নতুন সংসদ ভবনে অখণ্ড ভারতের ম্যুরাল কেন? ক্ষোভ জানিয়ে প্রতিবাদ প্রতিবেশীদের

সংঘের প্ররোচনা, বেপরোয়া বিজেপি

Must read

প্রতিবেদন : কূটনৈতিক শিষ্টাচার শিকেয় তুলে রাজনৈতিক আগ্রাসনের মনোভাব প্রচার করতে গিয়ে প্রতিবেশীদের তোপের মুখে ভারত। বাংলাদেশ, নেপাল, পাকিস্তানের ক্ষোভ, খোদ আইনসভায় বিকৃত ভারতের মানচিত্র তুলে ধরে মোদি সরকার প্রতিবেশী দেশগুলিকেও নিজেদের অংশ বলে প্রচার করতে চায়। পরিস্থিতির চাপে বিবৃতি দিয়ে বিষয়টি লঘু করতে নেমেছে ভারতের বিদেশমন্ত্রক। মুখপত্র অরিন্দম বাগচীর সাফাই, এই ম্যুরাল (Mural of undivided India) মৌর্য সামাজ্যের সীমানা ছাড়া কিছু নয়৷ কিন্তু কেন্দ্রের শীর্ষস্তরের মন্ত্রীর বক্তব্যের সঙ্গেই তার কোনও মিল নেই। সব মিলিয়ে, নয়াদিল্লির ভূমিকায় প্রবল অসন্তুষ্ট প্রতিবেশী দেশগুলি। চিনের সঙ্গে দ্বন্দ্বের আবহে যা ভবিষ্যতে ভারতের পক্ষে সুখকর নয়।

রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ মনে করে, প্রাচীনকালের গান্ধার (কান্দাহার) থেকে ব্রহ্মদেশ (মায়ানমার) ও তিব্বত-নেপাল থেকে শ্রীলঙ্কা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতি। এই অখণ্ডভূমিই তাদের কাছে ‘অখণ্ড ভারত’। একবিংশ শতকে দাঁড়িয়ে সংঘ এখনও মনে করে, অতীতে যা ছিল ‘সিন্ধু’ সভ্যতা, তা আদতে ‘হিন্দু’ সভ্যতা। সেই সভ্যতার বিকাশ তারা নতুনভাবে ঘটাতে চায়। কেন্দ্রে বিজেপি সরকার থাকায় সেই লক্ষ্যের সদ্ব্যবহার করাই সংঘের উদ্দেশ্য। আর সংঘের আদর্শে পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকার নতুন সংসদ ভবনে ম্যুরালের মাধ্যমে ‘অখণ্ড ভারতের’ (Mural of undivided India) মানচিত্র ফুটিয়ে তুলবে, এতে আর নতুনত্ব কী? এই কাজ করতে গিয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বে আঘাত হানতেও পিছপা নয় নরেন্দ্র মোদির সরকার। এক্ষেত্রে বিদেশনীতির কথা না তোলাই ভাল। কারণ তা মূলত রাজনৈতিক প্রভুদের ইচ্ছাতেই পরিচালিত।

আরও পড়ুন: নৃশংস ঘটনা মণিপুরে: অ্যাম্বুলেন্সের মধ্যে জীবন্ত পোড়ানো হল মা, সন্তান-সহ ৩ জনকে

সংসদ ভবনের ম্যুরালে অখণ্ড ভারতের মধ্যে রয়েছে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, নেপাল, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও মায়ানমার। এর স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হিসেবেই সাধুসন্ত-বেষ্টিত প্রধানমন্ত্রী নতুন সংসদ ভবন উদ্বোধন করার পর প্রতিবাদের ঢেউ উঠতে শুরু করেছে বাংলাদেশ, নেপাল, পাকিস্তানে। অভিযোগ, এই ম্যুরাল ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলির সার্বভৌমত্বকে চ্যালেঞ্জ করছে। ম্যুরালে নেপালের লুম্বিনীকে অখণ্ড ভারতের অঙ্গ হিসেবে দেখানো হয়েছে। গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থান লুম্বিনী নেপালিদের কাছে অতি পবিত্র স্থান ও দেশের গুরুত্বপূর্ণ ও গর্বের অংশ। এই জায়গাটিকে নেপাল এক অনন্য সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে তুলে ধরে। একইসঙ্গে লুম্বিনী সে-দেশের পর্যটন মানচিত্রে অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। নেপালের প্রধানমন্ত্রী পুষ্প কুমার দাহাল ‘প্রচণ্ড’-র সাম্প্রতিক দিল্লি সফরের মধ্যেই নেপালের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বাবুরাম ভট্টরাই এক বিবৃতিতে এই বিতর্কের অবতারণা করেন। তিনি বলেন, এই মানচিত্র নেপাল-সহ ভারতের অন্য প্রতিবেশী রাষ্ট্রে অহেতুক ও ক্ষতিকর বিতর্কের জন্ম দেবে। বিভিন্ন প্রতিবেশীর সঙ্গে ভারতের যে বিশ্বাসের ঘাটতি রয়েছে, তা বাড়িয়ে দেওয়ার মতো উপাদান এই মানচিত্রে রয়েছে। বিষিয়ে তুলতে পারে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক। নেপালের রাজনৈতিক দলগুলি এবং দুই প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ‘অখণ্ড ভারত’ ম্যুরাল স্থাপনের প্রতিবাদ করেছে। তাদের অভিযোগ, এটি একটি ধারণার প্রতি সরকারি অনুমোদনের ইঙ্গিত। ভারত ও নেপালের মধ্যে কালাপানিকে কেন্দ্র করে দীর্ঘদিন ধরেই বিতর্ক চলছে। ২০১৯ সালে ভারতের একটি রাজনৈতিক মানচিত্রে কালাপানিকে উত্তরাখণ্ড রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত দেখানো হয়েছিল। পাল্টা মানচিত্র বের করেছিল নেপাল। দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত বিরোধ অনেক দিনের। এই পরিস্থিতিতে অখণ্ড ভারতের ম্যুরাল দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অবনতি ঘটাবে বলে আশঙ্কা।

এদিকে বাংলাদেশও নতুন সংসদ ভবনে স্থাপিত ‘অখণ্ড ভারত’ ম্যুরাল সম্পর্কে নয়াদিল্লির কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে। ভারতের মানচিত্রে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশকে অন্তর্ভুক্ত করার ফলে প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। একই অবস্থান নিয়েছে পাকিস্তানও। ঢাকা ও ইসলামাবাদ আনুষ্ঠানিকভাবে ম্যুরাল নিয়ে কথা বলেছে। বাংলাদেশকে ‘অখণ্ড ভারতের’ অংশ দেখানো অবমাননাকর দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ বলে উল্লেখ করেছে সে দেশের ‘গণসংহতি’ আন্দোলন। এক যৌথ বিবৃতিতে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি ও নির্বাহী সমন্বয়কারী আবুল হাসান বলেছেন, ভারতের বিজেপি সরকারের তৈরি এই ম্যুরাল বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও আত্মমর্যাদার প্রতি অবমাননার বহিঃপ্রকাশ। এটি বাংলাদেশের জনগণের মর্যাদাবোধকে প্রবলভাবে আহত করেছে। বিবৃতিতে এই ম্যুরাল অপসারণের দাবি জানানো হয়েছে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘তথাকথিত অখণ্ড ভারতের ম্যুরাল উপমহাদেশে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার পক্ষে উদ্বেগজনক। বাংলাদেশের গণসংগঠনগুলি এই ইস্যুতে ক্ষমতাসীন সরকারের নীরবতার নিন্দা ও প্রতিবাদ করেছে। ইতিমধ্যেই নেপাল ও পাকিস্তান প্রতিবাদ জানিয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন মহলের বক্তব্য, এই অঞ্চলে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনকারী একমাত্র দেশ হওয়া সত্ত্বেও হাসিনা সরকার এখন নীরব থাকলে বাংলাদেশের জনগণ মেনে নেবে না। বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, বাংলাদেশকে অন্য কোনও দেশের অবিভক্ত মানচিত্রের অংশ হিসেবে দেখানো দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকির নামান্তর। তবে প্রতিবেশীরা যতই বিরোধিতা করুক না কেন, মোদি সরকারের তাতে কোনও হেলদোল নেই। উল্টে মোদি সরকারের সংসদীয় মন্ত্রী প্রহ্লাদ জোশী তাঁর ট্যুইটে নতুন সংসদ ভবনে ‘অখণ্ড ভারতের’ ম্যুরালের ছবি দিয়ে মন্তব্য করেছেন, ‘সংকল্প স্পষ্ট, অখণ্ড ভারত।’

Latest article