জাতীয় পুরস্কারের সঙ্গে বাংলার যোগ নতুন নয়। শুরু থেকেই। অনেকেরই স্মরণে আছে, প্রথম বছর সেরা অভিনেতার জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন এক বঙ্গসন্তান। তিনি মহানায়ক উত্তমকুমার। ১৯৬৭ সালে তাঁর হাতে এই পুরস্কার উঠেছিল। সুনীল বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত ‘এন্টনী ফিরিঙ্গী’ এবং সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘চিড়িয়াখানা’ ছবির জন্য। ‘এন্টনী ফিরিঙ্গী’ ছবিতে মহানায়ক অভিনয় করেন অ্যান্টনি কবিয়ালের চরিত্রে। ‘চিড়িয়াখানা’ ছবিতে ফুটিয়ে তোলেন সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ বক্সির চরিত্র। সেইসময় দুটি ছবিই দারুণ সাফল্য পেয়েছিল। পরের বছর এই পুরস্কার পেয়েছিলেন আরও এক বাঙালি অভিনেতা অশোককুমার। হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ‘আশীর্বাদ’ ছবির জন্য। তৃতীয় বছর, ১৯৬৯ সালেও সেরা অভিনেতার জাতীয় পুরস্কার পান বাঙালি অভিনেতা, উৎপল দত্ত। মৃণাল সেন পরিচালিত ‘ভুবন সোম’ ছবির জন্য।
আরও পড়ুন-রবি না শনিতেই বীরভূম যাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী
পরবর্তী সময়ে বাঙালি হিসেবে সেরা অভিনেতার জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন আরও অনেকেই। মিঠুন চক্রবর্তী তাঁর প্রথম ছবি ‘মৃগয়া’র জন্য এই পুরস্কার পেয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে পেয়েছেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত পরিচালিত ‘তাহাদের কথা’ ছবির জন্য। অরুণ মুখোপাধ্যায় এই পুরস্কার পেয়েছেন মৃণাল সেনের বাংলা ছবি ‘পরশুরাম’-এ অসাধারণ অভিনয় ফুটিয়ে তুলে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় পেয়েছেন ২০০৬ সালে। ‘পদক্ষেপ’ ছবির জন্য। সবথেকে কমবয়সী অভিনেতা হিসেবে সেরা অভিনেতার জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন ঋদ্ধি সেন। ‘নগরকীর্তন’ ছবির জন্য। ২০১৭ সালে।
আরও পড়ুন-বাগ্দেবীর মণ্ডপসজ্জার থিম সাবেক ঠাকুর-দালান
১৯৮৪ সালে মুক্তি পেয়েছিল সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ছবি ‘ঘরে বাইরে’। রবীন্দ্র-উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি হয়েছিল ছবিটি। নিখিলেশ চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেন ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়। এই ছবির জন্য তিনি পেয়েছিলেন সেরা সহ-অভিনেতার জাতীয় পুরস্কার। প্রথম বছরেই তিনি এই সম্মান লাভ করেন। বাঙালির মুকুটে যোগ হয় নতুন পালক। দ্বিতীয় বছর এই পুরস্কার পান আরও এক বাঙালি অভিনেতা দীপঙ্কর দে। ‘পরমা’ ছবির জন্য। পরবর্তী সময়ে এই পুরস্কার পেয়েছিলেন মিঠুন চক্রবর্তীও। বাংলায় সেরা অভিনেত্রীর জাতীয় পুরস্কার এসেছে মাধবী মুখোপাধ্যায়, শর্মিলা ঠাকুর, শ্রীলেখা মুখোপাধ্যায়, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, ইন্দ্রাণী হালদার, কঙ্কণা সেন শর্মা, অনন্যা চট্টোপাধ্যায়ের হাত ধরে। সেরা সহ-অভিনেত্রীর জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন সুদীপ্তা চক্রবর্তী, সোহিনী সেনগুপ্ত, রাখী গুলজার, শর্মিলা ঠাকুর, কঙ্কণা সেন শর্মা।
পরিচালকদের মধ্যেও দেখা গেছে বাঙালিদের জয়জয়কার। ১৯৬৭ সালে প্রথম বছর সেরা পরিচালক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। ‘চিড়িয়াখানা’ ছবির জন্য। দ্বিতীয় বছরেও ছবির বদল হয়নি। সত্যজিৎ রায় এই পুরস্কার পেয়েছিলেন ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ ছবির জন্য। এরপর আরও চারবার। মোট ছ’বার। তৃতীয় বছর পেয়েছিলেন মৃণাল সেন। ‘ভুবন সোম’ ছবির জন্য। তিনি এই পুরস্কার পেয়েছেন চারবার। এ-ছাড়াও বাঙালি পরিচালকদের মধ্যে পুরস্কৃত হয়েছেন তপন সিংহ, উৎপলেন্দু চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, অপর্ণা সেন, গৌতম ঘোষ, ঋতুপর্ণ ঘোষ, সৃজিত মুখোপাধ্যায়।
বাংলা থেকে সেরা গায়ক হিসেবে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন শচীন দেব বর্মন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, অজয় চক্রবর্তী, রূপম ইসলাম, রূপঙ্কর বাগচী, অরিজিৎ সিং। সেরা গায়িকা হিসেবে পুরস্কৃত হয়েছেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, ছায়া গঙ্গোপাধ্যায়, শ্রেয়া ঘোষাল, রূপা গঙ্গোপাধ্যায়, ইমন চক্রবর্তী, মোনালি ঠাকুর। সুরকার হিসেবে এই পুরস্কার পেয়েছেন শচীন দেব বর্মন, সত্যজিৎ রায়, আনন্দ শঙ্কর, নীল দত্ত, ময়ূখ ভৌমিক, কবীর সুমন, শান্তনু মৈত্র। সেরা চিত্রনাট্যকার হিসেবে পুরস্কৃত হয়েছেন সত্যজিৎ রায়, তপন সিংহ, মৃণাল সেন, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, অপর্ণা সেন, গৌতম ঘোষ, ঋতুপর্ণ ঘোষ, সুজয় ঘোষ, কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, চূর্ণী গঙ্গোপাধ্যায়, সৃজিত মুখোপাধ্যায়।
আরও পড়ুন-পারিয়া
অন্যান্য বিভাগে আরও কয়েকজন কৃতী বঙ্গসন্তান পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। সবমিলিয়ে সংখ্যাটা কম নয়। এঁদের মধ্যে অনেকেই প্রয়াত। যাঁরা জীবিত, তাঁদের নিয়ে আগামী ২৬ ফেব্রুয়ারি কলকাতার আইটিসি রয়্যাল হোটেলে আয়োজিত হতে চলেছে একটি বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানের নাম রাখা হয়েছে ‘বাংলার জাতীয় গর্ব’। অনুষ্ঠানে সম্মাননা জানানো হবে বাংলার মোট ২৬ জন জাতীয় পুরস্কারজয়ী তারকাকে। জোরকদমে চলছে প্রস্তুতি। আয়োজনে অ্যাঞ্জেল ক্রিয়েশন। ভাবনার মূল কান্ডারি সঙ্গীতা সিনহা। তিনি সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছেন, শুধু ভারতবর্ষে নয়, বাংলাকে যাঁরা সারা বিশ্বে এক অন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছেন, তাঁদের আমরা কুরনিশ জানাই। তাঁরা বাংলার গর্ব। তাঁরা আমাদের অহঙ্কার। বাঙালি হিসাবে আমরা যেন তাঁদের অবদানের প্রাপ্য সম্মান দিতে পারি। প্রত্যেকটি বাঙালির মনে তাঁদের নাম চিরস্মরণীয় হয়ে থাকুক, এটাই আমরা চাই। উপস্থিত থাকবেন গৌতম ঘোষ, কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, রূপঙ্কর বাগচী, ইমন চক্রবর্তী, অনন্যা চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জয়ীরা।
প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন কয়েকজন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জয়ী। অভিনেত্রী সোহিনী সেনগুপ্ত বলেছেন, ‘উদ্যোগটা ভাল এই ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই। তবে আমি বিশেষ কিছু জানি না।’ অভিনেত্রী সুদীপ্তা চক্রবর্তী বলেছেন, ‘অনুষ্ঠানটা সম্পর্কে এখনও পর্যন্ত আমার কিছু জানা নেই। পাইনি আমন্ত্রণ।’ অভিনেত্রী ইন্দ্রাণী হালদার বলেছেন, ‘বাংলা থেকে যাঁরা জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন, তাঁদের বিশেষভাবে সম্মান জানানো হবে, এটা সাধু উদ্যোগ। সত্যিই প্রশংসনীয়। আমি এই উদ্যোগের সাফল্য কামনা করি।’ সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে পরিবেশিত হবে গান। শিল্পী সৌরেন্দ্র এবং সৌম্যজিৎ। গতকাল সাউথ সিটি মলে ছিল কার্টেন রেজার। উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্টরা।