রাজস্বব্যবস্থা তথা অর্থনীতির ভারপ্রাপ্ত ছিলেন সেই টোডরমল ছিলেন হিন্দু। আর তাঁকেই আকবর করেছিলেন মুন্সিফ-ই-দেওয়ান বা সাম্রাজ্যের অর্থমন্ত্রী। একইসঙ্গে তিনি ছিলেন ভকিল-আস-সুলতানাত বা সম্রাটের মন্ত্রণাদাতা। কতটা বিশ্বাসযোগ্যতা থাকলে কাউকে প্রশাসনে এতটা গুরুত্ব দেওয়া যায় তা একবার ভেবে দেখুন। এই ইতিহাস ছাত্রেরা শিখলে তো তাদের একথা ‘বোঝানো’ যাবে না যে মুসলমান মুঘল শাসকেরা হিন্দুদের প্রতি কতটা বিদ্বিষ্ট ছিলেন!
আরও পড়ুন-অভিষেকের সভা ঘিরে উন্মাদনা আলিপুরদুয়ারে
ভেবে দেখুন যে-হলদিঘাটের যুদ্ধে আকবর রানা প্রতাপকে পরাজিত করেছিলেন সেই যুদ্ধে আকবরের প্রধান সেনাপতি ছিলেন অম্বরের রাজা মান সিংহ। বলা বাহুল্য মান সিংহ ছিলেন তথাকথিত হিন্দু রাজা। শুধু তা-ই নয়, যাকে মানসিংহ বা আকবর হারালেন সেই রাণা প্রতাপের সৈন্যদলের নেতৃত্বে ছিলেন বিশিষ্ট আফগান শের শাহের বংশধর হাকিম খান সুরি। এ-কথা ছাত্রেরা জানলে তো আর আজকের শাসক এ-কথা বলতে পারবে না যে মুঘল যুগ মানেই হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্বের ইতিহাস!
আরও পড়ুন-নববর্ষে কলকাতার বস্তি এলাকায় জ্বলবে সৌর আলো, উদ্যোগ পুরনিগমের
ইতিহাসটা বরং অন্য। আকবর থেকে আওরঙ্গজেব, কোনও মুঘল শাসকের কাছেই তাদের ব্যক্তিগত ধর্মীয় পরিচয় গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। ‘মুসলমান’ আকবর ধর্মীয় বিষয়ে উলেমাদের ব্যাখ্যাকে চূড়ান্ত হিসেবে মানেননি। বরং ১৫৭৯ সালে ‘মাজহার’ বা ‘অভ্রান্ততার নির্দেশনামা’ জারি করে তিনি ঘোষণা করেন যে কোনও ধর্মীয় বিষয়ে উলেমারা যদি সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হন তবে সম্রাটই তার চূড়ান্ত ব্যাখ্যা প্রদান করবেন আর তা হবে অভ্রান্ত। ফলে সহজেই বোঝা যায় শাসকের কাছে ধর্ম বিচার্য ছিল না, বিচার্য ছিল শাসকের সার্বভৌমিকতা। আবার যে আওরঙ্গজেবকে হিন্দুবিদ্বেষের জন্য অভিযুক্ত করা হয় তিনি সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক প্রয়োজনে হিন্দুদের পাশাপাশি মুসলমানদের ওপরও নতুন কর বসিয়েছিলেন। আওরঙ্গজেব ধর্মস্থান ধ্বংসের দায়ে অভিযুক্ত। তাৎপর্যপূর্ণ হল তার মধ্যে মসজিদও ছিল। তিনি এই অভিযান করেছিলেন রাষ্ট্রের শাসকের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের আখড়া ভাঙতে। কোনও মুঘল শাসকই ধর্মীয় আদর্শকে দেশের শাসনভার দেননি; প্রধান গুরুত্ব দিয়েছিলেন শাসকের সার্বভৌমিকতা রক্ষার বিষয়টিকে। আওরঙ্গজেবই এক সুন্নি ওমরাহকে লিখেছিলেন, ‘জাগতিক বিষয়ের সঙ্গে ধর্মের কী সম্পর্ক? প্রশাসনের কাজকর্মে ধর্মের নাক গলানোর কী অধিকার আছে! ধর্ম যার যার।’ সমস্যা হল, মুঘল শাসনের এই স্বরূপ যদি শিক্ষার্থীরা জানে তবে তো তাদের বলা যাবে না বহিরাগতরা এসে সব দখল করে নিল!
আরও পড়ুন-দেশে ফের ঊর্ধমুখী কোভিড সংক্রমণ
মুঘল শাসনের ইতিহাস ধর্মীয় সমন্বয়ের ইতিহাসও, যা ছড়িয়ে রয়েছে সাহিত্য আর শিল্পের অঙ্গনে। মনে রাখতে হবে মুঘল শাসকেরা হিন্দুদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কও স্থাপন করেছিলেন যা আজকের ভারতে ঘটলে শাসক ‘খাপ পঞ্চায়েত’ বসিয়ে ফেলে! ‘অনার কিলিং’-এর নামে ভিনধর্মে বিয়ে করা দম্পতিদের মেরেও ফেলা হয়! মুঘল ইতিহাস নবীন প্রজন্ম জানলে তো শাসকের অসুবিধা, কারণ তখন নতুন প্রজন্ম উপলব্ধি করবে রবীন্দ্রনাথের ‘ভারততীর্থ’ কবিতার বাণী— ‘হেথায় আর্য, হেথা অনার্য, হেথায় দ্রাবিড়, চীন–শক-হূন-দল পাঠান মোগল এক দেহে হল লীন’। এদেশে বিভিন্ন সময়ে আগত ভিনজাতি, ভিনধর্মীদের এক দেহে লীন হওয়ার ইতিহাস ছাত্রেরা শিখলে তো তাদের কাছে এঁদের বহিরাগত বলে চিহ্নিত করা যাবে না। তার থেকে সহজ উপায়, এই বিষয়গুলিকেই বার করে দাও ইতিহাসের পাঠ্য থেকে!