পেশির দুর্বলতা

মানুষের শরীরের প্রত্যেকটি জয়েন্ট বা অস্থি-সন্ধি নড়াচড়ার ক্ষেত্রে মাংসপেশির ভূমিকাই প্রধান। মাংসপেশি যতক্ষণ কর্মক্ষম, সবল থাকে মানুষ ততক্ষণ সুস্থ স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারে। কেন হয় পেশি দুর্বল? এর চিকিৎসাই বা কী? আলোচনা করলেন বিশিষ্ট হোমিওপ্যাথ ডাঃ প্রকাশ মল্লিক। শুনলেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

মানবদেহের প্রত্যেকটি মাংসপেশিরই নির্ধারিত কাজ রয়েছে তাই শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য নির্ধারিত মাসল, হাত-পায়ের বিভিন্ন জোড়া বা অস্থিসন্ধি নাড়ানোর জন্য নির্ধারিত মাসল, পেটের মাসল, ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য নির্ধারিত মাসল রয়েছে। কোনও মাংসপেশি যদি তার নির্ধারিত কাজ করতে না পারে বা কম করে তবে বুঝতে হবে ওই মাসল বা মাংসপেশিতে কোনও সমস্যা রয়েছে।
এক বা একাধিক পেশির শক্তিক্ষয়ের কারণে পেশি দুর্বল হয়ে যায় যাকে বলে মায়াস্থেনিয়া।
পেশির দুর্বল হওয়ার লক্ষণ
পেশিতে পর্যাপ্ত পুষ্টির অভাব এবং ডারমাটোমাইওস্টিস (পেশি জ্বালা বা যন্ত্রণা) পেশির দুর্বলতার অন্য লক্ষণ।
স্নায়বিক সমস্যা যেমন গুলিয়ানবারে সিনড্রোম এটা পেরিফেরাল নার্ভ সিস্টেম ডিজঅর্ডার।
অ্যামায়োট্রফিক ল্যাটারাল স্কোরোসিস, যা লৌহ গেহরিক রোগ নামেও পরিচিত।
স্ট্রোক এবং আশেপাশের টিস্যু দ্বারা স্নায়ুতে চাপ ইত্যাদি হল এই সমস্যার অন্যান্য লক্ষণ।
হজমের সমস্যা, যেমন অ্যাডিনশন রোগ এবং হাইপারথাইরোডিসিমের জন্য এক বা একাধিক পেশি দুর্বল হয়ে যায়। এই দুর্বলতা একটা পেশি কিংবা একাধিক পেশিতে হতে পারে কিংবা পেশিতে ছড়িয়ে পড়তে পারে। দুর্বলতার পাশাপাশি ব্যথা, ক্ষয়, খিঁচুনিও হয়। পেশির দুর্বলতা আচমকা হলে এবং সেটা যদি শরীরের একপাশে হয়, তাহলে সেটা স্ট্রোকের লক্ষণ। প্রচণ্ড পেটে ব্যথা কিন্তু খাদ্যে বিষক্রিয়ার লক্ষণ। লক্ষণ বোঝা গেলে দ্রুত চিকিৎসার দরকার।

আরও পড়ুন-২৩-২৬ প্রভাবিত ৯ জেলায় স্কুল-ছুটি — যাচ্ছেন সচিবরা, ডানা মোকাবিলায় প্রস্তুত রাজ্য, নবান্নে জরুরি বৈঠক মুখ্যমন্ত্রীর

পেশি কী কারণে দুর্বল হয়
পেশির দুর্বলতার নানা কারণ। যেমন অ্যাড্রিনাল গ্রন্থির হরমোনের উৎপাদন কমে যাওয়া।
হাইপারথাইরোডিসম
হাইপারথাইরোডিসম, সোডিয়াম, পটাশিয়াম কমে গেলেও পেশি দুর্বল হয়। স্নায়ু-সংক্রান্ত কারণে পেশি দুর্বল হয়। এক্ষেত্রে বেলস পালসি বা সেরিব্রাল পালসি হতে পারে। জিনগত রোগ, স্কেরোসিসও পেশির দুর্বলতার অন্যতম কারণ। এছাড়া অ্যানিমিয়া বা রক্তাল্পতা, পেশির অতিরিক্ত ব্যবহার, পলিমাইসিটিস বা পেশির বিস্তৃত জ্বালা-যন্ত্রণা ও দুর্বলতা, অতিরিক্ত কাজ কিংবা হেভি ট্রেনিং, মাসল ক্রাম্প বা কোনও কারণে মাংসপেশিতে খিঁচুনি হলে, মাংসপেশি থেঁতলে গেলে মাংসপেশিতে টান পড়লে বা কোনও আঘাতের কারণে যদি মাংসপেশি সম্পূর্ণ বা আংশিক ছিঁড়ে গেলে বিভিন্ন রকম বাতরোগ ইত্যাদির কারণেও মাংসপেশিতে ব্যথা হয়, নির্দিষ্ট কিছু অসুখ, স্ট্রোক বা বিভিন্ন রকম নিউরোলজিক্যাল কারণে নার্ভের সাপ্লাই না পেলে মাংসপেশি অবশ হয়ে দুর্বল হয়ে যায়।
চিকিৎসা
মাংসপেশির ব্যথার চিকিৎসার জন্য অনেক সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। মাংসপেশির ব্যথার চিকিৎসায় সাধারণত ব্যথা কমানোর ওষুধ না খাওয়াই ভাল। ওই ধরনের ওষুধে সাময়িকভাবে ব্যথা কমলেও সম্পূর্ণ নিরাময় হয় না। ব্যথানাশক ওষুধ মূলত কাজ করে প্রোস্টাগ্লান্ডিন তৈরিতে বাধাদানের মাধ্যমে। প্রোস্টাগ্লান্ডিল শরীর ফোলা ও ব্যথার জন্য দায়ী। মাংসপেশির ব্যথার চিকিৎসার জন্য ফিজিওথেরাপি একমাত্র পথ। কারণ ফিজিওথেরাপিস্টরা প্রত্যেকটি মাংসপেশির সঠিক অবস্থান এবং তাতে কোনও ত্রুটি রয়েছে কিনা, ত্রুটি থাকলে তা কোন ধরনের তা নির্ণয় করতে পারদর্শী। মাংসপেশির শক্তি কমে গেলে শক্তি বাড়ানোর জন্য স্ট্রেনদেনিং টেকনিক, খিঁচুনি হলে বিভিন্ন রকম স্ট্রেচিং এক্সারসাইজ, মাংসপেশির টেনডন যদি আংশিক ছিঁড়ে যায় তবে ডিটিএফ, পিএমএফ এবং আলট্রাসাইন্ড ইত্যাদি মাংসপেশির ব্যথার কারণ অনুযায়ী ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা দ্রুত কাজ করে। একজন অভিজ্ঞ ফিজিওথেরাপিস্টের সঙ্গে কথা বলাই ভাল।
এবার খেলোয়াড়দের মাসল ক্র্যাম্প— পায়ের মাংসপেশিতে টান নিয়ে আলোচনা শুরু করা যাক।
ঘুমিয়ে আছেন হঠাৎ পায়ের মাংসপেশির টানের ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলেন আপনি। এমতাবস্থায় পা সোজা বা ভাঁজ করা সম্ভব না। একটানা পা ভাঁজ করে রেখে হঠাৎ সোজা করতে গেলে পায়ের পেশিতে টান পড়ে। তখনই পায়ের পেশিতে বা রগে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভূত হয়। এমনটা ঘুমের মধ্যে বা জেগে থাকা অবস্থাতেও হতে পারে। তবে ঘুমন্ত অবস্থায় বেশি হয়ে থাকে।

আরও পড়ুন-তদন্ত না করেই সিদ্ধান্ত, হাইকোর্টে ৫৯ ডাক্তারের সাসপেনশন স্থগিত

পেশি দুর্বলতার উপসর্গ
পেশির জ্বালা।
বারবার পড়ে যাওয়া অর্থাৎ পেশির সমন্বয়ে ঘাটতি।
পেশি খিঁচুনি বা ব্যথা, পিন বা ছুঁচ ফোটানোর মতো ব্যথা লাগা।
পক্ষাঘাত।
হালকা টানের অনুভূতি।

এ ছাড়া অন্যন্য কিছু শারীরিক লক্ষণও থাকে পেশি দুর্বলতার। যেমন—
অস্পষ্ট বা ঝাপসা কিংবা ডবল দৃষ্টিশক্তি।
কথা বলার সময়ে এবং খাবার গিলতে গিয়ে সমস্যা।
ডায়ারিয়া।
ক্লান্তি, অবসাদ ও মাথাব্যথা, জ্ঞান হারানো।
হাঁটাচলা এবং কথা বলতে সমস্যা, স্মৃতিভ্রংশ।
বমি বমি ভাব।
চোখ ফুলে যাওয়া, কারণ ছাড়া ওজন কমে যাওয়া, গরম সহ্য করতে না পারা, ঘাম এবং গলগণ্ড।
মেরুদণ্ড বেঁকে যেতে পারে।
চিকিৎসা
পেশি দুর্বলতার কারণের ওপর চিকিৎসা নির্ভর করে। পেশির কার্যকারিতা বৃদ্ধি এবং জটিলতার ঝুঁকি কমানোই হল চিকিৎসার লক্ষ্য। পেশির ক্ষয়ের ক্ষেত্রে চিকিৎসার পরে পুনরায় স্বাভাবিক জীবনযাপন করা সম্ভব। যথাযথ বিশ্রাম, পর্যাপ্ত জল ও পুষ্টিকর খাদ্য এবং নিয়মিত সেবাযত্ন চিকিৎসার অন্তর্গত এবং পাশাপাশি রিহাব, ফিজিক্যাল থেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপি এবং নিয়মিত শরীরচর্চা দরকার। অনেক সময় বিষয়টি গুরুতর হলে রোগীর হাঁটতে চলতে সাহায্যের জন্য অর্থোপেডিক স্পিলন্টস, ছড়ি, ক্র্যাচ এবং অথবা একটা ওয়াকর ইত্যাদির প্রয়োজন পড়ে।
করটিক স্টেরয়েড মেডিকেশনে কোনও কোনও সময়ে স্নায়ুতন্ত্রের জ্বালা বা যন্ত্রণা কমাতে ব্যবহার করা হয়।
রক্তাল্পতার কারণে পেশি দুর্বল হলে এবং কোনও অন্তর্নিহিত কারণের জন্য রক্তাল্পতা হলে, রক্ত দিয়ে চিকিৎসা করা হয়।
এছাড়া কারণ, লক্ষণ ও মায়াজম মিলিয়ে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করলেও সুফল পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে যেসব ওষুধ ব্যবহার করে সুফল পেয়েছি সেগুলি হল ব্রায়োনিয়া, রাসটক্স, চায়না, এভেনা সাটাইভা প্রভৃতি। তবে কখনওই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ খাওয়া উচিত নয়।

Latest article