ঝড়ের সঙ্গে লড়াই করেই টিকে আছে সুন্দরবন। আয়লা থেকে আমফান। একের পর এক ঝড় আছড়ে পড়েছে বাদাবনে। তছনছ করে দিয়েছে দ্বীপের পর দ্বীপ। প্রকৃতির উপর নিয়ন্ত্রণ নেই। তবে বিপর্য়য় মোকাবিলার প্রস্তুতি ও পরিকল্পনার রাশ আছে প্রশাসনেরই হাতে। আর সেখানেই ফারাকটা চোখে পড়ছে। আয়লার সময়ে যা হয়নি, আমফানে তা ঘটেছে। গতিশীল প্রশাসনকে সঙ্গী করে সুন্দরবনের ধ্বংস আটকাতে পদক্ষেপ করছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee)। লিখছেন মণীশ কীর্তনীয়া।
২০০৯ সালের ৭ মে। ভয়াবহ আয়লা তছনছ করে দিল গোটা সুন্দরবনকে। ২৯ মে সকালবেলা এনডিআরফের সঙ্গে চললাম সন্দেশখালি ১ ও ২ অঞ্চলে। জের চোখে দেখতে ও বুঝতে ধ্বংসের গতিপ্রকৃতি। ছোট্ট স্পিড বোটে আমি, সঙ্গী চিত্রসাংবাদিক এবং দুই জওয়ান। এরকম গুটিকয় বোটে ছড়িয়েছিটিয়ে আরও কয়েকজন। মাতলা ফুঁসছে। সেই উত্তাল জলের উপর দিয়ে প্রায় ঘণ্টা তিনেক ভেসে পৌঁছলাম সন্দেশখালি। পথে চোখে পড়েছে, জলে ভাসছে একাধিক হতভাগ্যের লাশ। ভাসছে অগুনতি গবাদি পশুর ফুলেফেঁপে ওঠা দেহ। আয়লা আছড়ে পড়েছে তার ৪৮ ঘণ্টা আগে। কিন্তু সেই তুফানের ভয়াবহতা তখনও যে কতটা টাটকা, তা যাঁরা দেখেননি, তাঁদের বিশ্বাস করানো কঠিন। চারদিকে জুড়ে তাণ্ডবের ছবি। হাহাকারের ছবি।
আরও পড়ুন – অনাস্থার বিরুদ্ধে কড়া বার্তা জেলা সভাপতির
একাধিক নদীবাঁধ ভেঙে গ্রামের পর গ্রাম ভেসে গিয়েছে। ঘর-বাড়ি বলে কোনও কিছুর অস্তিত্ব নেই। চাষের জমি কোথায় তলিয়ে গিয়েছে, কেউ জানে না। এক আঁজলা পানীয় জলের জন্যে আর্তি। খাবার নেই, বেবিফুড নেই, ওষুধ নেই, বিদ্যুৎ নেই। সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকা এক নেই রাজ্য। ঝড়ের পরে আমরাই প্রথম গিয়ে পৌঁছেছিলাম বিধ্বস্ত সুন্দরবনে। তার আগে কেউ ঢুকতে পারেনি এ তল্লাটে। নদীর পাড়ে ভিড় করে থাকা অসহায় মানুষজন আমাদের স্পিড বোট দেখেই জুড়ে দিয়েছেন চিৎকার। পড়ে গিয়েছে হুড়োহুড়ি। আমরা পরিস্থিতি আন্দাজ করে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম বেশ কিছু শুকনো খাবার ও পানীয় জলের বোতল।
যদিও প্রয়োজনের তুলনায় তা কতটুকই বা। সেটুকু নিতেই পারলে নদীতে ঝাঁপ দেন সকলে। এর আগেও কাজের সূত্রে একাধিকবার সুন্দরবন গিয়েছি। কিন্তু এই ভয়বহতা নাড়িয়ে দিয়েছিল আমার অন্তঃকরণ। আমরা যতটুকু পারলাম সাহায্য করলাম। নদী ছেড়ে পাড়ে নেমে গ্রামের ভিতরে ঢুকলাম। পরিস্থিতি কতটা ভয়ঙ্কর, তা বোঝার আরও বাকি ছিল। বুক সমান জল ঠেলে আমরা এগিয়ে গেলাম। ঘর-বাড়ি সবই প্রায় ডুবে রয়েছে। জোয়ান মরদ থেকে নিতান্ত কিশোরী মেয়েটিও প্রাণ বাঁচাতে নদীর পাড়ে খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু অশক্ত বুড়ো-বুড়িরা? তাঁরা পারবেন কেন! তাঁরা পড়ে আছেন ওই বিষাক্ত জলের মধ্যেই আধডোবা ঘরে। কাউকে বা তুলে দেওয়া হয়েছে মাচায়। কিন্তু খাবার বা জল তাঁরা পাবেন কী করে! এই দৃশ্য চোখের সামনে দেখছি আর শিউরে উঠছি। এ তল্লাটে দেখলাম, কোথাও প্রশাসনের নামগন্ধ নেই।
তখন ঘোর বাম জমানা। সিপিএমের মাতব্বররা কেউ কোথাও নেই। তখন তো আর স্মার্ট ফোনের জমানা নয়। হোয়াটসঅ্যাপ, ফোর জি, সেল্ফি, ফেসবুক, ইন্সটা, ট্যুইটার ইত্যাদি তখনও ভবিষ্যতের গর্ভে। না-হলে সেসব ছবি ধরে রাখা যেত। যা ক্যামেরাবন্দি হয়েছে, তা আছে চ্যানেলের আর্কাইভে। যাই হোক, ঘুরতে ঘুরতে সন্ধ্যা হয়ে এল। এদিনের মতো ফিরতে হবে ডেরায়। দেখলাম ভারত সেবাশ্রম সংঘের লোকেরা এসে পড়েছেন। সঙ্গে রান্না করা খিচুড়ি, পানীয় জল। ওষুধও আছে। নদীর পাড়ে লাইন দিয়ে সকলকে খাবার দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। আবারও যথারীতি হুটোপুটি লেগে গিয়েছে। যদিও তখনও পর্যন্ত একজন সরকারি প্রতিনিধিকেও চোখে পড়েনি।
কাট টু ২০২০। আমফান-পরবর্তী সুন্দরবন। আবারও নেমে পড়া ক্ষয়ক্ষতি দেখতে। তফাতটা এবার মালুম হল। ২০০৯ সালে তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার যা করেনি, ২০২০ সালে তা করেছে মা-মাটি-মানুষের সরকার। ঝড়ের আগাম সতর্কবার্তা পেয়ে অনেক আগে থেকেই প্রশাসনকে কাজে নামিয়ে দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee)। যার জেরে কয়েক লক্ষ মানুষকে সরিয়ে নেওয়া গিয়েছে নিরাপদ জায়গায়। রিলিফ সেন্টারে। প্রশাসন আগে থেকেই মজুত করে রেখেছিল পর্যাপ্ত শুকনো খাবার, পানীয় জলের পাউচ, ওষুধ ও পর্যাপ্ত বেবি ফুড। ছিল দ্রুত বিদ্যুৎ সংযোগ ফিরিয়ে আনার জন্য প্রস্তুতি। আগে থেকেই মজুত করে রাখা ছিল প্রচুর খুঁটি, তার আর প্রয়োজনীয় লোকলস্কর, ইঞ্জিনিয়ার, অফিসার সবই। ঝড়ের রেশ কাটার পর তাই দ্রুত পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে অসুবিধে হয়নি রাজ্য প্রশাসনের। এড়ানো গিয়েছিল বড় মাপের প্রাণহানির ঘটনা। যদিও ঘরবাড়ি ও ফসলের ক্ষতি হয়েছে।
কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিজে গোটা সুন্দরবন ঘুরে দেখেছেন। প্রশাসনিক বৈঠক করে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বুঝে নিয়েছেন। যুদ্ধকালীন তৎপরতায় সামাল দিয়েছেন সংকটের পরিস্থিতি। যেদিন আমফান আছড়ে পড়ে ভয়াবহ গতিতে, সেদিনও নবান্নে কন্ট্রোল রুম খুলে অফিসারদের সঙ্গে নিয়ে নিজে সারারাত জেগে বসেছিলেন। প্রতি মুহূর্তের খবর নিয়েছেন। চালিয়েছেন নজরদারি।
সুন্দরবনকে বাঁচাতে হলে, বাঁধতে হবে নদীর পাড়কে। পাকাপাকি ভাবে। এটাই একমাত্র স্থায়ী ও গ্রহণযোগ্য পন্থা। আয়লার পর তখনই বামফ্রন্ট সরকারকে সে কথা জানিয়ে দিয়েছিলেন বিশেষজ্ঞরা। কেন্দ্রের টাকাও এসেছিল। সামান্য কাজ শুরু হলেও দীর্ঘসূত্রিতার জেরে তা শেষ হয়নি। ফেরত চলে যায় কিস্তির টাকা। তারপর থেকে সুন্দরবনের নদীবাঁধ নিয়ে শুধুই রাজনীতি হয়েছে। কাজের কাজ কিছু হয়নি। ২০১১ সালে তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার ক্ষমতায় আসার পর নতুন করে শুরু হয় সেই নদীর পাড় বাঁধানোর কাজ। কংক্রিটের বাঁধ। যা প্রাকৃতিক দুর্যোগের আঘাত থেকে রক্ষা করবে সুন্দরবনকে। আর পরোক্ষভাবে বাঁচিয়ে দেবে বৃহত্তর কলকাতাকেও। বাঁচিয়ে দেবে অগুনতি মানুষের জীবন ও জীবিকা।