প্রতিবেদন : আজ মহানবমী। পুরাণ মতে, আজই অসুরবধের মহাতিথি। অশুভের সংহারে শুভ শক্তির বিজয় ঘোষিত হওয়ার দিন। তিথি-তাৎপর্যে বিশেষত্ব অন্বেষণে শাস্ত্র-পুরাণ থেকে সমাজ ইতিহাসের পাতায়
দেবাশিস পাঠক। অদ্য মহানবমী। প্রথম দণ্ডে বলিদান। তারপর ১০৮টি প্রদীপ প্রজ্বলন। মহানবমী প্রথমদণ্ডে এব বলিদানং কৃত্বা, বলিদানানন্তরং অষ্টোত্তরশত সংখ্যকদীপমানং কুর্য্যাৎ।পুজোর শুরুতেই বলি দেওয়ার বিধান! কেন?কারণ, এই মহাতিথিতেই বিনষ্ট হয় অশুভ শক্তি। আসুরিক শক্তি। কালে কালান্তরে। যুগে যুগান্তরে।
নবমীতে দেবী দুর্গা নিধন করেছিলেন মহিষাসুরকে। নবম্যামুপহারৈস্তু পূজিতা মহিষাসুরম। কালিকাপুরাণের এই শ্লোক জানান দিচ্ছে, নবমীতে দেবী মহিষাসুরকে বধ করেন এবং দেবতারা তাঁকে নানা উপচারে পুজো করেন। এটা হল কালিকাপুরাণের ৬০ অধ্যায়ের ৮১ তম শ্লোকের প্রথমাংশ।
ওই পুরাণের ওই অধ্যায়েরই ৩২ নং শ্লোকে অন্য যুগে রাবণ বধের প্রসঙ্গ এবং সেই উপলক্ষে দেবীর পূজিত হওয়ার সংবাদ। নিহতে রাবণে বীরে নবম্যাং সকলৈঃ সুরৈঃ। বিশেষ পূজা দুর্গায়াশ্চক্রে লোকপিতামহঃ।। নবমীতে রাক্ষসরাজ রাবণকে বধ করলেন শ্রীরামচন্দ্র। দেবীর অকাল বোধন করে যে শক্তি অর্জন করেছিলেন তিনি, তারই অনিবার্য পরিণামে এই রণ-সাফল্য। রাবণ নিধনের পর সকল দেবতাকে নিয়ে পিতামহ ব্রহ্মা দেবী দুর্গার বিশেষ পূজায় মগ্নচিত্ত হলেন। মহিষাসুর হোক বা রাবণ, অসুর হোক বা রাক্ষস, অশুভের নিধন সম্পন্ন হল নবমীতে। তাই, তাই-ই, প্রথমদণ্ডে বলিদান। সংকেতিত নিধন প্রক্রিয়া। অশুভের বিনাশে তমসাচ্ছন্ন প্রহরের সমাপন। প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে তখন মহাশক্তির আরাধনা।
আরও পড়ুন : পিছনের দরজা দিয়ে নাক গলাচ্ছে”, BSF-এর ব্যপ্তি বাড়ানোয় কেন্দ্রকে নিশানা কুণালের*
তারই ইশারা ১০৮টি প্রদীপ প্রজ্বলনের প্রথায়। প্রদীপ শিখায় শুভের আলো প্রকটিত। এই পুজো, এই আনন্দ প্রহর, এই উৎসব প্রসৃতি, যুগপৎ আধ্যাত্মিক ও ধর্মনিরপেক্ষ. ধর্মীয় ও ধর্মাচরণের সীমা বহির্ভূত।নবমীর পুজোয় অঞ্জলি দেওয়া থেকে ভোগ খাওয়া, সবেতেই এই উভমুখিনতা সুস্পষ্ট। সাধক বলেন, এই যে মন্ত্রযুক্ত পুষ্পাঞ্জলি প্রদান অনুষ্ঠান, এর প্রসাদ হল চিত্তপ্রসন্নতা, এর ফলে লব্ধ ধন মাতৃ-মহত্বের অনুভূতি। আর ওই যে নবমীর ভোগ খাওয়া, ওতে পঞ্চকোষের পুষ্টিবিধান হয়। অন্নভোগ কোনও তুচ্ছ বিষয় নয়ে। দেবীসূক্তে স্বয়ং অম্ভৃণ ঋষির কন্যা বাক্ রূপী জগজ্জননী দেবী বলেছেন, ‘ময়া সো’ন্নমত্তি’। আমিই অন্ন। অর্থাৎ জীব স্থূল দেহ রক্ষার জন্য হোক কিংবা মনোময়াদি সূক্ষ্ম দেহ পরিপুষ্ট করার জন্যই হোক, যে আহার গ্রহণ করে থাকে, সেটা আমি, আমিই। সেটা দেবী, দেবীই। দেবীর অন্নভোগ আসলে দেবী স্বয়ং।
আর এই অঞ্জলি, আরতি, হোম থেকে শুরু করে ভোগ দেওয়া ও খাওয়া, এসব আচারের আধ্যাত্মিক তাৎপর্যে মিশে থাকে অর্থনীতি। দুর্গাপুজোয় লক্ষ্মীর ছোঁয়া। হিসাব বলছে, পশ্চিমবঙ্গের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জি ডি পি-র ২.৫৮ শতাংশ আসে এই উৎসব, আরাধনা, অর্চনা, এই হোম, আরতি, অঞ্জলি, ভোগদান, এসবের ফলশ্রুতি হিসেবে।
নবমী পুজোর অপরিহার্য অঙ্গ হোম বা যজ্ঞানুষ্ঠান। অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ তাঁর রচনায় স্পষ্ট বলেছেন, যজ্ঞবেদী বিবর্তিত হয়ে দুর্গার রূপ পরিগ্রহ করেছে। বৈদিক সাহিত্যে দেখা যায় প্রজাপতি দক্ষ অনেক যজ্ঞ করেছিলেন। এজন্যই বৈদিক যুগে যজ্ঞবেদীর আর এক নাম ছিল ‘দক্ষ-তনা’ অর্থাৎ দক্ষের তনয়া। ঋক্ বেদ (৩.২৭.৯)-এর সূক্ত বলছে ‘দক্ষস্য পিতরং তনা।‘ যজ্ঞবেদীতে জ্বলত আগুন। আগুন হল রুদ্র। রুদ্রই শিব। তাই-ই বলা হল, শিবের সঙ্গে দক্ষকন্যার বিবাহ হল। এটা আসলে অগ্নি আর দুর্গার অচ্ছেদ্য সম্পর্ক বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত উপমা। আর দুর্গার দশ হাত আসলে যজ্ঞবেদীর দশ দিক – উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম, ঈশান, অগ্নি, বায়ু, নৈঋত, ঊর্ধ্ব এবং অধঃ। বৈদিক যুগে ব্রাহ্মণরা এই যজ্ঞকুণ্ডে পীতবর্ণের একটি মূর্তি স্থাপন করতেন। সেই মূর্তিকেই ‘হব্যবাহিনী’ বা ঘৃতবহনকারী অগ্নিরূপে পূজা করতেন তাঁরা। এই মূর্তিই নাকি পরবর্তীকালে দুর্গা মূর্তি নামে পরিচিত হয়।
ঋকবেদের কথা থাক, এখনকার কথায় আসি। দক্ষিণ ২৪ পরগণার ক্যানিংয়ের কাছে ভট্টাচার্য বাড়ি। আদি বাড়ি বাংলাদেশের বিক্রমপুরের রানিখারা গ্রাম। এখানে অর্ধকালী-অর্ধদুর্গা মূর্তি পুজিতা হন। এই পুজোয় পারিবারিক প্রথা মেনে নবমীর দিন চালের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি হয় মানুষের মূর্তি। শত্রু হিসেবে সেই মূর্তিকে বলি দেওয়া হয়। তারপর তিনটি খণ্ডে সমাধিস্থ করা হয় সেটিকে।
বাংলা নবমী পুজোর এই বলিদান পর্ব দেখে ফেলেছে গত মে মাসেই, বিধানসভা নির্বাচনে। দেশের কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-যুবর শত্রু বলি প্রদত্ত হয়েছে বাংলার বুকে জনাদেশের যূপকাষ্ঠে। এবার তাঁকে তিনটি খণ্ডে সমাধিস্থ করার পালা। বঙ্গে গেরুয়া অসুরের একটি খণ্ড সমাধিস্থ। বাকি দুটি খণ্ডের একটিকে সমাধিস্থ করতে হবে আগামীতে, প্রতিবেশী রাজ্যে। তারপর দিল্লিতে, কেন্দ্রে। ২০২৪-এ।
“আর কতকাল থাকবি বেটি মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল?/স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল।/ দেবশিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবকদের দিচ্ছে ফাঁসি, / ভূ-ভারত আজ কসাইখানা, আসবি কখন সর্বনাশী?”
নজরুলের ভাষায় জানতে চাইছে দেশবাসী। এই নবমীতে।
অসুরনিধন সেরে প্রদীপ জ্বালনোর জন্য তৈরি আসমুদ্র হিমাচল। এই নবমীতে।ভক্তেভ্যোঃ বরদে দেবি মহিষাগ্নি নমো’স্তুতে। ভক্তকল্যাণে এবার কেন্দ্রীয় স্তরে অসুর সংহারের বর দিন মহিষাসুরমর্দ্দিনী। এই নবমীতেই।