প্রথম পাতা
নাগাল্যান্ড চলেছি বিখ্যাত হর্নবিল ফেস্টিভ্যাল দেখতে। এই কথা শোনার পর আমার চেনা-জানা প্রায় লোকই অবাক হয়েছে আর আঁতকে উঠেছে ট্রেনে একা যাচ্ছি শুনে। কিন্তু সারাটা ট্রেনপথ চমৎকার কেটেছে। সেই অতীতে যখন বেড়াতে যাওয়া হত ঠিক সেরকম, সহযাত্রীদের সঙ্গে খাবার ভাগ করে খেয়েছি, প্রচুর গল্প করেছি। ‘অচেনা লোকের কাছে কিছু খাবেন না’ সতর্কবাণী মাথায় রেখেও মিষ্টি খেয়েছি গৌহাটির হঠাৎ-দাদার কাছ থেকে। আসলে ভাল মানুষ চেনা যায়, তার চোখ বলে দেয়। যারা চিনতে পারে তাদের জন্য বসুধৈব কুটুম্বকম। গোটা রাস্তায় হর্নবিল উৎসব নিয়ে অনেক কথা হল। কথা হল নাগাল্যান্ডের নামে বুক কেঁপে ওঠা অতীত নিয়ে। নিজের দেশ, তবু আজও ভারতীয়দের ইনার লাইন পারমিট লাগে এখানে প্রবেশের জন্য। ধারণা ছিল গৌহাটিতে ট্রেন খালি হয়ে যাবে আর আমি একা এক গহন জঙ্গলে প্রবেশ করব, যেখানে নাকে হাড়ের নোলক, মাথায় পালক, রঙিন কোমরবন্ধ পরে কিছু অর্ধ-উলঙ্গ মানুষ চিলি চিকেনের মতো ‘চিলি চৈতালী’ নামক একটা নতুন ডিশ ট্রাই করার জন্য ম্যারিনেট করতে আসবে। কিন্তু অনেক সহযাত্রীর সাথেই ট্রেনের ড্রাইভার ঘড়ি মিলিয়ে ডিমাপুরে নামিয়েছে। বাইরে এসে দেখি রীতিমতো মানুষজন ঘুরছে, অটো রয়েছে, ঝলমলে আলো দিয়ে রাস্তা সাজানো। সরকারি ট্যুরিস্ট লজ একদম স্টেশনের বাইরে বেরিয়েই। ট্যুরিস্ট লজে মেনু কার্ডে স্বাভাবিক খাবার পাওয়া যায় দেখে কুকুর-আতঙ্ক একটু হলেও কমল।
আরও পড়ুন-রাস্তা নিয়ে টক টু মেয়র-এ অভিযোগ পেয়ে কড়া বার্তা
পাতার ভাঁজে চিরকুট
হর্নবিল উৎসব আসলে নাগাল্যান্ডের একটি বিখ্যাত উৎসব যেটা দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও নাম কিনে নিয়েছে। ২০০০ সালে ১ ডিসেম্বর নাগাল্যান্ডে কোহিমার কাছে কিসামা হেরিটেজ ভিলেজে মূলত নাগা জনজাতির এই উৎসব শুরু হয়। তার পর থেকে এই উৎসবের কথা বিভিন্ন ভাবে প্রচার পেতে পেতে দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়ে। এবছর সেই উৎসবের রজত জয়ন্তী বছর, আর তাই আয়োজন খুবই বেশি।
দ্বিতীয় পাতা
ডিমাপুরে ট্যুরিস্ট লজের প্রশস্ত বাগান সকালে হাঁটিয়ে মানুষজনদের ভাল লাগবে। রাস্তার বিপরীতে সামনেই দেখতে সুন্দর আরও হোটেল রয়েছে, রয়েছে রাজস্থানি নিরামিষ ভোজনালয় আর একটা মস্ত বেকারি। দেখতে দেখতেই সময় এসে গেল কোহিমা হয়ে কিগেওয়ামা যাওয়ার। পাহাড়ি অথচ প্রশস্ত পথ, অনেকটা উপত্যকা ভাব। পথের ধারে জুডকা ভিলেজে একটা চায়ের দোকানে বাংলা ভাষায় আপ্যায়ন আর বসে চা খেতে খেতে নাগাল্যান্ডের সূর্যোদয় দেখা বেশ আনন্দের। কোহিমায় ওয়ার সিমেট্রি দেখে মন ব্যথায় ভরে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ সেনার হাতে যাঁরা প্রাণ দিয়েছেন তাঁরা ঘুমিয়ে আছেন যে আজ কবরে। তবে আছেন তাঁরা পরম আদরে ফুলের বাগানে। ধাপে ধাপে কবর, পাশে গোলাপ, ক্যামেলিয়ার সযত্ন ফুলের থোকা, চেরি ব্লসমের রঙের বাহার, সবুজ ঘাসের মখমলি বিছানা। এত কিছুর পরে কিগেওয়ামায় রবি দিদির ডন হোমস্টেতে পৌঁছে ব্রেকফাস্ট। এরপর তড়িঘড়ি পৌঁছনো কিসামা হেরিটেজ ভিলেজে, উৎসব ময়দানে। হর্নবিল উৎসব শুরু সকাল দশটায়। প্রতি দু’ঘণ্টা একদফা করে মাঠে অনুষ্ঠান। রাতে স্টেজে ডিজে আর বিভিন্ন গান। বিগত দিনের পথযাত্রার ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয় উৎসবের ছন্দ বর্ণ আর নাচের আনন্দ। রাতে সুরের মূর্ছনা।
পাতার ভাঁজে চিরকুট
কিগেওয়ামা গ্রামে রবিটোনো দিদির ডন হোমস্টে। মুখের হাসি দিদির বড় সম্পদ। আতিথেয়তা বাঙালি মায়েদের মতোই। খান দশেক ঘর আর চাহিদামতো কিছু টেন্ট নিয়ে দিদির বেশ বড় সংসার। সবার যত্নের দিকে দিদির খেয়াল খুব। ব্রেকফাস্ট বুফে— পরোটা, মটরের ঘুগনি, ব্রেড, ডিমসেদ্ধ, জ্যাম, চা-কফি-কুকিস। লাঞ্চ-ডিনারেও বুফে— ভাত, রুটি, ডিমকারি, ডাল,সবজি, পর্ক, চিকেন, পাঁপড়, আচার।
আরও পড়ুন-অভিনন্দন ইলন মাস্কের, গুকেশ কৃতজ্ঞ আপটনের কাছে
তৃতীয় পাতা
পুবদিকে সকাল তো তাড়াতাড়ি হবেই। তাই সব কাজ তাড়াতাড়ি। ব্রেকফাস্ট সেরে রাস্তায় এসে দাঁড়াতে ফ্রি শাটল বাস মিলে যায় উৎসব ময়দানে যাওয়ার। গেটে ১০০ টাকার টিকিট কেটে মেলায় ঢোকা। মেলা আর উৎসবের চরিত্র সব জায়গাতেই একই রকম। আগে ভোজন পরে ভজন। অর্গানিক স্টল— রকমারি বাঁশ দেওয়ার জন্য তৈরি সবাই। বাঁশের চাটনি, স্যুপ, লোকাল বিনস, চাল। এরপর ওয়ার মিউজিয়াম। বিখ্যাত কোহিমা যুদ্ধের কয়েকটা পাতা, চোখে দেখার, ফিরে দেখার। এবার মূল চত্বরে প্রবেশ। নাগাদের আঠারোটা উপজাতি দলবদ্ধ ভাবে এখানে অনুষ্ঠান করে। প্রত্যেক উপজাতির এক-একটা মডেল বাসস্থান রয়েছে এখানে, সেগুলোকে মোরঙ বলে। এক-একটা মোরংয়ের খাবার, পোশাক জিনিসপত্র একেকরকম। মোরঙে বিক্রি হচ্ছে হাতের কাজ, স্থানীয় খাদ্যদ্রব্য। শুয়োরের মাংস, কুকুরের মাংস নানারকম স্থানীয় গাঁজানো কার্বোহাইড্রেট এসবের বিরতিহীন চাহিদা। এরপর আসে নাগাল্যান্ড হ্যান্ডিক্রাফট প্যাভিলিয়ন। স্থানীয় পোশাক, হাতের কাজ, বাঁশের খোল, মোষের শিং দিয়ে তৈরি পানপাত্র, অস্ত্র, রকমারি অ্যালকোহলিক পানীয়, পাথর আর পুঁতির তৈরি গহনা নিয়ে দুটি তলা জুড়ে প্যাভিলিয়নে যত লোক তত বিক্রি। দাম হিসেবমতো বেশ চড়া। স্টেডিয়াম জুড়ে উৎসবের ফুলসাজে পঁচিশের পালন। গলায় কার্ড ঝোলানো কর্তৃপক্ষের লোকজন সদা সতর্ক। কোনওরকম অসংলগ্ন বা অসভ্য আচরণের ভাবনাও নেই কারওর মধ্যে, অথচ সদাই পানপাত্র হাতে। রাত বাড়লে আলোকসজ্জায় উৎসব ময়দান রঙিন হয়। সঙ্গীত সন্ধ্যায় স্টেডিয়াম তখন স্বর্ণালী। না বোঝা কথার মন কাড়া সুর হৃদয় মাতায়, পা নাচে নিজের থেকে। দশটা পর্যন্ত অনুষ্ঠান আর ফ্রি সার্ভিস বাস নামিয়ে দেয় আমাদের ডন হোমস্টে, কিফুজা সেক্টর।
পাতার ভাঁজে চিরকুট
নেবারল্যান্ড নয়, নেদারল্যান্ডও নয়, নাগাল্যান্ডের ইতিহাস খুব প্রাচীনও নয়। অথচ ভূগোল বইয়ে নাগা পর্বতের কথা লেখা আছে আদিকাল থেকে। যোদ্ধা জাতি নাগাদের মধ্যে কুড়িরকম জনজাতি এবং বহু উপজাতি। আগে ছিল অসমের অংশ। স্বাধীনতার পর নাগাদের অনেক লড়াইয়ের ফল ১৯৬৩ সালে স্বাধীন নাগাল্যান্ড রাজ্য। অন্য উপজাতির মানুষ মেরে তার মাথা কেটে গলায় ঝোলানোর সংখ্যার মধ্যেই থাকত বীরত্বের হিসেব। নাগাল্যান্ডে খায় না এমন মাংস নেই। পোকা ও ফড়িং ভাজা চিপসের মতো খাচ্ছে অনেকেই উৎসবে। ডগ মিল ৫০০ লেখা আছে মোরঙয়ে। কুকুরকে খাবার খাইয়ে তাকে ঘুরিয়ে বমি করানো এবং সেটাকে খাবার হিসেবে নেওয়া এটাও কোনও গল্পকথা নয়, এখনও রীতিমতো প্রচলিত। স্থানীয়রা খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিতের সংখ্যা বেশি। এক সপ্তাহের মধ্যে কোনও মন্দির চোখে পড়েনি।
আরও পড়ুন-শিক্ষাব্যবস্থার মুকুটে আরও এক পালক! NAAC-এর সেরা তকমা রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়কে, গর্বিত মুখ্যমন্ত্রী
চতুর্থ পাতা
ঘুম থেকে উঠে চোখে পড়ে চারিদিকে পাহাড় ঘেরা কিগেওয়ামার সবুজ সকাল। পাহাড় এত সবুজ যে কখনও কখনও মনে হয় ঘাস জমি দাঁড়িয়ে আছে লম্বাটে হয়ে। দূরের দিকে তাকালে মন ভাল হয়ে যায় নিমেষেই। সবুজ পাহাড় যদিও বরফ চূড়া নেই, শান্ত অথচ প্রাণবন্ত। আবহাওয়া এই ডিসেম্বরেও মনোরম। রবি দিদি ভালবেসে আজ পরোটার বদলে গোলা রুটি বানিয়েছে ব্রেকফাস্টে।
কিসামা গ্রামে হর্নবিল উৎসবের মূল প্রাঙ্গণ এক স্টেডিয়াম। গ্যালারিতে দেশি-বিদেশি দর্শক উপচে পড়ছে। স্টেজে নাম ঘোষণা হচ্ছে আর সেই উপজাতির কমপক্ষে কুড়ি থেকে চল্লিশজনের নারী-পুরুষের মিলিত একটি দল মাঠে ঢুকছে নিজেদের গোষ্ঠীর সাজগোজ করে। পরিবেশন করছে নাচ-গান-সহ বিশেষ এক একটি ঘটনা। কেউ ফসল তোলার নাচ। কেউ পরিবেশন করছে মদ বানানোর আর বিতরণের নাচ। কেউ পরিবেশন করছে বীজ বপনের সুরেলা গানের সঙ্গে নাচ। একেক উপজাতির পোশাক, ভাষা, উপস্থাপনা একেক রকম। জিল নামে এক উপজাতি দেখাল গ্রামে বাঘ ঢুকেছে, তাকে বীরেরা মেরে ফেলছে এবং আনন্দ করছে এরকম একটা অনুষ্ঠান। ভাষা না বুঝেও ন্যারেটারের বোঝানো আর পরিবেশনের গুণে সম্পূর্ণ ভিন্ন কালচারের ঘটনাও বোঝা যায়, অনুভব করা যায়, আনন্দ পাওয়া যায়। সব নাচ-গানেই ফুটে ওঠে তাঁদের জীবনযাপনের টুকরো কথা, টুকরো ব্যথা, যৌথজীবন যাপনের সারল্য।
পাতার ভাঁজে চিরকুট
নাগাল্যান্ড রাজ্য। বিপুলসংখ্যক নাগা জনজাতির বাসভূমি৷ এই প্রতিটি জনজাতির নিজস্ব উৎসব আছে৷ যেহেতু ৬০%-এরও অধিক নাগা লোক কৃষির ওপর নির্ভরশীল, তাঁদের উদযাপন করা প্রায়ভাগ উৎসবই কৃষির সঙ্গে জড়িত৷ নাগাল্যান্ডের এই বিভিন্ন জনজাতির মধ্যে ভাববিনিময়ের বিকাশ এবং নাগাল্যান্ডের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রসারের জন্য, নাগাল্যান্ড সরকার ২০০০ সাল থেকে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহটিতে হর্নবিল উৎসব পালন করে আসছে৷ এই উৎসব ভারতীয় ধনেশ পাখির নাম থেকে হর্নবিল উৎসব নামে অভিহিত করা হয়৷ ধনেশ পাখির স্থান নাগা জনজাতিসমূহের সংস্কৃতি এবং লোকসাহিত্যে অতি গুরুত্বপূর্ণ৷
আরও পড়ুন-‘এক ডাকে অভিষেক’-এ ফোন করেই মুশকিল আসান! রাতারাতি কৃষকের ঘরে ফিরল আলো
শেষ পাতা
কিগেওয়ামা থেকে সকাল সকাল বেরোলে কোহিমা, ডিমাপুর ঝাঁকি দর্শন সেরে ডিমাপুর থেকে শেষ রাতে ট্রেন ধরব। কোহিমায় বিশাল ক্যাথিড্রাল চার্চ। নাগাদের বাড়ির সামনের স্টাইলে এই চার্চ বানানো হয়েছে। বিরাট বলে বোঝানো যাবে না বিশাল এই চার্চকে। ভগবানের আসন্ন জন্মদিন উপলক্ষে সেজে উঠেছে এই উপাসনা চত্বর। এখন থেকে সামনে থেকে কোহিমা শহরকে খুব ভালভাবে দেখা যায়। বাড়ির বড়ই বাড়াবাড়ি, গাছ প্রায় নেই, পাহাড়ি শহরের পক্ষে যা একটু দৃষ্টিকটু। নেতাজির প্রথম স্বাধীন ভারতের পতাকা তোলার স্থান গ্যারিসন হিলকে কেউ মনে রাখেনি, নিষ্ঠুর রাজনীতির চক্করে নেতাজির মতোই বিস্মরণের পথে। তবু কোহিমার মহিমা বাঙালির স্মৃতিতে থাকবে সবদিন। ডিমাপুরে কাছাড় রাজবংশের ধ্বংসাবশেষ আছে, সায়েন্স সিটির কাছে। এবারের মতো নাগাল্যান্ডের ডায়েরি শেষ। নাগাল্যান্ডের সবুজ পাহাড়, সরল জীবন, আনন্দময় রঙিন হর্নবিল উৎসব বড়ই ভাল লেগেছে। কোনও দিন আবার আসিব ফিরে, ধানসিঁড়িটির তীরে এই ডিমাপুরে।
পাতার ভাঁজে চিরকুট
ডিমাপুর রাজধানী না হলেও নাগাল্যান্ডের সবচেয়ে বড় শহর। আরও পাঁচটা বড় শহরের মতো এখানে নগর জীবনের পরিপাটি বন্দোবস্ত আছে। ঘোরাঘুরির জন্য একটা গোটা দিন বরাদ্দ রাখলে খুবই ভাল লাগবে। দেশের নানা প্রান্তের সঙ্গে রেল, সড়ক এবং বিমানপথে ডিমাপুর যুক্ত। এখানে দূষণ আর কোলাহল একটু কম। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ধানসিঁড়ি নামে একটি ছোট্টনদী।